বসবাসের অযোগ্য ঢাকা

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

সাধন সরকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
প্রতি বছরের মতো এ বছরও যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)’ ‘বৈশ্বিক বসবাসযোগ্যতা শীষর্ক জরিপ’ প্রকাশ করেছে। যথারীতি এ তালিকায় ঢাকার স্থান শেষতম থেকে এক ধাপ উপরে অথার্ৎ ১৩৯তম (১৪০টি শহরের মধ্যে)। ২০১৭ ও ২০১৬ সালেও এ সংস্থার জরিপে বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী তৃতীয় শহর হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল ঢাকা। ২০১২ সাল থেকে চলতি বছর পযর্ন্ত প্রতিবারই বসবাসের অযোগ্য ১০ শহরের তালিকায় শেষের দিকে ছিল ঢাকা। এ বছর সবচেয়ে যোগ্য শহর বিবেচিত হয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। আর সবচেয়ে অযোগ্য শহর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। প্রায় পঁাচ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ-বিধ্বস্তে জজির্রত দামেস্ক শহর বসবাসের অযোগ্য হবে এটাই স্বাভাবিক! কিন্তু তাই বলে এর পরের স্থান হবে রাজধানী ঢাকার! হ্যঁা, ঢাকায় নগরবাসী নীরব জীবনযুদ্ধ করে টিকে আছে! এককথায়, ঢাকা শহর নগরবাসীর জন্য মন্দের ভালো! জরিপে বসবাসযোগ্যতা নিধার্রণে সুপরিসর আঙ্গিকে পঁাচটি মানদÐ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো। দীঘর্ সময় ধরে নানা সংকট-সমস্যা আর আধুনিক সুযোগ-সুবিধাহীন অবস্থায় থাকতে থাকতে মনে হতে পারে এটাই মনে হয় বাসযোগ্য ঢাকা! অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনবহুলতার কারণে ঢাকায় যে কোনো দুযোের্গ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে অবণর্নীয়। তথ্য সূত্রে, ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা নগরও বটে! ঢাকা শহরের মানুষকে প্রতিদিন নানা সমস্যার মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বাতাসে সীসা, খাদ্যে ভেজাল, গ্যাস-পানির সমস্যা বহুদিন ধরে চলে আসছে এ শহরে। উচ্চ খরচে চিকিৎসা সেবা পাওয়া গেলেও তার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় পড়তে হয় নগরবাসীকে। লাখ-লাখ টাকা খরচ করে শহরের রাস্তার ফুটপাতের ড্রেনগুলো প্রতি বছর নতুন করে তৈরি ও খনন করা হচ্ছে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা ও নগরবাসীর সচেতনতার অভাবে তা আবার অকেজো হয়ে পড়ছে। দিনে দিনে ঢাকার আকার বাড়ছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। জলাভূমি ভরাট হয়েছে, খাল দখল ও ভরাট হয়েছে, কোথাও বক্স কালভাটর্ বানানো হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি নামার কোনো পথ নেই। শিক্ষাথীর্ ও কমর্জীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের যানজটে পড়ে নাকাল হতে হচ্ছে। যানজটের কারণে নগরবাসীর প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কমর্ঘণ্টা। যানজটে পড়ে অবিরাম স্নায়ুর পীড়ন নগরবাসীর জীবনে নানা ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ঢাকায় যানবাহনের গতি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০০৪ সালে ঢাকায় যানবহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১কিলোমিটার। এখন তা ৭ কিলোমিটারে এসে দঁাড়িয়েছে। ঢাকা শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থায় এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। গণপরিবহন সংকটে নগরবাসীকে ভুগতে হচ্ছে প্রতিদিন। ঢাকা শহর যেভাবে বেড়েছে সেভাবে রাস্তাঘাট হয়নি। ফুটপাতগুলোও নগরবাসীর চলাচলের জন্য নিরাপদ নয়। মাঠ ও পাকর্গুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, গুম ও হত্যার ঘটনায় নগরবাসী উদ্বিগ্ন। মূলত সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় ঢাকার জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঢাকায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৮০০জন। পৃথিবীর মেগাসিটিগুলোর মধ্যে জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। প্রতি বগির্কলোমিটারে এখানে ৪৫ হাজার মানুষ বাস করে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে সবার আগে ঢাকামুখী মানুষের চাপ কমাতে হবে। এখানে জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে আছে পদে পদে দুনীির্ত, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা। এ ছাড়া সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা সংকটেও নগরবাসীকে ভুগতে হচ্ছে। নগরবাসীকে উন্নতমানের সেবার প্রতিশ্রæতি দিয়ে বিভক্ত করা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সেবার মান কতটুকু বেড়েছে? এত সব সমস্যার দায় সরকার ও দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কতৃর্পক্ষও এড়াতে পারে না। কত-শত প্রতিষ্ঠান ঢাকার উন্নয়নে কাজ করলেও ঢাকাকে দেখার ও ঢাকা নিয়ে ভাবার আসলে কেউ নেই! ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু- এ চারটি নদীই আজ দুবির্ষহ দূষণ ও দখলের শিকার। ঢাকার ৪৭টি খাল দীঘির্দন ধরে দখল হয়ে আছে। ফলে জলাবদ্ধতা ও মশার যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলছে না। ঢাকায় সুউচ্চ অট্টালিকার সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু ঢাকার জীবনযাপন সুগম ও সুন্দর হয়েছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্যই এই শহর নরক যন্ত্রণার সমান। এ নগরীতে পানিদূষণ ও বায়ুদূষণের ফলে নতুন নতুন রোগের প্রাদুভার্ব দেখা দিচ্ছে। অতি মাত্রায় শব্দদূষণ নগরবাসীকে মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। কোনো আধুনিক শহর এভাবে চলতে পারে কি? ঢাকায় বৈষম্যহীন ও ‘সবার জন্য শিক্ষা’ আছে এমনটি পুরোপুরি বলা যাবে না। শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। ঢাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কোচিং সেন্টারের সংখ্যাই বেশি! শুধু ধনীদের কথা চিন্তা করে পরিকল্পনা করলে হবে না, ধনী-নিধর্ন সবার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। পরিস্থিতি আর কত খারাপ হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের টনক নড়বে। ঢাকার পাশর্¦বতীর্ কয়েকটি দেশের সুন্দর রাজধানীর কথা বলা যেতে পারে যেমনÑ কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা দিল্লি। কতৃর্পক্ষের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নগরের অধিবাসীদের ইতিবাচক সহযোগিতায় বসবাসের জন্য এসব শহর নিরাপদ ও আকষর্ণীয় বলে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তাই করা হয়নি। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঢাকার এই করুণ দশা। দক্ষ নেতৃত্বের অভাব আর ব্যবস্থাপনাগত ব্যথর্তার কারণেই কোনো পরিকল্পনাই পুরোপুরি আলোর মুখ দেখেনি। ঢাকা শহরকে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হলে দীঘের্ময়াদি পরিকল্পনা হিসেবে থানা ও জেলা শহরগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে ঢাকামুখী মানুষের চাপ কমাতে হবে। জেলা শহরে চিকিৎসা, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের উদ্যোগ নিয়ে কমর্সংস্থানের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে হবে। সবোর্পরি ঢাকাকে বঁাচাতে দরকার নীতিনিধার্রকদের দূরদশির্তা ও ইতিবাচক কমর্পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সৎ সাহস। ঢাকাকে বঁাচাতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ‘ড্যাপ’ বাস্তবায়নের কথা বহুদিন ধরে আলোচনা হলেও নানা কারণে এর বাস্তবায়ন নিয়ে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। আধুনিক ও বাসযোগ্য ঢাকা গড়তে ‘ড্যাপের’ দ্রæত বাস্তবায়ন কাম্য।