কুলদীপ নায়ারের প্রয়াণ

মতপ্রকাশে ছিলেন স্পষ্টভাষী নিভীর্ক

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
চলে গেলেন এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কমীর্ কুলদীপ নায়ার। স্থানীয় সময় বুধবার রাত সাড়ে ১২টায় দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার জীবনাবসান ঘটে। তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে গেছেন। বৃহস্পতিবার বিকালে লধি শ্মশান ঘাটে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছে। কুলদীপ নায়ার ১৯২৩ সালের ১৪ আগস্ট অবিভক্ত পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লাহোরে বেড়ে ওঠেন এবং সেখানেই পড়াশোনা করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি লাহোর ছেড়ে দিল্লিতে চলে আসেন। কুলদীপ নায়ার ১৯৪৮ সালে উদুর্ পত্রিকা ‘দৈনিক আনজাম’-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে তিনি ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। সংবাদ সংস্থা ‘ইউএনআই’র শীষর্পদেও তিনি দীঘির্দন কমর্রত ছিলেন। মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত ধমীর্য় উগ্রবাদের পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতায় সরব ও সোচ্চার ছিলেন তিনি। তিনি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও আলোচিত ছিলেন তার বস্তুনিষ্ঠ নিমোর্হ রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জন্য। সদা সত্য প্রকাশের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সবর্মহলে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ইন্দিরা গান্ধী যখন জরুরি অবস্থা জারি করেন, তখন তিনি তার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এ জন্য তাকে জেলেও যেতে হয়েছিল। এই উপমহাদেশের শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার দাবিতে তার লেখনী সব সময় প্রেরণা জুগিয়েছে। তার বিভিন্ন লেখায় দেশভাগের যন্ত্রণা আর বিশ্বাসভঙ্গের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ভারত সরকার ১৯৯০ সালে যুক্তরাজ্যে তাকে হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করে। তিনি ১৯৯৭ সালে রাজ্যসভার সদস্য নিবাির্চত হন। গণতন্ত্র ও মানবতার উজ্জ্বল প্রতীক কুলদীপ নায়ার তার দীঘর্ অভিজ্ঞতা থেকে লিখে গেছেন ১৫টি গ্রন্থ। তার আত্মজীবনী ‘বেয়ন্ড দ্য লাইনসে’ ব্যক্তি কুলদীপ নায়ারের বেড়ে ওঠার গল্পের সঙ্গে প্রতিভাত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক নানা বঁাক বদলের কথা। এ ছাড়াও ‘ইনডিয়া আফটার নেহরু’ ও ‘ইমারজেন্সি রিটোল্ড’সহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ও পাঠকপ্রিয় বইয়ের লেখক তিনি। বাংলাদেশের পাঠকের কাছেও তিনি বিপুল জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যুতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বহু মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন। এ কথা বিদিত সত্য, সংবাদপত্র, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা বিষয়ে এই উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষেরই স্বচ্ছ ধারণা নয়। সাংবাদিকতা কোনো পেশা নয়, চুক্তিভিত্তিক কোনো বাড়তি খÐকালীন কাজÑ যার বিনিময়ে কেবল সামান্য কিছু সম্মানী জোটে, আর সাংবাদিক মানেই ধান্ধাবাজ, প্রতারক, বø্যাকমেইলার ও ভীতিকর কোনো প্রাণীÑ এমন ধারণাও পোষণ করেন অনেকেই। এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী এই উপমহাদেশের আথর্-সামাজিক পরিস্থিতি এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি। এমন প্রতিক‚ল পরিবেশে তিনি সাংবাদিকতা এবং তার লেখাকে আপসহীনতা ও সত্যভাষণের মাধমে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বরাবরই স্পষ্টভাষী ও নিভীর্ক । যদিও তিনি তার নীতি আদশের্র জন্য যেমন সমালোচিত হয়েছেন, আবার পাঠকমহলে বিপুলভাবে সমাদৃতও হয়েছেন। তিনি সব সময়ে মানবতা ও মানুষের কল্যাণে কলম ধরেছেন। এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প যখন তুঙ্গে তখন তিনি মানবতাকে সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি সব সময়ে ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে প্রভাব-সঞ্চারী ব্যক্তিত্ব। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তানের যে রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব-সংঘাত, তিনি সব সময়ে ছিলেন তার বিপক্ষে। একজন সাংবাদিক ও মানবতাবাদী হিসেবে তিনি সব সময়ে ছিলেন রাজনৈতিক সমঝোতা উদারতা ও শিষ্ঠাচারের পক্ষে। তিনি একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার হিসেবে ছিলেন অদ্বিতীয়। তার ধ্যান, জ্ঞান সাধনাই ছিল নিযাির্তত ও শোষিতের পক্ষে। তিনি ছিলেন সাংবাদিক সমাজের আদশর্। এই উপমহাদেশ একজন প্রাজ্ঞ দূরদশীর্ বিচক্ষণ কিংবদন্তি সাংবাদিককে হারালো। তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।