শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে ফেব্রম্নয়ারি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মাহমুদ আহমদ ঢাকা
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' দাবিতে বাঙালিরা যখন রাজপথে নেমে এসেছিল, তখন পাকিস্তানিরা তার জবাব দিয়েছিল বুলেটের মাধ্যমে। বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের তাজা রক্তে রাজপথ করেছিল রঞ্জিত। সেই রক্তের ছোঁয়া পেয়ে আশ্চর্য দ্রম্নততায় গোটা জাতি জেগে উঠেছিল তার শেকড়ের টানে। পাকিস্তানিদের সৃষ্টি করা সাম্প্রদায়িকতা তাতে কোনো বাদ সাধতে পারেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সেদিন এক হয়ে একটিই প্রতিজ্ঞা করেছিল- মায়ের ভাষার সম্মান রাখবই, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করবই। রক্তের বিনিময়ে এ বাংলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা। একঝাঁক থোকা থোকা নাম সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের মতো অনেকের জীবন বিসর্জনের মধ্যদিয়ে বাঙালি তার ভাষা, স্বকীয়তা এবং গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছিল। ২১ ফেব্রম্নয়ারি বাঙালি জাতির নবতর উত্থান ও অভু্যদয়ের দিন। একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমাদের সংস্কৃতির হৃৎপিন্ড। বাংলা আমাদের দেশমাতৃকা, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা আমাদের প্রিয় ভাষা। বাংলা ভাষা বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এই ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধর্মাবলম্বীদের রয়েছে অবদান। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে মর্যাদায় উন্নীত করতে ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখো প্রাণের তাজা রক্ত। মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেয়ার যে ইতিহাস বাংলার বীর সেনারা সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে আর এমন দৃষ্টান্ত নেই।

বুকের তাজা রক্তের আখরে সৃষ্টি বাংলাভাষা, সময় পরিক্রমায় ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বন্যায় এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আব্রম্নর বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন এই বাংলাদেশ। সমগ্র জাতি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের কথা, দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে যারা পরাক্রমশালী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার সূর্য পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল। ওই বিজয়ের পিছনে ছিল কোটি কোটি মানুষের দৃঢ় প্রত্যয় ও অকুণ্ঠ সমর্থন। ছিল ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বহু রাষ্ট্র ও শান্তিকামী মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা। সর্বোপরি ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ নেতৃত্ব। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে তিনি জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, শত্রম্নর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনে 'যার যা আছে' তা নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে জুগিয়েছিলেন প্রেরণা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ঘাতকরা সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাস থেকে তার অসামান্য অবদান মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালালেও সফল হয়নি। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বাঙালি জাতির অহংকার হিসেবে তার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

একুশে ফেব্রম্নয়ারি ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালিদের ঐক্য-চেতনার অগ্নিস্মারক। এই এক অবিনাশী, অনশ্বর-চৈতন্যের জ্যোতির্ময় শিখা। এ শতাব্দীতে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, তা হলো অমর এ রক্তাক্ত একুশের বিশ্ব স্বীকৃতি। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ রোজ বুধবার প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এবং তা ২০০০ সাল থেকে বাস্তবায়িত করার ব্যবস্থা নিয়ে বাঙালি জাতিকে বিশ্বে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এ মহান কার্যাদি একদিনে সুসম্পন্ন হয়নি এর জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আজ আমাদের হৃদয় গর্বে ভরে যায়, পৃথিবীর সব দেশের জনগণ প্রতিবছর এ নদী বিধৌত পলি-মাটির মনুষ্যত্ব আর গণতান্ত্রিক সমর্থনে সাধারণ মানুষ কতটা নিবেদিত প্রাণ ও দেশপ্রেমিক হতে পারে এবং কতটা আত্মত্যাগী হতে পারে এ বিষয়ে জানছে এবং আরও জানবে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার আর একাত্তরের ৩০ লাখ শহিদ ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত হারানো শাশ্বত এ বাঙালির রক্তের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ, আজ পরম শ্রদ্ধার দেদীপ্যমান সারা বিশ্বের জনগণের কাছে। অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত শস্য-শ্যামল-সবুজের সমারোহে ভরা নয়ন জুড়ানো আমার সাধের বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের প্রতিটি ভাষাভাষীর মানুষের গর্বে ধন্য ও প্রাণের সম্পদ। স্বাভাবিকভাবে একুশ আজ প্রতিটি বাঙালির অহংকারের প্রতীক। একুশ প্রতিটি স্বাধীনতাকামী বাঙালির গর্ব, সাহস ও প্রেরণার উৎস। 'ইউনেস্কো'-এর সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তের ফলে একুশ আজ গোটা বিশ্বের সম্পদে দাঁড়িয়েছে। বাংলা বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ৫ম ভাষা। আর আমাদের রাষ্ট্রের একমাত্র ভাষা। এ ভাষার প্রগতি, উন্নতি উৎকর্ষের জন্য কারও কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। একুশে ফেব্রম্নয়ারি রক্তের বিনিময়ে বাঙালি খুঁজে পায় নিজস্ব সত্তা। আর এর ফলেই বাঙালি লাভ করে স্বাধীন রাষ্ট্র। বিভিন্ন ভাবে দেশ অনেকটাই এগিয়েছে বলা যায়, কিন্তু একুশে ফেব্রম্নয়ারির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, সেগুলোর কি নিষ্পত্তি আজও আমরা করতে পেরেছি? বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সত্য, কিন্তু তা কি চালু করা সম্ভব হয়েছে সর্বস্তরে? একুশের অন্যতম তাৎপর্য ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে অসাম্য, বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য ইত্যাদি থাকবে না। এই মহৎ আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটেছে কি? বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আবহমানকালের সংস্কৃতি ইত্যাদি সমুন্নত রাখার ঐক্যবদ্ধ সমন্বিত প্রচেষ্টা কি লক্ষ্য করা যাচ্ছে সমাজে? চিন্তার দিক থেকে আমরা হব আন্তর্জাতিক, কিন্তু পরিচয়ে থাকব বাঙালি- এই ধারায় কি যাপন করছি জীবন? পরিশেষে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই সেই সব বীর শহিদ ও বীর সৈনিকদের যারা এ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং লড়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<89599 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1