একুশের মাহাত্ম্য ও আবেগ

একুশের মাহাত্ম্য ও আবেগ শুকদেব মজুমদার

প্রকাশ | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

শুকদেব মজুমদার
'আষাঢ় মাস, চাষার আশ'- এমন একটি কথা প্রচলিত আছে, যা প্রায় প্রবচনের পর্যায়ে উন্নীত, যা গ্রামীণ সমাজ বা কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রূপ-ঐতিহ্য তুলে ধরে। ফেব্রম্নয়ারি মাস চলছে, বাঙালির মহান ভাষা আন্দোলন এ মাসেই সংঘটিত হয়েছে। বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির লড়াই আত্মত্যাগের একটি মহান মাইলফলক স্থাপনকারী সে ২১ তারিখটি 'একুশে ফেব্রম্নয়ারি' নামে যা সর্বজনবিদিত, যা বাঙালির চেতনায় শুধু নয়- বিশ্বচেতনায় বিধৃত- ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির মধ্যদিয়ে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে। এখন যদি বলি উলিস্নখিত বচনটির সঙ্গে তালমিলিয়ে- 'ভাষার মাস, বাঙালির আশ'- তাহলে সরলভাবে তা যথার্থই হবে। কিন্তু একটু জটিল বা গভীরভাবে প্রশ্ন হতে পারে, কত শতাংশ বা কী পরিমাণ বাঙালি বা বাংলাদেশের মানুষ ওই আশার সঙ্গে এখন পর্যন্ত একাত্ম হতে পেরেছে, সক্রিয় সৃজনশীল হতে পেরেছে? খোলসা করে বলতে গেলে একুশের আদর্শিক ও নানা দিক থেকে তার বিস্তার সমৃদ্ধি ইত্যাদিগত দিক থেকে? একুশের বিস্তার মানে তো বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির বিস্তার- সৃজনশীলতায়, গবেষণায়, শিল্প ইত্যাদিতে বাঙালি হিসেবে দেশে-বিদেশে বড় বড় অর্জনে অবদানে। একুশের বিস্তার মানে তো হাটে-ঘাটের বা মাঠের মানুষটির মনেও একুশের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তাকে পৌঁছানো; তাদের মধ্যে একুশের আবেগ ও আন্তরিকতাকে সৃষ্টি করানো। হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তার তো হচ্ছেই। তারমধ্যে অনেকগুলো ঘটনার গুরুত্ব অনেক। খুব দ্রম্নত যদি বলতে চাই তাহলে বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়া, একুশের ভাষা আন্দোলন, প্রায় আট কোটি বাংলা ভাষাভাষী বা বাঙালি অধু্যষিত ভূখন্ড বাংলাদেশের অভু্যদয়, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণদান, একুশের 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতিলাভ (যে প্রসঙ্গে কানাডাপ্রবাসী বাঙালি ভাষাকর্মী প্রয়াত রফিকুল ইসলাম ও তৎকালীন সরকারের অবদানের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়) ইত্যাদি, যার মধ্যে অন্যান্য অনেক বাঙালির বৈশ্বিক বড় বড় অর্জন বা স্বীকৃতিলাভ অবশ্যই রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাঙালির সাম্প্রতিক একটি অর্জনের কথা উলেস্নখ করতে হয়, সেটি হলো বাঙালির সংস্কৃতিগত- 'ছায়ানট'-এর ভারত থেকে 'টেগোর অ্যাওয়ার্ড ফর কালচারাল হারমনি' ২০১৫ লাভ (১৮/০২/১৯)। উলেস্নখ্য, ছায়ানটের আজন্ম ছায়াতরু সভাপতি ড. সনজীদা খাতুন ছায়ানটের পক্ষে পুরস্কার গ্রহণকালে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে সম্প্রীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা রবীন্দ্রনাথেরই অনুসারী- এমন বলেছেন তিনি। পূর্ববাংলায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আর স্বাধীনতা আন্দোলনের সহযাত্রী ছিলেন তারা- এ ঐতিহাসিক তথ্যটুকু যুক্ত করে তিনি আরও বলেন- জয়যুক্ত হোক আমাদের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা। ভাষা সংস্কৃতির বড় উপাদান, একে অপরের পরিপূরক, একের উন্নতি অর্জন স্বীকৃতি সমৃদ্ধি বা বিকাশে অন্যের উন্নতি বিকাশাদি। যা হোক, এ দেশে চাষা বা কৃষকদের আশা প্রকৃতি বা রাষ্ট্র কখনো সম্পূর্ণটি পূরণ করতে পেরেছে? আশা অপূরণীয়। ভাষার ক্ষেত্রেও বাঙালির তাই। পাকিস্তান আমলে মহান সে আন্দোলন পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা কিছুটা মর্যাদা পেয়েছে, তারপরেও অবহেলা আশঙ্কা ছিল। ভাষা বা বর্ণমালাকে নিয়ে ছেলেখেলা বা হেলাফেলা চলমান ছিল। কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় খেঙড়ার নোংরামি বা খিস্তি-খেউরের পৌষমাস ছিল। 