আত্মহত্যা একটি ভয়াবহ ব্যাধি

প্রকাশ | ০১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

ফাতিমাতুজ্জোহরা শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
আত্মহত্যা মানে নিজেই নিজেকে হত্যা করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে, 'প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ প্রতি বছরে আত্মহত্যার কারণে মারা যায়।' যা নির্দেশ করে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি মৃতু্য। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই মৃতু্যর প্রথম দশটি কারণের মধ্যে এবং পনেরো থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সিদের প্রথম তিনটি কারণের মধ্যে একটি হলো আত্মহত্যা। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫, বিবিসির খবর আরও বলছে আত্মহত্যার জরিপে বিশ্বে দশম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতি বছর কিছু স্কুল এবং কলেজে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করছে। তার খবরও আমরা পাই প্রতিনিয়ত। তবে প্রশ্ন হতে পারে মানুষ কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? বিভিন্ন মানসিক কষ্টের ফলে হতাশার কারণেই মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সমকালীন গবেষকদের মতে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, মা-বাবা ও অভিভাবকদের শাসন, অনৈতিক প্রেম-ভালোবাসা, কাঙ্ক্ষিত সফলতা না পাওয়া, অভাব-অনটন, ভয়-ভীতি, অসুস্থতা, যৌতুক, মানসিক সমস্যা, হতাশা ইত্যাদি আত্মহত্যার কারণ। কখনো কখনো ঈদে নতুন জামা না পেয়ে কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার খবরও পত্রিকায় আসে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ জেমস গ্যারিফিল্ড (১৮৩১-১৮৮১) লিখেছিলেন, 'আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।' গবেষণায় দেখা যায়, সমাজে যারা আশাবাদী, জীবনের কষ্টকে যারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভাবেন এবং যে কোনো বিষয়ে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার কম দেখা যায়। বিশ্ববিখ্যাত মনোচিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, 'মানুষের মধ্যে অবচেতনে থাকে মৃতু্য প্রবৃত্তি। পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাবে এই মৃতু্য প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আর মরিবার সাধ হয় তার।'- (সমকাল, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। ১৮ আগস্ট ২০১৭ প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, 'একটি প্রজন্মের ধ্বংসের পেছনে স্মার্টফো।' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনকার কিশোররা বন্ধুর সান্নিধ্যে কম সময় কাটায়, তাদের মধ্যে ডেটিং কমছে, এমনকি পুরো প্রজন্মের ঘুম কম হচ্ছে। একাকিত্বের এই হার বাড়ায় সাইবার নিপীড়ন, হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সমকালের প্রতিবেদন ছিল,' আত্মহত্যা-প্রতিরোধ করব কীভাবে? জনপ্রিয় অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস আত্মহত্যা করেছেন। এর আগে বাংলাদেশি চিত্রনায়ক সালমান শাহ আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা করেছেন সাংবাদিক মিনার মাহমুদ। এর পেছনের কারণগুলো এখনো ভালোভাবে জানা হয়ে ওঠেনি। গত কয়েক বছরে এ দেশে আত্মহত্যার তালিকায় যুক্ত হয়েছে জনপ্রিয় নায়ক, অভিনেতা, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে, স্কুল পড়ুয়া শিশু এবং ভার্সিটি পড়ুয়া উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীটিও। আত্মহত্যা এবং আত্মহননের প্রচেষ্টা মানবসভ্যতার শুরু থেকেই প্রচলিত থাকলেও বিগত ৪৫ বছরে বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার হার শতকরা ষাট ভাগ বেড়েছে। তবে যারা মুক্তি হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নেয় তাদের শতকরা নয়জনই কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভোগে। কিছু কিছু মনোবিজ্ঞানীর মতে মানুষের একাকিত্ববোধ, অস্তিত্বহীনতা, জীবনের অর্থ-উদ্দেশ্য খুঁজে না পাওয়া আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতার বিষয়টি লক্ষণীয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৪ বছরে আত্মহত্যা করেছেন ২৩ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে গত তিন বছরেই আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন। ধারণা করা হয় শিক্ষার্থীরা সাধারণত বিষণ্নতা, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, সম্পর্কের টানাপড়েন এবং চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কিন্তু আত্মহত্যা কী আসলেই ব্যক্তির জন্য সমস্যা-সমাধানের পথ? আত্মহত্যা করলেই কী ব্যক্তির সব সমস্যা শেষ হয়ে যায়? না। বরং প্রতিটি আত্মহত্যার ফলে সমাজ ও সংসারে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। সারাজীবনের জন্য ভেঙে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা। মা-বাবা হারায় তার সন্তানকে, ভাই হারায় তার বোনকে, বন্ধু হারায় তার বন্ধুকে। তা ছাড়া মৃত ব্যক্তির পরিবার গভীর শোক, অপরাধবোধ, হতাশা এবং আরও নানাবিধ জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। আবার, মৃতের যদি সন্তান-সন্ততি থাকে তারাও স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে না। তার পরিবারে সমাজ কর্তৃক বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়, পরিবারকে সমাজ কর্তৃক হেয় চোখে দেখা হয় এবং বিভিন্ন নেতিবাচক মনোভাবের সম্মুখীন হতে হয়। তা ছাড়া আত্মহত্যাকারীর পরিবারকে পোহাতে হয় নানা রকম আইনি ঝুট-ঝামেলা এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা। সামাজিকভাবেও আত্মহত্যাকারীর পরিবারের মান-মর্যাদা, প্রভাব কমে যায়, এক ঘরে হয়ে যেতে হয়। সর্বোপরি পরিবারের শান্তি এবং স্বাভাবিক ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়ে। তা ছাড়া আত্মহত্যাকারীর মৃত দেহকেও সম্মান করা হয় না। পুলিশি পোস্টমর্টেমের নামে ছিন্নভিন্ন করা হয় মৃতের দেহ। যা যে কারও আপনজন-পরিবারের পক্ষে সহ্য করা হয়ে যায় কঠিন। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, কোনোভাবেই কি এই ভয়াবহ আত্মহত্যার ব্যাধি থেকে মানুষকে বাঁচানো যায় না? চাইলেই যায়, মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে। হতাশাগ্রস্ত মানুষের বোঝাতে হবে, শুধু তোমার জীবনে নয়- সব মানুষের জীবনেই দুঃখ-কষ্ট আছে, থাকবেই। তবে দুঃখ-কষ্ট আছে বলেই নিরাশ হওয়া যাবে না। জীবনের চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে হবে। কোনো কাজেই আশাহত হওয়া যাবে না। সফলতাই জীবনের সব কিছু নয়। ব্যর্থ হলে আবার অন্যভাবে চেষ্টা করে দেখতে হবে, কোনো কাজই পৃথিবীতে ছোট নয়। আর ধর্মকে মেনে চলতে হবে, কারণ সব ধর্মেই আত্মহত্যা পাপ। তাই ধর্ম মানলে, হৃদয়ে ধারণ করলে আত্মহত্যাকেও একটা পাপ মনে হবে। ফলে আত্মহত্যা অনেকটাই কমে যেতে পারে।