নারী অধিকার সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নে আধুনিক কল্যাণমুখী কার্যকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ২০২১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়ন এবং সার্বিক উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্তকরণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী দারিদ্র্য বিমোচন, নারী নির্যাতন বন্ধ, নারী পাচার রোধ, কর্মক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা বিধান এবং আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডে নারীর পূর্ণ ও সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অসামান্য অবদান রাখে। যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান এবং স্বামী ও সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে আমাদের মায়েরা এক বিশাল দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের নিদর্শন রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আমাদের লক্ষাধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই জঘন্য অপরাধ কখনই ভোলার নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে নারী আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। শিক্ষা গ্রহণ ও কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় নারীসমাজের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগে। গ্রামে নিরক্ষর নারীসমাজের মধ্যেও কাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার আগ্রহ জাগে। জাতীয় উৎপাদনে নারীর অংশগ্রহণ আবশ্যক হয়ে ওঠে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত হয় উন্নয়ন পরিকল্পনা। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসন জেঁকে বসে ও দীর্ঘ সময় সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হয়। অবশ্য এ সময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারী সংগঠনগুলোর আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নারী সংগঠনগুলোও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা সচেতন হয়ে ওঠে। এতে দেশে নারী উন্নয়নে এক বিরাট সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সত্তর দশকের প্রথম ভাগ থেকেই তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার নারী উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলনে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে দেশের বাইরে নারী উন্নয়নের যে আন্দোলন চলছিল তার মূলধারায় বাংলাদেশ যুক্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে নারীসমাজ উন্নয়নের যে অবস্থানে রয়েছে তার ভিত্তি এই উদ্যোগের ফলে রচিত হয়। জাতিসংঘ নারীর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালকে 'নারীবর্ষ' হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৯৭৬-১৯৮৫ সালকে নারী দশক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। নারী দশকের লক্ষ্য ছিল সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি। ১৯৮০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় নারী সম্মেলন। এতে ১৯৭৬-৮৫ পর্বের নারী দশকের প্রথম পাঁচ বছরের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয় এবং নারী দশকের লক্ষ্যের আওতায় আরও তিনটি লক্ষ্য-শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান চিহ্নিত হয়। ১৯৮৫ সালে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে তৃতীয় বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং নারী উন্নয়নের জন্য সমতা, উন্নয়ন ও শান্তির ভিত্তিতে অগ্রমুখী কৌশল গৃহীত হয়। চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের প্রস্তুতি পর্বে ১৯৯৪ সালে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নারী উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রীপর্যায়ের সম্মেলনে জাকার্তা ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়। এ ঘোষণায় বলা হয় ক্ষমতা বণ্টন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে তীব্র অসমতা বিদ্যমান। এই অসমতা ও সীমাবদ্ধতা নিরসনের উদ্দেশ্যে সরকারগুলোকে উদ্যোগ নিতে তাগিদ দেয়া হয়। কমনওয়েলথ ১৯৯৫ সালে জেন্ডার ও উন্নয়ন কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। সার্ক দেশগুলোও নারী উন্নয়নের জন্য কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ১৯৯৫ সালের ৪-১৫ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ের চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়। বেইজিং কর্মপরিকল্পনায় নারী উন্নয়নে ১২টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে। ক্ষেত্রগুলো হলো- নারীর ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য; শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অসম সুযোগ; স্বাস্থ্যসেবার অসম সুযোগ; নারী নির্যাতন; সশস্ত্র সংঘর্ষের শিকার নারী; অর্থনৈতিক সম্পদে নারীর সীমিত অধিকার; সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ক্ষমতায় অংশগ্রহণে অসমতা; নারী উন্নয়নে অপর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো; নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন; গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক প্রতিফলন এবং অপ্রতুল অংশগ্রহণ; পরিবেশ সংরক্ষণে ও প্রাকৃতিক সম্পদে নারীর সীমিত অধিকার এবং কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য। সব আন্তর্জাতিক ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। ১৯৯২ সালে রিও-ডি-জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে গৃহীত পরিবেশ ও উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা, ১৯৯৩ সালে ভিয়েতনাম মানবাধিকার ঘোষণা, ১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত জনসংখ্যা ও উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা এবং ১৯৯৫ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সামাজিক শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত কর্মপরিকল্পনায় নারী ও শিশু উন্নয়ন ও তাদের অধিকারের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়। এ সব সনদ ও কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর এবং এগুলোর বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৯ সালে গৃহীত শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকৃত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকে কলেস্নাল যুগ পর্যন্ত নারীকেন্দ্রিক যত রচনাই হয়েছে, তার উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোকদের নারীর অপাঙ্‌ক্তেয় অবস্থা সম্পর্কে সংবেদনশীল করে তোলা। এর পেছনে গূঢ় উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল সমাজ সংস্কার। ফলে এসব লেখায় স্থান পেয়েছে উচ্চ ও কমপক্ষে মধ্যবিত্ত সমাজের মহিলারা এবং তাদের জীবন বৃত্তান্ত। অনেক লেখকই জোর দিয়েছেন পুরুষ শাসনের ফলে নারীর মানসিক নির্যাতন ও ক্ষয়ের ওপর। ষাট দশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে এই হাওয়াই বয়েছে। এর মধ্যে এক বিশেষ ব্যতিক্রম বাঙালি শিক্ষাব্রতী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বেগম রোকেয়ার ১৯০৫ সালে লেখা চটী উপন্যাস সুলতানাস ড্রিম আজ ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম ফেমিনিস্ট ইউটোপিয়ান উপন্যাস হিসেবে আদৃত। বাংলায় লেখা নয় বলে সুলতানাস ড্রিম দেশি সাহিত্যে স্থান পায়নি। কিন্তু এক বাঙালি বৌয়ের লেখা বইটি নারীবাদের যে কোনো মাপকাঠিতেই শীর্ষস্থান পাওয়ার যোগ্য। এতে নারী-পুরুষের কর্ম আর ধর্ম পাল্টাপাল্টি করে রোকেয়া চলতি সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে গড়েছেন, কারোর সহানুভূতির অপেক্ষায় বসে থাকেননি। নারীর পূর্ণ মুক্তির জন্য যে এক নতুন জগতের প্রয়োজন তা বেগম রোকেয়া এক কল্পরাজ্য সৃষ্টি করে দেখিয়েছেন। বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে তিনি সত্যিই এক বিশিষ্ট অগ্রদূত। ষাটের দশক পেরিয়ে সত্তরে পৌঁছে নারীকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যে এক লক্ষণীয় পরিবর্তন এলো। সত্তরের দশকের পরে নারীবাদী লেখা এবং ধ্যান-ধারণা বাংলা সাহিত্যে অনেক বেশি মাথাচাড়া দিয়েছে। তসলিমা নাসরীনের রচনা পুরোপুরিই নারীবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। নির্বাচিত কলাম এবং তার অন্যান্য লেখায় তসলিমা