বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশবান্ধব বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন

ফারজানা আক্তার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল পলিথিন, বর্তমানের বহুল আলোচিত বিষয়। পলিথিন যেখানে শতবছরব্যাপী পরিবেশের ক্ষতি করে সেখানে বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন এক আশীর্বাদস্বরূপ পরিবেশবান্ধব আবিষ্কার। বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন হলো পরিবেশবান্ধব পলিথিন যা, পরিবেশের অণুজীবগুলো পলিথিনের কাঠামো বিপাক ও ভেঙে ফেলে এবং পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। বর্তমানে এই পলিথিনের চাহিদা বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত বর্ধিত হচ্ছে। এটি একাধারে পরিবেশের বন্ধু এবং অর্থনীতির অগ্রগতিতে রাখছে বিশাল অবদান। ২০০২ সালে এশিয়ায় প্রথম বাংলাদেশ পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয় (বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫)। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, গেজেট বিজ্ঞপ্তি দ্বারা পরিবেশের জন্য ১৯৯৫-এর ধারা ৬ (এ) অনুযায়ী সরকার ক্ষতিকারক রাসায়নিক পলিথিনের বাণিজ্যিক ব্যবহার, উৎপাদন, আমদানি, বিপণন, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, স্টোর, বিতরণ, বাণিজ্যিক পরিবহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। লঙ্ঘনকারীদের পরিস্থিতি অনুসারে সর্বনিম্ন ৫০,০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ দশ লাখ টাকা পর্যন্ত বা সর্বনিম্ন এক বছর থেকে সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদন্ডে জরিমানা করা হবে। সুতরাং, পলিথিন ব্যবহার ও উৎপাদন করা একটি শাস্তিমূলক অপরাধ। কিন্তু এরপরও পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার বেড়েই চলছে। শুধু ঢাকায় প্রতিদিন ২ কোটি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০২ থেকে ২০১৯ অবধি বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্ক করেছেন কিন্তু তবুও পলিথিনকে আমাদের জীবন থেকে মুছে ফেলা যাচ্ছে না। আমরা দৈনন্দিন জীবনে প্রায় সকল প্রকার কাজে পলিথিননামক দূষক ব্যবহার করে যাচ্ছি। চিপসের প্যাকেট থেকে শুরু করে আমাদের ময়লা-আবর্জনা ফেলার ব্যাগ হিসেবেও আমরা পলিথিন ব্যবহার করে থাকি। পলিথিন নিষিদ্ধ করার কারণ হচ্ছে পলিথিন দ্বারা সৃষ্ট দূষণ। পলিথিন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে এর দূষণের মাত্রাও। কিন্তু পলিথিনের বিকল্প হিসেবে আর কিছুই নেই। পলিথিন এখন দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস। ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক এবং পলিথিন বিশেষজ্ঞ ডা. হোসেন শাহরিয়ার বিএসএসের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, কোরিয়ান ইনস্টিটিউট অফ হেলথ রিসার্চ কর্তৃক পরিচালিত পলিথিন সম্পর্কিত গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, পলিথিন কারখানায় কর্মীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। শুধু ক্যান্সারই নয়- কর্মীদের ত্বকের রোগ এবং অন্যান্য মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যাও দেখা দেয়। তিনি বলেছিলেন, পলিথিন মোড়ানো মাছ এবং মাংস এক ধরনের তাপ উৎপন্ন করে বিকিরণের সৃষ্টি করে যা শেষ পর্যন্ত খাদ্যকে বিষাক্ত করে তোলে। ১. ডা. শাহরিয়ার বলেন, পলিথিন মোড়ানো মাছ, মাংস এবং শাক-সবজি চামড়া রোগ এবং ক্যান্সারের জন্য দায়ী জীবাণু অ্যানেরোবিক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত হয়। তিনি বলেছিলেন, আমাদের দেশে পলিথিন ব্যাগে ব্যবহৃত রং জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. শাশ্বতী রায় এক গবেষণায় জানতে পেরেছেন, পলি কাপে চা গ্রহণ করা আলসার এবং ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পলিথিন ব্যাগ এবং অন্যান্য পস্নাস্টিকের সামগ্রী যদি ৭,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে পোড়া হয় তবে বিষাক্ত গ্যাসের মতো ডাইঅক্সিন তৈরি করে, যা ক্যান্সার এবং ত্বকের রোগের কারণ হতে পারে। পলিথিন ব্যাগগুলো বাড়ির আশপাশে ফেলে দেওয়ার ফলে তা মশা প্রজননের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে যার ফলে ডেঙ্গু জ্বর, ফিলারিয়াসিস এবং ম্যালেরিয়া হয়। ২. পস্নাস্টিকের ব্যাগগুলো সামুদ্রিক বন্যজীবন বিশেষত দুর্বল মাছ, প্রাণী এবং পাখিগুলোকে দম বন্ধ করতে বা বিষাক্ত করতে পারে। সরকার কর্তৃক উদ্ধৃত গবেষণায় বলা হয়েছে, 'যখন সামুদ্রিক পাখি, সমুদ্রের স্তন্যপায়ী প্রাণী বা মাছ পস্নাস্টিকের কণাগুলো গ্রাস করে, তখন অন্ত্রে বস্নক করা জীবকে ক্ষতি করতে বা এমনকি হত্যা করতে পারে' ৩. পস্নাস্টিকের ব্যাগগুলো মারাত্মক উপায়ে পরিবেশকে ব্যাহত করে। এগুলো মাটিতে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বের করে দেয়, যার ফলে এগুলো মাটিতে ভেঙে যায় এবং দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হলো প্রাণীগুলো সেই রাসায়নিক পদার্থগুলো গ্রহণ করে এবং প্রায়ই শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায়। ৪. জেলিফিশজাতীয় প্রাণী খাবারের জন্য প্রায়ই পস্নাস্টিকের ব্যাগ ভুল করে গ্রহণ করার কারণে সামুদ্রিক পরিবেশে পস্নাস্টিকের ব্যাগের লিটার থেকে প্রতি বছর কয়েকশো সংখ্যক সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়। একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিকের ব্যাগগুলো কোনো প্রাণীর দ্বারা হজম বা পাস করা যায় না তাই এটি অন্ত্রে থাকে। ৫. পলিথিন ব্যাগগুলো শহর ও শহরে নিকাশী ব্যবস্থা বন্ধ রাখার জন্যও দায়ী। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক বেগম রুবিনা ফেরদৌসী বলেছেন, 'পলিথিন ব্যাগ যে পরিবেশ দূষণের হুমকির সম্মুখীন তা জনসাধারণকে অবহিত না করে, পলিথিন নির্মূল করা সম্ভব নয়।' কিন্তু সমস্যা হলো, পলিথিনের কোনো কার্যকর বিকল্প নেই। তাই এই মুহূর্তে আমাদের পলিথিনকে নিষিদ্ধ না করে পলিথিনের বিকল্প খুঁজতে হবে। এই সময়ে রাসায়নিক পলিথিনের উপযুক্ত এবং একমাত্র বিকল্প হলো বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল পলিথিন। যেখানে পরিবেশ, জলবায়ু, মানবস্বাস্থ্য রাসায়নিক পলিথিননামক বিষের কবলে পড়েছে সেখানে পচনশীল পলিথিন নিঃসন্দেহে আশার আলো জাগ্রত করেছে। রাসায়নিকভাবে পলিথিন তৈরি হয় কার্বন অণুর দীর্ঘ চেইন থেকে। অনেক ছোট ছোট ইথিলিন যুক্ত হয়ে পলিথিন তৈরি হয়। পলিথিন এক প্রকার পস্নাস্টিক, যা হালকা কিন্তু মজবুত। এর কাঠামোর জন্য আমরা খুব সহজে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু পলিথিন পরিবেশে টিকে থাকে শতবছর এবং তা অবস্থান করে মাটিতে এবং পানিতে। এরা মাটিতে বায়ু চলাচলে বাধা দেয়। পলিথিন সাধারণত প্রায় ৫০০-১০০০ বছরে ক্ষয় হয়, যদিও আমরা এর আসল অবক্ষয়ের সময়টি কখনই জানতে পারি না, কারণ এই উপাদানটি কেবল গত শতাব্দী থেকেই দীর্ঘমেয়াদিরূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পলিথিন উৎপাদনের সময় অনেক বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়, যা মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণীদের মধ্যে ভয়াবহ রোগের কারণ হতে পারে। ইথিলিন অক্সাইড, জাইলিন এবং বেনজিন হলো পলিথিনের কিছু রাসায়নিক পদার্থ যা পরিবেশে বিপজ্জনক প্রভাব ফেলতে পারে। এটিকে অপসারণ করা সহজ নয় এবং এটি জীবকে স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে।

কিন্তু পচনশীল পলিথিনের কার্বন কাঠামো আমরা পেতে পারি ভুট্টা বা স্টার্চজাতীয় ফসল থেকে যাকে বলা হচ্ছে বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন। এই বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন মূলত প্রস্তুত করা হয় বিভিন্ন প্রকার ফসল (ধান, গম, ভুট্টা, পাট ইত্যাদি) অথবা স্টার্চ জাতীয় শাক-সবজি থেকে এবং তা পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবে পচে যায়। এর কাজ, কাঠামো সব কিছুই রাসায়নিক পদ্ধতিতে বানানো পলিথিনের মতোই। কিন্তু এই পলিথিন এর বিয়োজনে অণুজীব খুব ভালো কাজ করে? এই পলিথিনের কিছু উলেস্নখযোগ্য উপকার হলো এটি অনবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোকে সংরক্ষণ করে, কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনে এবং এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। দেশে বিদেশের বৈজ্ঞানিকরা অনেক আগে থেকেই এটি নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে ভারত, চীন, ছাড়াও পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশগুলো বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন প্রস্তুত করছে এবং এর চাহিদা আকাশচুম্বী প্রায়। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অবস্থিত অভনী কোম্পানিটি বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন উৎপাদন করে। এ ছাড়া আফ্রিকা, উগান্ডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, উত্তর আমেরিকাসহ প্রায় শতকের মতো দেশ রাসায়নিক পলিথিনকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে এবং তারা পচনশীল পলিথিন ব্যবহার করে থাকেন। ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সূত্র ধরে পলিথিন ব্যাগের উপযুক্ত বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার লক্ষ্যে আমাদের দেশের কিছু কারখানায় পচনশীল এই পলিথিন প্রস্তুত করা হচ্ছে যা ২০১৯ সালে থেকেই উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো গাজীপুরের কামারপাড়ায় অবস্থিত 'এক্সপো এক্সেসরিস'। এখানে ভুট্টা থেকে এই পলিথিন প্রস্তুত করা হচ্ছে, যা বিদেশে সরাসরি রপ্তানি করে এবং এর চাহিদা প্রচুর। মোহাম্মদ এনামুল হক, যিনি এই কারখানার ম্যানেজিং ডিরেক্টর তিনি বলেছেন, 'এক্সপো এক্সেসরিস বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে টার্গেট করেছে, এবং ৩০টি কারখানায় বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন সরবরাহ করা হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<89598 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1