'দুঃখিনী বর্ণমালা' তা তখনো। বাংলা ভাষার দুঃখিনী রূপ বাঙালি ছলছল চোখে অবলোকন করল, ভালোভাবে অনুধাবন করল, বাঙালি সংস্কৃতি আর সত্তার কথা উপলব্ধি করল, উদ্বুদ্ধ হলো, একত্রিত হলো জোয়ারের বেগে। বাঙালির গর্জন আর বঙ্গপোসাগরের গর্জন একত্রিত হলো। নতুন একটি সাগর তৈরি হলো- রক্তের। সে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করল। বাহান্ন থেকে একাত্তর- কমবেশি রক্তে ভাষাসংগ্রামী ইতিহাস বাঙালির। এর মধ্যে অগ্রগতিমূলক ধারাবাহিকতা ছিল। এ অনবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা, সামগ্রিক সমুজ্জ্বল ইতিহাস, বাঙালির সংগ্রামী বিবর্তনের ইতিহাস, জাতিগত অপেক্ষাকৃত পূর্ণতালাভের, ঐক্যের ইতিহাস। তাই ভাষার মাস কেবলই ভাষার মাস নয়, নির্দিষ্ট সন-তারিখের ইতিহাস নয়। আর এর সঙ্গে একাত্ম হওয়া মানে শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলামাত্র নয়, কোনো রকমে তা বলামাত্র নয়, বা দায়ে পড়ে বলা নয়; একাত্ম হওয়া মানে এর সার্বিক স্বরূপ, উৎস ও ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম হওয়া, সংশ্লিষ্ট ভূখন্ড ও তার আন্তরিক অধিবাসীদের সঙ্গে একাত্ম হওয়া, তাদের ভাষা সংস্কৃতি ইত্যাদির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যেও, তার মাহাত্ম্যের ও গর্বের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। এ মাসের সঙ্গে বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাসের একটি বিশেষ উজ্জ্বল পর্ব আসে, এতিহ্য ইতিহাস আসে, বাঙালির বিজয় বা স্বাধীনতালাভের সুমহান সমৃদ্ধ কথকতা, কিংবদন্তি আসে। বাঙালির বিশেষরূপে বাঙালি হয়ে ওঠার, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও সংগ্রামী হয়ে ওঠার সূচনাকারী এ মাস- যা একাত্তরের নয়মাসকালীন যুদ্ধে ও ডিসেম্বরের বিজয়ে বিশেষ আড়ম্বরপূর্ণ তাৎপর্য, বিশালতা ও সম্মান লাভ করে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ তার মধ্যে অবগাহন করেছে, শুদ্ধ ও সমৃদ্ধ হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, জাতি হিসেবে বা বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে সে অবগাহনের মর্ম সঠিক ও ব্যাপকভাবে বুঝে উঠতে ও সে অনুসারে কর্ম করে উঠতে পারছি কিনা, তার উৎকর্ষমূলক ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছি কিনা, অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকা পড়ে আছি কিনা, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পরিচয়ের গহনে ডুবতে পারছি কিনা, ডুবতে গিয়ে হরহামেশা অসমর্থ হয়ে চরায় ভেসে উঠছি কিনা, একুশসহ বাঙালির বৈশ্বিক স্বীকৃতিগুলোর প্রতি বিশেষভাবে বিশ্বাসী ও আন্তরিক হয়ে উঠতে পারছি কিনা, সেগুলো কখনো কিছু ক্ষেত্রে অপাত্রে দানের মতোও বা হয়ে উঠছে কিনা, ইতিহাসের আরোহী ক্রমানুগমন অনুসারে বাঙালির মনোজীবনগত শৃঙ্খলা বজায় থাকছে কিনা, তার বিকাশ ও প্রতিকূল পাত্রভেদে ইতিবাচক বিবর্তন হচ্ছে কিনা, ভাষার মাসকে নিয়ে আমাদের আশা বা স্বপ্ন ক্রমেই পূরণ হচ্ছে কিনা। ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছরে পদার্পণে এসব এবং এমন আরও অনেক প্রশ্নের সন্ধান করা, সে সবের মুখোমুখী হওয়া ও উত্তর খোঁজা জরুরি। সে অনুযায়ী একুশের অনুকূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। যে ভাষায় বিশ্বে সাতাশ বা আটাশ কোটি লোক কথা বলে, তার প্রভাব বিশ্বে এখন পর্যন্ত কতটুকু পড়েছে, তার ঘাটতি কোন জায়গাগুলোতে- তার হিসেবে রাখতে হবে। সে অনুসারে আমাদের অগ্রগতি লাভ করতে হবে। বাংলা ভাষার এখন মূল বা বিশাল ভূখন্ড যে বাংলাদেশ, তার অভ্যন্তরেই বা ভাষাটি কোন পরিস্থিতিতে আছে, কতটুকু অধিকার তার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কোন কোন রকমের ঝুঁকি, চাপ ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সে চলছে- তার দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে, সবলভাবে সকর্মক হতে হবে। একটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক একাডেমি ও সংশ্লিষ্ট দু-একটি মাঠে বইমেলা তার সম্পূর্ণ চরিত্র নির্দেশ করে বলে মনে হয় না এখনো। সারা জেলা-উপজেলায়, ইউনিয়ন পর্যায়ে, গ্রামেগঞ্জে তার প্রাতিষ্ঠানিক-প্রশাসনিক প্রভাব পড়তে হবে। প্রবল প্রশাসনিক বা রাষ্ট্রীয় বিধিনির্দেশে, সামাজিক আন্দোলন বা গণজাগরণে, প্রায় প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে প্রভাতফেরি এবং এরকম আরও অনেক রকমের প্রাসঙ্গিকতাসহ একুশ পালনে প্রাবল্য আনতে হবে এর জন্য। এর অন্যথা বা বিচু্যতিতে যে-কাউকে, যে-কোনো প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিরা বা ব্যক্তি কর্তৃক এ ক্ষেত্রে কোনো ভুল উদাহরণ সৃষ্টি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য হতে হবে। না হলে তা হবে প্রচন্ড পরিতাপের বিষয়, লজ্জার বিষয়। কারণ ওইসব জবাবদিহিতা ইত্যাদির তাহলে কোনো যৌক্তিক মানদন্ড থাকে না। মানুষ সমাজ জাতি তাহলে ক্রমাগতই ভুল পথে প্রবাহিত হবে। একুশে পদক বলি বা স্বাধীনতা পদক, বা এরকম অন্য যে কোনো পদক, পুরস্কার বা সম্মাননা তাই এমন কারও হাতে যেতে পারবে না, যিনি একুশের চেতনায় বিশ্বাসী নয়, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে অন্তরে ধারণ করেন না, একুশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাস অর্জনে বুকে পুলক আবেগের প্রবল গর্জন শোনেন না, বা বাস্তবে সরাসরি তার বিরোধিতা করেছেন, শুধু তাই নয়, বর্বরতা দেখিয়েছেন। পলিটিক্স অব কনভেনিয়েন্স যেন আমাদের সব আদর্শ অর্জন কুরে কুরে না খায়, আমাদের পেছনে ঠেলে ফেলে না দেয়, নানা রকমের উগ্রতা, অন্ধতা, আদিমতা, নানা রকমের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত, বদ বা স্থূল ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ও তার ব্যারিকেড, জীবন ও জীবিকার বিশেষ স্বার্থ ও উগ্রতা সংশ্লিষ্টতা, যুগের হুজুগ ও স্থূল-অন্ধ আধুনিকতার পরিচর্যা, বিশ্বায়নের বিষবাষ্প ইত্যাদি যেন বাংলা ভাষা, তার সুষমা ও শক্তিকে, সংস্কৃতি ও ঐক্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মিথকে কোনোমতেই দমিত না করে, পরিবর্তিত না করে, প্রতিবন্ধকতার অন্ধ আবর্তে ক্রমেই না ফেলে। এসব আশা তো অন্তরে রয়েছে, তবে ভাষার মাসে মনের খুব উপরিতলে উঠে আসে এগুলো। ভাষার মাস বা একুশকে নিয়ে আশা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক- উভয়ভাবেই আছে। একুশ আগে কেবল জাতীয়ভাবে উদযাপিত হতো, এখন তার কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে- উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিকভাবেও। কিন্তু হতো না, কিংবা হলেও আরও অনেক পরে হতো, যদি আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির চর্চাকে, একুশের উদযাপনকে জাতীয়ভাবে শ্রদ্ধাভরে দীর্ঘকাল ধরে পালন না করে আসতাম। অর্থাৎ ব্যাপারটিকে আমরা নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে না পারতাম। মঙ্গল শোভাযাত্রা, ছায়ানট ইত্যাদির ক্ষেত্রে পেরেছি। বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছি এগুলোর জন্য। এ প্রাপ্তিগুলো আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিচর্চার উৎকর্ষের, ব্যাপকতার স্বীকৃতি। এভাবে বাংলা ভাষা একদিন জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হবে- আমরা ভাবতেই পারি। যেদিন হবে সেদিনও কি আজকের মতোই আফসোস বা আশা করতে হবে? প্রদীপের নিচে অন্ধকার দেখে আঁতকে উঠতে হবে। যেমন একুশের আন্তর্জাতিকতা লাভের পরেও উঠতে হয়। এর পেছনে একটি কারণ এমন হতে পারে, কিছু অর্জন মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ বা আন্দোলন বা সম্পূর্ণ উৎকর্ষে হয় না, হয় ব্যক্তিবিশেষের বা বর্গের উদ্যোগে, অথবা সরকারের উদ্যোগে বা উভয়ের। যে স্বাধীনতা লাভ প্রায় সবার সম্মিলিত সংগ্রাম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে হলো, তাও কেন আমাদের শূন্যতা বা বিপথগামিতাকে রোধ করতে পারল না? স্বাধীনতার প্রায় পর পরই নানা রকমের সন্ত্রাস, দুর্নীতি, সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত আমাদের আক্রান্ত করতে থাকল? স্বাধীনতার স্থপতিসহ একুশ-একাত্তরের আলোকবর্তিকাহীন অন্ধকারে আমাদের নিপতিত হতে হলো? এখানেও আমাদের সম্ভবত সবার সে রকম ইনভলভমেন্ট হয়নি সে অর্থে, কবি সুকান্তের ভাষায় 'রক্তদানের পুণ্য' অর্জন হয়তো হয়নি পুরোটা ইত্যাদি। কাজেই ভাষার মাস নিয়ে আশা অনেক, তার অনেক পূর্ণতা আসতে হবে। মূলত একুশকে নিয়ে, বাংলা ভাষা সংস্কৃতি ও দেশকে নিয়ে আশা অনেক, তা পূরণের অনেক অনেক অবকাশ রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তা পূরণীয়। একুশ এখন আমাদের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে উগ্র বা আগ্রাসী রকমের জাতীয়তাবাদী হতে শেখায় না, একটি উজ্জ্বল গর্ব ও দায়িত্ববোধের জায়গায় আমাদের অবস্থিত করে অন্য ভাষা-সংস্কৃতির ওপর নমনীয় বা দরদি হতে শেখায়। বিশ্বের যে কোনো জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রতি সম্মানের চোখে তাকাতে শেখায়, তার উন্নয়নের অনুকূলে চলতে শেখায়। জীববৈচিত্র্য যেমন পরিবেশের প্রাণ, সৌন্দর্য, আমাদের বেঁচে থাকার পৃথিবী, ভাষাবৈচিত্র্যও তেমন। তা রক্ষার ও সমৃদ্ধির আহ্বান একুশের মধ্যদিয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর সবাইকে দিয়েছি, বুঝিয়েছি। কাজেই আমাদের একটু বেশিই বুঝতে হবে এ ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে অর্থে। এভাবে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়, গণতান্ত্রিকতা মূল্য পায়, ভাষা সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও তার সৌন্দর্য রক্ষা পায়, তার ফলে সেগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বা সম্প্রীতি তৈরি হয়, সহনশীলতা বাড়ে, মানবসভ্যতার কিছু বিশেষ ইতিহাস রক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ অনেক ভাষা রয়েছে, তাদের সংস্কৃতি রয়েছে। একুশ এভাবে আমাদের বা বিশ্বকে একটি পস্ন্যাটফর্মে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছে। একুশ এভাবে যেমন দেশজ, তেমনি বৈশ্বিক। জাতিসংঘে শহিদ মিনারের রেপিস্নকা, অর্থাৎ বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন একুশ। দেশে দেশে এখন একুশ পালনের রীতি, বাধ্যবাধকতা। এর চেয়ে মহান ঘটনা কমই আছে। আমাদের স্বাধীনতা লাভ একটি বিরাট অর্জন, বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা, কিন্তু সেটি আমাদের অত্যন্ত নিজস্ব, একুশও তাই ছিল, কিন্তু এখন? একুশ আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে বৈশ্বিক প্রবহমান পরিচিতি। একুশ আমাদের বৈশ্বিক যোগাযোগের মাধ্যম। আমাদের অস্তিত্বের একটি প্রধান অংশ ভাষা- বাংলা ভাষা। আমরা যেখানে যাই সেখানে আমাদের ভাষা যায়- সংস্কৃতি যায়, মানে একুশ যায়। আমাদের ভাষা আরও শক্তিশালী, প্রভাবশালী হলে আরও যেত, নানাভাবে যেত। তাই নানাভাবে ভাষাকে শক্তিশালী করার সাধনা, নিরন্তর প্রচেষ্টা সবাইকে সর্বস্তরে করতে হবে। শুধু সৃজনশীল সাহিত্য ইত্যাদি রচনায় নয়, আইন-আদালত থেকে শুরু করে, বিজ্ঞানচিন্তা, গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা ইত্যাদি সবকিছুতে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটাতে হবে, তার স্বীয় ভূমিতে তাকে সর্বোচ্চ আসন- অধিকার দিতে হবে। নিজ বাসভূমে তাকে সর্বোচ্চ অধিকার না দিয়ে জাতিসংঘে তার অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা আমরা তেমন করে ভাবতে পারি কি? আমাদের মেধাচিন্তা গবেষণার উৎকর্ষ আপন ভাষার সঙ্গে না মেশালে, নানাভাবে দেশের সমৃদ্ধির মাধ্যমে ভাষাকে প্রভাবশালী না করতে পারলে বিশ্বের কাছে- ওই আশা বা চিন্তার বাস্তব রূপায়ণ অনেক দূরবর্তী থেকে যাবে। বাংলা ভাষাকে আগে নানাভাবে সুগঠিত, শক্তিশালী, প্রভাবশালী পরিচিত করার আগেই যদি তাকে জগাখিচুড়ি ভাষা করে ফেলি, তার উচ্চারণে নিজেদের বিদেশি বা আগন্তুক করে ফেলি, তাকে নিয়ে হেলাফেলা করি, অন্য ভাষার ওপর বেশি রকমের নির্ভরশীল হয়ে পড়ি নানা কারণে, তাহলে বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে, বাঙালিকে, বাংলাদেশকে আশানুরূপ প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা সমর্থ হবো না। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি আরও আমাদের নিষ্ঠাবান হতে হবে, কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে, শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বাংলাদেশে বাংলাসহ তিনটি প্রধান ভাষা-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট তারিখ ইত্যাদি এখন ক্যালেন্ডার, পত্রপত্রিকা, পঞ্জিকায় নিয়মিত ব্যবহার করা হয়। সমাজ-রাষ্ট্রে ব্যক্তিজীবনে তার অনেক প্রভাব রয়েছে। এ দেশের অধিকাংশ মানুষই এখন একান্ত শৈশব থেকে কোনো না কোনোভাবে সেগুলো কমবেশি শিখতে শিখতেই, অভ্যস্ত হতে হতেই বড় হয়। প্রয়োজনে আরও বেশি ভাষা শেখা যায়। মনে রাখার বিষয় হলো, বাংলা যেন তার মধ্যে মহান মর্যাদা লাভ করে। ভাষার আন্তরিক অধ্যবসায়, অর্জনে ভাষার সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে, দেশের শেকড়ের সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে যুক্ত হওয়া হয়। আমরা যেন পৃথিবীর একটি পরম সুন্দর সমৃদ্ধ ভাষার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তার অবমূল্যায়ন না করি, সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিকে ছোট মনে না করি, দূরে না ঠেলি, নিজেদের কমবেশি শেকড়হীন, অপরিচিত বা আগন্তুক না করে ফেলি। শুকদেব মজুমদার: কবি, কলাম লেখক ও সহযোগী অধ্যাপক