টেকসই উন্নয়নে পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই

বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে রূপান্তর করতে এবং পরিবেশ রক্ষায় টেকসই পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।

প্রকাশ | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মাহমুদ কামাল
জীবনকে সহজ করতে প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ অনেক কিছুই ব্যবহার করে চলেছে। নিঃন্দেহে পস্নাস্টিকের মধ্যে অন্যতম। পস্নাস্টিকের ব্যবহারের সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে পস্নাস্টিক বর্জ্য। টেকসই উন্নয়নে পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ উপায়। তা ছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কারণ পস্নাস্টিক অপচনশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। বাংলাদেশে পস্নাস্টিকের মাথাপিছু ব্যবহার মাত্র পাঁচ কেজি যেখানে বিশ্বে গড় পস্নাস্টিকের ব্যবহার প্রায় বিশ কেজি। এসব পস্নাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে বোতল, চালের বস্তা এবং পস্নাস্টিক ব্যাগ। অন্যসব উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের পস্নাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠালে, সমাধান হবে পরিবেশগত মারাত্মক প্রভাব যা মানবজীবন ও বিভিন্ন প্রাণীর জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত এই পস্নাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টির হার বৃদ্ধি। এজন্য দেশের শহরগুলোতে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে এবং কত ধরনের বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে তার সঠিক ও বিস্তারিত গবেষণা তথ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা জরুরি। সেই সঙ্গে আর্থিক ও ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা ঘাটতি থাকায় শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করাও সহজ হয়ে উঠছে তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে টেকসই উন্নয়নে পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া পস্নাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যগুলো পানির সঙ্গে মিশে এর গুণাগুণ নষ্টের সঙ্গে সঙ্গে পানিতে থাকা জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নদী ও সাগরে পস্নাস্টিক ও পলিথিনের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বর্তমান সময়ে সমুদ্রের সম্পদ নিয়ে যে বিস্তর গবেষণা চলছে, পস্নাস্টিক বর্জ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে। ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন বর্জ্য পস্নাস্টিক সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় এবং যা প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সমুদ্রে যে হারে পস্নাস্টিক বাড়ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রবাল প্রাচীরের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সমুদ্র বিজ্ঞানীদের  মতে, সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধির পর দ্বিতীয় বড় হুমকিটি পস্নাস্টিক বর্জ্য যা প্রবাল প্রাচীরের রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২০ গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে পস্নাস্টিক অন্যতম। মাটির স্তরে স্তরে পস্নাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য বৃদ্ধির ফলে ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলো সঠিকভাবে পরিপূর্ণ হচ্ছে না। অন্যদিকে পানির চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, পস্নাস্টিক বর্জ্যের এ ধরনের ব্যবস্থাপনা ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।  উৎপাদিত বর্জ্যগুলো শেষ পর্যন্ত সংগ্রহ, পরিবহণ ও অপসারণের পর জায়গা হয় ল্যান্ডফিল সাইটে (খধহফভরষষ ংরঃব)। স্তূপাকারে জমা করা বর্জ্যের জন্য যে জায়গা ব্যবহার করা হয় তার ধারণক্ষমতা দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ল্যান্ডফিল করার জন্য অবশ্যই কিছু নিয়ম মানা জরুরি। এনভায়রমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) এ বিষয়ে বেশকিছু নীতিমালা উলেস্নখ করেছে। ১৯৯১ সালের এই নীতিমালা অনুযায়ী ল্যান্ডফিল সাইটের ৩০ মিটারের মধ্যে কোনো জলাশয় থাকবে না, ১৬০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো খাবার পানির নলকূপ থাকতে পারবে না এবং ৬৫ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো ঘরবাড়ি, স্কুল বা পার্ক থাকতে পারবে না। তাই ল্যান্ডফিলিংটি অত্যন্ত অপব্যয়ী হিসাবে বিবেচিত হয় কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে জায়গা প্রয়োজন হয় এবং রাসায়নিক উপাদান এবং পস্নাস্টিকের মধ্যে থাকা শক্তি নষ্ট হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও উন্নয়নশীল কাঠামো গড়ে ওঠায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ল্যান্ডফিল সাইটের জায়গা বৃদ্ধি করা সহজ নয়। যে সব স্থানে পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ল্যান্ডফিল তৈরি করা হয়, পরে এর ফলে ভূমি জমিগুলো ভালোভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না এবং সেখানে পস্নাস্টিকের বর্জ্যগুলো সহজেই জলপথে বয়ে যেতে পারে বা বন্যার পানিতে সমুদ্রের দিকে নিয়ে যেতে পারে। পস্নাস্টিক বর্জ্যের বেশির ভাগই যেহেতু মাটিতে থেকে যাচ্ছে, তাই এগুলো মাটি ও পানির গুণগত মান নষ্ট করছে। তা ছাড়া পস্নাস্টিকগুলো ল্যান্ডফিলে ক্ষয় হয়ে গেলে তারা মাটি এবং আশপাশের পরিবেশে দূষণকারী (ফ্যাথলেট এবং বিসফেনল) পদার্থ মুক্ত করতে পারে। পস্নাস্টিক সাধারণত পেট্রোলিয়াম বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উদ্ভূত হয়, এই পস্নাস্টিক বর্জ্যে যে পরিমাণে সঞ্চিত শক্তি রয়েছে তা অন্য কোনো বর্জ্যের তুলনায় বেশি পরিমাণে সঞ্চিত শক্তি দেয়। পস্নাস্টিকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে কিছু শক্তি ফিরে আসে। প্রকৃতপক্ষে, এক পাউন্ড পস্নাস্টিক থেকে যে পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যায় তা প্রায় ইয়মিং কয়লা এবং জ্বালানি তেল থেকে উৎপাদিত শক্তির সমান। তাই পস্নাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরি, উলেস্নখযোগ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি। কিন্তু পস্নাস্টিক জ্বালানি প্রক্রিয়াতে বায়ুমন্ডলে বিপজ্জনক পদার্থগুলো নির্গত হতে পারে যার ফলে পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করবে। উদাহরণস্বরূপ, পিভিসি এবং হ্যালোজেনেটেড অ্যাডিটিভ পস্নাস্টিক বর্জ্যের সঙ্গে বিপজ্জনক পদার্থগুলো মিশ্রিত থাকে এবং তাদের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে পরিবেশে ডাইঅক্সিন এবং পলিক্লোরিনেটেড-বাইফেনিয়াল মুক্ত করে দেয়। তাই পস্নাস্টিক বর্জ্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার আগে ভালোভাবে বাছাই করা জরুরি এবং বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। পস্নাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরি করে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদু্যৎ উৎপাদন করা যায়। যদি এই প্রকল্পটি সারা দেশের পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতে করা হয় তাহলে বর্জ্য অনেকাংশে কমে যাবে। এর ফলে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বিদু্যৎ ও গ্যাস উৎপাদন করে দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এ ছাড়া পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বর্জ্যের কিছু অংশ পুড়িয়ে ফেলা যেতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্জ্য পুড়িয়ে প্রায় ৯০ শতাংশ বর্জ্য কমিয়ে ফেলা সম্ভব। কিন্তু এই প্রক্রিয়া অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে হতে হবে। অনেক পস্নাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা যায় এবং উদ্ধার করা উপকরণগুলোকে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তবে পস্নাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অসুবিধার কারণে এই পদ্ধতিটি পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেই সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়ে পস্নাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করায় অনেক বর্জ্য কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬৩৩,১২৯ টন পস্নাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, এর ৫১ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে যার পরিমাণ ৩২৩,০০০ টন। বাংলাদেশে প্রায় দুই হাজার শিল্প-কারখানা রয়েছে, যার মধ্যে ৫০-৬০টি সরাসরি পস্নাস্টিক টুকরা বিদেশে রপ্তানি করছে। তা ছাড়া পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে বিভিন্ন ধরনের খেলনা তৈরি করা হচ্ছে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিক পণ্যের ওপর ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ছাড়ের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা যেতে পারে যা পস্নাস্টিক রিসাইকেল শিল্পে বিনিয়োগ করার জন্য ভূমিকা রাখবে। পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বায়োডিগ্রেডেবল পস্নাস্টিক অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে, এটি এমন পস্নাস্টিক যা জীবের ক্রিয়া দ্বারা পচে যায়। বিশেষত যে সব প্যাকেজিং জৈব বর্জ্য থেকে সহজে পৃথক করা যায় না, সেখনে বায়োডিগ্রেডেবল পস্নাস্টিক ব্যবহার করে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা রয়েছে। বায়োডিগ্রেডেবল পস্নাস্টিকগুলো জীব দ্বারা কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং জলের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপাক হতে পারে, কিন্তু অক্সো-বায়োডিগ্রেডেবল পস্নাস্টিকগুলো পরিবেশে ধাতু ছেড়ে দিতে পারে। পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যে বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে জৈব ও অজৈব বর্জ্য আলাদা করে সংরক্ষণ অন্যতম। প্রাথমিক স্তর থেকে বর্জ্য আলাদা করা নিয়ে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পস্নাস্টিক বর্জ্য প্রতিরোধ করতে সরকারের সঙ্গে প্রত্যেক স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। সেই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে পস্নাস্টিক বর্জ্যগুলো সম্পদে রূপান্তর করার প্রকল্প হাতে নিতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশে এখনো পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তেমন কোনো আইন নেই। তাই দেশের পরিবেশ রক্ষায় পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অবশ্যই আইন প্রণয়ন করে তা দ্রম্নত বাস্তবায়ন করা দরকার। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সঠিক নিয়মে বর্জ্য সংগ্রহের হার বৃদ্ধি, উপযোগী ও উন্নত বর্জ্য পরিবহণ পদ্ধতি এবং জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি না হয় এমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি কাজে লাগানো। এ ছাড়া দেশের পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যকর ও টেকসই করতে পারলে তা অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে; সেই সঙ্গে আমরা পাব একটি পরিচ্ছন্ন দেশ। টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রধান সুবিধা হলো পরিবেশের ওপর প্রভাব কমিয়ে, বায়ু এবং পানির গুণগতমানের উন্নতি করে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে অবদান রাখে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে রূপান্তর করতে এবং পরিবেশ রক্ষায় টেকসই পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। মাহমুদ কামাল: কলাম লেখক