তীব্র স্বরে সমাজে নারী অবহেলার কৈফিয়ত চেয়েছেন, নারীবাদের জয়গান গেয়েছেন। এ ছাড়া বেগম সুফিয়া কামাল, রাবেয়া খাতুন, দেবারতি মিত্র, মলিস্নকা সেনগুপ্ত, জয়া মিত্র, এমন অনেকেই এখন তাদের লেখায় নারীবাদ আনছেন। সবাই যে আজকের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে লিখছেন তাও নয়। যেমন মলিস্নকা সেনগুপ্ত তার উপন্যাস সীতায়নে মহাকাব্য রামায়ণকে নতুন আলোকে উপস্থিত করেছেন। এখানে রামায়ণের মুখ্য চরিত্র রাম নয়, সীতা। এক মাতৃতান্ত্রিক সাম্যসমাজকে অগ্রাসী আর্য রাষ্ট্রতন্ত্র কেমন করে পুরুষশাসনের কব্জায় নিয়ে এলো তারই গল্প সীতায়ন। এত সব নারীবাদী রচনা থাকা সত্ত্বেও মনে হয় আজকের বাংলা সাহিত্যে শ্রেণি সচেতনতা লিঙ্গ সচেতনতার চেয়ে অনেক বেশি প্রখর। শ্রেণি বৈষম্য নাকচ করতে সাহিত্যিকরা যত সহজে সমাজ ভাঙার ডাক দেন, নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার বেলায় তার তুলনীয় আগ্রহ যেন দেখতে পাই না। তার মানে এই নয় যে নারীবাদী সাহিত্য গড়ে তুলতে হলে সবার একমত হতে হবে বা একটি সরল সার্বজনীন দৃষ্টিকোণ তৈরি করতে হবে। কিন্তু শ্রেণি সংঘর্ষের সঙ্গে লিঙ্গ প্রভেদের সংগ্রাম পাশাপাশি না চালালে সত্যিকারের নারী মুক্তির সম্ভাবনা অল্প। প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টি অনেক বেশি জটিল, কষ্টকর। প্রথমটি বাইরের লড়াই, অন্যটি গৃহযুদ্ধ। আজকের সমাজের প্রবহমান ঘটনাবলির ছায়া তাদের লেখায় খুব কমই প্রতিফলিত হতে দেখি। দেশে বধূহত্যার ধূম, মহিলা সমাজকর্মীদের গণধর্ষণ, ধর্মের নামে মেয়েদের আরও অধিকার বিচু্যতি, অভিবাসী পুরুষের দেশে ফিরে সম্বন্ধ করে বিয়ে এবং স্ত্রী ফেলে পালানো, পরিবারের মধ্যে শিশুকন্যা এবং অন্য মেয়েদের ওপর যৌন অত্যাচার, রাজনৈতিক দলগুলো থেকে মহিলাকর্মী বিতাড়ন, এ সব ঘটনা কারোর লেখাতেই খোলাখুলিভাবে আজও পাইনি। তাই মনে হয় বাংলার অনেক সাহিত্যিকই নারীবাদ নিয়ে লিখছেন বটে, কিন্তু তারা এখনো নারীবাদী হয়ে উঠতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ২০২১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়ন এবং সার্বিক উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্তকরণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী দারিদ্র্য বিমোচন, নারী নির্যাতন বন্ধ, নারী পাচার রোধ, কর্মক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা বিধান এবং আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডে নারীর পূর্ণ ও সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। হতদরিদ্র নারীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের ভাতা প্রদান কর্মসূচি, শহরাঞ্চলে কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বিত্তহীন মহিলাদের খাদ্য নিরাপত্তাসংক্রান্ত ভিজিডি কর্মসূচি, দারিদ্র্য বিমোচন ঋণ প্রদান কর্মসূচি। নারীদের কৃষি, সেলাই, বস্নক-বাটিক, হস্তশিল্প, বিউটিফিকেশন, কম্পিউটার ও বিভিন্ন আয়বর্ধক বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শ্রমবাজারে ব্যাপক অংশগ্রহণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ও বিনা জামানতে ঋণ সহায়তা প্রদান ও পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যদিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বায়নের এই যুগে নারীকে সামষ্টিক অর্থনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র ঘধঃরড়হধষ ঝঃৎধঃবমু ঋড়ৎ অপপবষবৎধঃবফ চড়াবৎঃু জবফঁপঃরড়হ (ঘঝঅচজ ওও)-তে বিভিন্ন কার্যক্রম সন্নিবেশিত হয়েছে। এই কৌশলপত্রে দারিদ্র্য নির্মূলের লক্ষ্যে পাঁচটি কৌশল বস্নক চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে দারিদ্র্যবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন অন্যতম। যে পাঁচটি সহায়ক কৌশল গৃহীত হয়েছে তন্মধ্যে উন্নয়ন কর্মকান্ডের সব জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণমূলক ক্ষমতায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নারী দারিদ্র্য দূরীকরণে গৃহীত বিশেষ কার্যক্রমের মধ্যে এই কৌশলপত্রে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বলয়ের প্রসারের মধ্যদিয়ে হতদরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। ১৯৯৮ সালে শুরু হয় বিধবা ও দুস্থ্‌ নারীদের ভাতা প্রদান কার্যক্রম। বর্তমানে দেশে ৯,২০,০০০ নারী এই কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। প্রতি মাসে একজন বিধবা নারী ৩০০ টাকা হারে ভাতা পেয়ে থাকেন। সেই সঙ্গে রয়েছে মাতৃত্বকালীন ভাতা। মোট ৮৮,০০০ দারিদ্র্য মা এই কর্মসূচির আওতায় প্রতি মাসে ৩৫০ টাকা ভাতাপ্রাপ্ত হন। এ ছাড়া বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রম চলমান যা থেকে নারীরা উপকৃত হন। বিত্তহীন নারীর দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির (ভিজিডি) আওতায় খাদ্য নিরাপত্তারূপে ৭,৫০,০০০ দরিদ্র নারীকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল বা ২৫ কেজি পুষ্টি আটা বিতরণ করা হয়। কৌশলপত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান বিশেষত আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, কৃষি, কম্পিউটার ইত্যাদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীকে আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সহজ শর্তে স্বল্প হারে ঋণ প্রদান, বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ, আর্থিক সহায়তা প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষত টেক্সটাইল, হস্তশিল্প, বয়নশিল্পের বিকাশে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ঐড়সব ইধংবফ গরপৎড় ঊহঃবৎঢ়ৎরংব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শ্রম বাজারে নারীর প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। জঁৎধষ ঘড়হ ঋধৎস অপঃরারঃরবং-এর ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করার মধ্যদিয়ে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদরূপে গড়ে তোলার বিষয় কৌশলপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেকালে নারীরা কোনো ধরনের শিক্ষা পাননি; খুব পরিকল্পিতভাবেই তাদের ধর্মগ্রন্থ এবং অন্যান্য জ্ঞানার্জন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। নারীর সবরকম মানবিক ও সামাজিক অধিকারকে অস্বীকার করে পুরুষদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল ভোগের জন্য আর সন্তান উৎপাদনের জন্য; তবে সে সন্তান হতে হবে ছেলে। মেয়ে জন্মের পরই মাথায় ঢুকানো হতো 'জন্মান্তরবাদ' ও 'কর্মবাদ'-এর তত্ত্ব। মনুর মতো শাস্ত্রকাররা নারীদের বুঝাতেন, নারীর জন্ম হলো আজন্ম পাপের ফল...! মনুসংহিতাসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে বোঝা যায়, ব্রাহ্মণপুরুষ কর্তৃক রচিত ওগুলো একেকটা 'পুরুষসংহিতা'; নারীদের (যে বর্ণের হোক) জন্য নয় ওগুলো। নারী যদি মুক্তি চায়, প্রগতির দিকে হাঁটতে চায়, নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে চায় পূর্ণরূপে, তবে অবশ্যই-অবশ্যই তাদের 'ধর্মকারায়' বজ্র হেনে বেড়িয়ে আসতে হবে। ধর্মগ্রন্থের যতই সাহিত্যিকমূল্য কিংবা দার্শনিক তত্ত্ব লুকানো থাকুক না কেন, নারীকে এর ভার বহন করার প্রয়োজন নেই। নারীর এতে কোনো ক্ষতি হবে না, কোনো অংশ খসে পড়বে না। বরং আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা, যুক্তিবাদ আর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবই পারে নারীর সার্থক মুক্তি ঘটাতে; এতেই নারীর ব্যক্তিত্বের পূর্ণ মর্যাদা বিকশিত হবে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই কথা সুস্পষ্ট যে মনু স্মৃতিতে নারীকে যে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে তা পৃথিবীর অন্য যে কোনো গ্রন্থে (অবশ্যই বেদ বাদে কারণ মনুর এই ধারণার উৎসই হলো বেদ) তা অনুপস্থিত। এমনকি তার কাছাকাছিও নেই। আশা করি মনু স্মৃতিকে নিয়ে যে নারীবিদ্বেষী অপবাদ আছে তা এখন থেকে অনেকের মন থেকে ঘুচে যাবে চিরতরে। পাশাপাশি আমরা আশা করব- আমাদের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, বান্ধবীদের যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা করে মাতৃশক্তির মহিমা নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে সমাজে মঙ্গল বয়ে আসবে এবং নারী সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, নারী সম্মান, মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আধুনিক কল্যাণমুখী ও কার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক