ভাষা আন্দোলন ও কিছু স্মৃতি

দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বাংলা ভাষা এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পায়নি। প্রকৌশল, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। উচ্চ আদালতেও পুরোপুরি বাংলার ব্যবহার হচ্ছে না। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার পর্যায় পর্যন্ত শুদ্ধরূপে বাংলা ভাষা লেখা ও বলার ক্ষেত্রে যে দুরবস্থা বিরাজ করছে, তা কেবল লজ্জাজনক নয়, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধও বটে।

প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি পুরান ঢাকার কে এল জুবলি স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তখন আমাদের ক্লাস শিক্ষক ছিলেন কামরুজ্জামান স্যার। তিনি পরে যুক্তফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন নিয়ে এমপি হয়েছিলেন। হয়েছিলেন কে এল জুবলি স্কুলের প্রিন্সিপাল। পরে কে এল জুবলি স্কুল কলেজে রূপান্তরিত হলে তিনি কলেজেরও প্রিন্সিপাল হন। তিনি সারা দেশের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। কামরুজ্জামান স্যার ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ায় স্যারের সঙ্গে আমার সখ্যতা ছিল ভালো। স্যারের নেতৃত্বে আমরা একাধিকবার মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারিতেও আমরা মিছিলসহকারের ভাষা আন্দোলনের জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম। যাই হোক আসল কথায় আসি, ভাষা আন্দোলন পূর্বপাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়, কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা হিসেবেও পরিচিত) ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে পার্থক্য ছিল প্রচুর। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, যা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তুমুল ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ (যারা সংখ্যার বিচারে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল) এ সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে চায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি : ১৯৪৭ সালেই করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশ করা হয় এবং প্রচারমাধ্যম ও স্কুলে কেবল উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ঢাকার ছাত্রসমাজ আবুল কাসেমের নেতৃত্বে মিছিল করে, যিনি ছিলেন তমদ্দুন মজলিস নামক একটি বাঙালি ইসলামীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্পাদক। ওই সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয় তালিকা হতে বাদ দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রা ও স্ট্যাম্প হতেও বাংলা অক্ষর লুপ্ত হয়। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে জনরোষের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাঙালি ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল, মিটিং ওর্ যালির আয়োজন করে। ২১ ফেব্রয়ারির ঘটনা সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্স্নোগান দিতে থাকে এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিকে প্রাচীর তৈরি করে। বিভিন্ন অনুষদের ডিন এবং উপচার্য সে সময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে চাইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস বর্ষণ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়। কিছু ছাত্র এই সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড়ে চলে গেলেও বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করতে বলে। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করা শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের দাবি উত্থাপনের দাবি জানায়। কিন্তু পরিস্থিতি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইন সভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। ছাত্ররা সেই উদ্দেশ্যে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ দৌড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিবর্ষণের কিছু ছাত্রকে ছাত্রাবাসের বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আবুল বরকত সে সময় আহত হন এবং রাত ৮টায় প্রয়াত হন। এখানে উলেস্নখ্য, ওই দিন বর্তমান যেখানে শহিদ মিনার সেখানের দেওয়াল টপকাতে গিয়ে আমার পরনের শার্ট ও প্যান্ট ছিঁড়ে যায়। হাত-পা ছুলে সামান্য আহতও হই। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষায় মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শহর-নগর-গ্রাম-বন্দর সর্বত্র একুশে উদযাপিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমও এখন বাংলা (উচ্চশিক্ষার কতিপয় ক্ষেত্র বাদে)। সরকারি কর্মকান্ডের ভাষাও বাংলা। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বাংলা ভাষা এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পায়নি। প্রকৌশল, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। উচ্চ আদালতেও পুরোপুরি বাংলার ব্যবহার হচ্ছে না। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার পর্যায় পর্যন্ত শুদ্ধরূপে বাংলা ভাষা লেখা ও বলার ক্ষেত্রে যে দুরবস্থা বিরাজ করছে, তা কেবল লজ্জাজনক নয়, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধও বটে। ইউরোপের প্রতিটি উন্নত জাতি, এশিয়ায় চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যে আরবি ভাষাভাষী প্রতিটি জাতি যদি রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামাজিক জীবনে নিজ নিজ মাতৃভাষা ব্যবহার করে উন্নতির চরম শিখর স্পর্শ করতে পারে, তা হলে বাঙালি কেন সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার করবে না? এবারের একুশের প্রতিজ্ঞা হোক, আসুন আমরা সেই আলোকোজ্জ্বল পথে মাতৃভাষা বাংলাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করি। বাংলা ভাষার অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাই। পরিশেষে বলছি, বাংলা ও বাঙালির জয় হোক। জয় হোক সব জাতির মাতৃভাষার। আর কে চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সভাপতি বাংলাদেশ ম্যাচ ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন, সদস্য এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা