পদক, পুরস্কার বিতর্ক

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বিয়োগ বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তর করে দেশ পুনর্গঠনে নিত্যনতুন পরিকল্পনা করছেন। সফল হয়েছেন তিনি। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধীরাসহ মতলববাজরা তার ইমেজকে নষ্ট করার নানা ফন্দিফিকির ও অপতৎপরতায় লিপ্ত। জনগণের অর্থে ব্যয়িত পুরস্কার, সম্মাননা যদি ভুল মানুষ পায় তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের।

প্রকাশ | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সাইফুজ্জামান
লেখালেখি, সেবা বা সমাজকল্যাণ কাজ, সংগীত পরিবেশন একজন মানুষ শুরু করে নিতান্ত ভালোবেসে। প্রাপ্তির আশায় কেউ কিছু করে না। যদি ভাগ্যে জুটে যায় পদক কিংবা পুরস্কার কথাই নেই। অর্থ জোটে, সোনা বা রুপার ক্রেস্ট, সম্মাননা প্রাপ্তির পাশাপাশি যে ব্যক্তি আলোচনা, সমালোচনার পাদপ্রদীপে এসে যায়। প্রকৃত লেখকের আত্মতৃপ্তি নেই। সেরা লেখার জন্য প্রস্তুতি, পড়াশোনা, নিবেদন প্রয়োজন। আমাদের দেশে খুব অল্পতেই পদক, পুরস্কার মেলে। কেউ পুরস্কার দেয়, কেউবা পুরস্কার নেয়। অর্থের বিনিময়ে সবই ঘটে। সবক্ষেত্রে ঘটে তা নয়। তদবির, রাজনৈতিক যোগাযোগতো আছেই। এসব কারণে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। সম্মাননা, পুরস্কার নিয়ে নানা কথাবার্তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক পুরস্কারগুলোতে পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা যারা করছে তারাই নিয়ন্ত্রিত করে। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার প্রত্যাশীদের বন্ধুবান্ধব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে পুরস্কারদাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিবৃতি দেয়। ফলও হয়। পুরস্কার জুটে যায়। পুরস্কার প্রত্যাশীরা কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন কর্তাব্যক্তিদের মনোযোগ কেড়ে বড় পুরস্কার পায়, এ তথ্য নতুন নয়। পদকবাণিজ্য বলে কথাটি শোনা যায়। কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পদকবাণিজ্য করে। পদক, সম্মাননা লিপ্সুদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করে। পদকবাণিজ্য ব্যবসা রমরমা এখন। অনেক ব্যক্তি এ ব্যবসা করে বহাল তবিয়তে দেদারসে তাদের উপার্জন করছে। এসব লোক খুব সহজে কিছু ব্যক্তিকে টার্গেট করে। টাকার বিনিময়ে জুটে যায় বিভিন্ন ব্যক্তির নামে গড়ে ওঠা পুরস্কার। এ তালিকায় খ্যাতিমান দুয়েকজনের নাম থাকে। পদক পেতে গেলে নির্দিষ্ট অংকের টাকা ছাড় দিতে হয়। ক্রেস্ট খরচ ও অনুষ্ঠান আয়োজনের যাবতীয় ব্যয় মেটানো হয় পদক, সম্মাননা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ থেকে। পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্র রয়েছে অনেক। চিকিৎসা, শিক্ষা, সমাজসেবা, সংস্কৃতি প্রভৃতি। জাতীয়, আন্তর্জাতিক স্মরণীয় ব্যক্তিদের পাশাপাশি মহান একুশে, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসেও পুরস্কার দেয়া হয়। প্যাডসর্বস্ব সংগঠন পদক ও পুরস্কার বিতরণ দিবসের আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠানে দাতা ও গ্রহীতারা ছাড়া তেমন উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক দর্শক উপস্থিত থাকে না। রাজধানী ঢাকার বাইরে থেকে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা থেকে আসে জনগণের সেবক চেয়ারম্যান, মেম্বার, ডাক্তার, প্রকৌশলী ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা। মুদি দোকানের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রাঘবোয়াল কেউ বাদ পড়ে না মনোনীত পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায়। বিভিন্ন ব্যক্তিদের অফিস কক্ষে পুরস্কারের ক্রেস্ট, সম্মাননা, সার্টিফিকেট শোভা পায়। বিভিন্ন খ্যাতিমানদের নামে গড়ে ওঠা সংগঠনে অসৎ ব্যক্তি পদক, পুরস্কার দিয়ে ব্যবসা করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সংগঠনটির নিবন্ধন নেই। সমাজসেবা সংক্রান্ত সরকারি অফিস থেকে অনুমতি ব্যতিরেকে কাজ করা কতটুকু সিদ্ধ? আমাদের জাতীয় পর্যায়ে ঘোষিত কোনো কোনো পুরস্কার বিতর্কের সৃষ্টি যে করছে না তা নয়। একুশে ও স্বাধীনতা পুরস্কারে কিছু ব্যক্তির নাম ঘোষিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল ঝড় উঠেছে। একুশে পদকে একজন কবির স্ত্রী যিনি একটিমাত্র পুস্তক অনুবাদ করে মনোনীত হয়েছেন বলে জানা যায়। অন্যটি স্বাধীনতা পুরস্কারে একজন সাবেক আমলার নাম মনোনয়নের খবর নিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা, সমালোচনা তুঙ্গে। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর ও শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তার ফেসবুকের ওয়ালে এ বিষয়ে বক্তব্য পোস্ট রয়েছে। একুশে পদক বিতরণ সম্পর্কে তিনি ৭ আগস্ট লেখেন 'এবার একুশে পদক বড়ই হতাশাব্যঞ্জক হয়েছে। যারা এ পুরস্কার কমিটিতে ছিলেন তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। তিন চারটি ছাড়া অন্যগুলো হাস্যকর। কে সাহিত্যিক, কে মুক্তিযোদ্ধা, কে একেবারেই এ পুরস্কার পেতে পারেন না, সে সম্পর্কে বিচারক ও বাছাইকারীদের অজ্ঞতা পর্বতপ্রমাণ। এতে সরকারের বদনাম হয়। সরকারকে এ বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।' স্বাধীনতা পুরস্কার ঘোষণার পর শামসুজ্জামান খান লিখলেন "এবার সাহিত্যে পুরস্কার পেলেন রইজউদ্দীন, ইনি কে চিনি নাতো। নিতাই দাসই বা কে। হায়! স্বাধীনতা পুরস্কার।" কালীপদ দাস লিখতে গিয়ে তিনি নিতাই দাস লিখেছেন। জাতীয় পর্যায়ে ঘোষিত পুরস্কার যদি ভুল ব্যক্তি পায় তার জন্য দুঃখের শেষ নেই। আমাদের রাজনীতি, ব্যক্তিবন্দনা ও ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি করছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা বিভিন্ন সময় পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে। স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের গৌরবের অহংকারকে কলঙ্কিত করছে। স্বজনপ্রীতি, অর্থলিপ্সুতা থেকে জন্ম নেয় অযোগ্যদের লালন-পালনের কর্ম সম্পন্ন করার রিপু। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বিয়োগ বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তর করে দেশ পুনর্গঠনে নিত্যনতুন পরিকল্পনা করছেন। সফল হয়েছেন তিনি। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধীরাসহ মতলববাজরা তার ইমেজকে নষ্ট করার নানা ফন্দিফিকির ও অপতৎপরতায় লিপ্ত। জনগণের অর্থে ব্যয়িত পুরস্কার, সম্মাননা যদি ভুল মানুষ পায় তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের। মোক্ষম সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুরস্কার, সম্মাননা প্রত্যাহার করে যোগ্য ব্যক্তিদের সম্মানীত করার মধ্যে নিঃসন্দেহে মহত্ব লুকিয়ে আছে। জাতি গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পরের পদক্ষেপগুলো দেখার জন্য। নীরবে নিভৃতে অনেক মানুষ আছেন কাজ করে যাচ্ছেন, কিন্তু তাদের স্বীকৃতি মেলেনি। তাদের স্বীকৃতি দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দ্বন্দ্ব, বিশ্বাস, অবিশ্বাস ও আনুগত্যের ভিত্তিতে কোনো পুরস্কার প্রাপ্তির যোগ্যতা হওয়া কাম্য নয়। ভুঁইফোঁড় সংগঠন ও ব্যক্তি যাতে অযোগ্য ব্যক্তিকে পদক দিয়ে পদক ও সম্মাননার মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ভুয়াদের নির্মূল করা জরুরি। যার যেখানে স্থান তাকে সেখানেই স্থান দিতে হবে। শিক্ষায় যার পাওয়ার কথা সে যদি চিকিৎসায় পদক পায় তা যেমন লজ্জার, ক্রীড়াবিদ যেন চিকিৎসায় পুরস্কার না পায় সেদিকেও নজরে রাখতে হবে। শহিদের রক্তস্নাত বাংলায় যোগ্যদের স্বীকৃতি ও প্রতিভাধরদের শুশ্রূষা ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা করলে হবে সঠিক কাজ করা। বিচ্ছিন্নতা, হিংসা, হানাহানি অনেক হয়েছে। ফিরতে হবে আপন আয়নায়। সাইফুজ্জামান: প্রাবন্ধিক, গবেষক ংধরভুুঁধসধহ.নহস@মসধরষ.পড়স