শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিদু্যৎসহ নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ সংকটে ও ভোগান্তিতে

সরকারকে কঠোর হাতে অতিলোভী ও অসাধু এসব ব্যবসায়ীকে দমন করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যতালিকা টাঙানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কি না, সরকারকে তা তদারকি করতে হবে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ০২ মার্চ ২০২০, ০০:০০

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক: দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অতিনিবিড় এবং বাস্তব। একটি পরিবার কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে চলে অর্ধাহার, অনাহার এবং পারিবারিক অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোরি, কালোবাজারীদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বর্তমান এই যুগে ন্যায়সঙ্গত মূল্যে কোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না। প্রতিটি পণ্যেই যেন অধিক মূল্যের আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। অথচ এক বা দুই দশক আগেও এই অবস্থা ছিল না। মানুষ জীবন কাটাতো সাধ্যের মধ্যে ভালো থেকে। শায়েস্তা খাঁ'র আমলে টাকায় আট মণ চালের কথা যেন এখন রূপকথা। ব্রিটিশ শাসনামালও দেশের দ্রব্যমূল্য ছিল নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়। মন্বন্ত্বর, দাঙ্গা আর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দেশের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হলেও দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি আমাদের জীবনে অতর্কিতে হানা দেয়। ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় অধিকাংশ দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলে যেতে থাকে। ভবিষ্যতে এই অবস্থা আরো নাজুক না হোক এটাই সবার চাওয়া। ২৭ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২০ রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিইআরসির কার্যালয়ে বিদু্যতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল। গত বছরের ডিসেম্বরে বিদু্যতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি শেষ হয়। আইন অনুযায়ী গণশুনানির ৯০ দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানাতে হয় বিইআরসিকে। বিইআরসির দাবি, দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। খুচরা বিদু্যতের দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে পাইকারি বিদু্যৎ ও বিদু্যতের সঞ্চালন মাশুল। পাইকারিতে বিদু্যতের দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৪০ পয়সা বা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। এর আগে পাইকারি বিদু্যতের প্রতি ইউনিট বিক্রি হতো ৪ টাকা ৭৭ পয়সায়। মার্চ থেকে এর দাম হবে ৫ টাকা ১৭ পয়সা। এ ছাড়া বিদু্যৎ সঞ্চালন মূল্যহার বা হুইলিং চার্জ প্রতি ইউনিটে শূন্য দশমিক ২৭৮৭ টাকা থেকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে শূন্য দশমিক ২৯৩৪ টাকা। বিদু্যতের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আমদানি করা কয়লার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের ওপর ১০ পয়সা ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদু্যৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, পলস্নী বিদু্যতে তুলনামূলক কম দামে বিদু্যৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ঋণের অর্থায়নে বিদু্যৎ খাতে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় সেখানে সুদ দিতে হচ্ছে। এসবই এবার বিদু্যতের দাম বাড়ার কারণ। তবে এ যুক্তির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। বিদু্যতের দাম বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ইতোমধ্যে পোশাক শিল্প খাত ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। দেশের শীর্ষ পণ্য রপ্তানির পোশাক শিল্প কোনো সময়ের চেয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে ১ হাজার ৯০৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। এর মধ্যে বিদু্যতের দাম বাড়ায় খাতটি আরও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে নজরদারি জারি রাখে। মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাখোরি মানসিকতা বদলাতে হবে। তাদের মুনাফাবাজির তৎপরতায় উৎসাহ দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। দাম চড়িয়ে দিলে ভোক্তাদেরও সচেতন হয়ে ভোগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। উৎপাদন, আমদানি ও বাজারে সরবরাহে সমন্বয় ঘটাতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর বিষয়টি আজ নতুন নয়। এতে জনজীবন যে বিপর্যস্ত হয়, কেউ বুঝতে চায় না। অসৎ ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ও মুনাফালোভীদের কারণে এসব ঘটে। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে সারা বছর। পণ্য বাজারে সরকারের নজরদারি ও সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নিয়মিত মনিটর করতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন রাজনীতির অপপ্রয়োগ ও বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর রাজনীতিকরা নিজেদের সুবিধার জন্য রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণ মানুষের কথা তারা ভাবেন বলে মনে হয় না। তারা প্রয়োজনে পুলিশকেও ধমকান। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়েও এ দেশে রাজনীতি হয়। পণ্য ক্রয়ে কেন শুধু ভারতকে বেছে নিতে হবে? আরো তো দেশ আছে, তাদের কাছ থেকেও কেনা যায়। তা তো করা হয় না। এ জন্য সরকারের মনিটরিং সেল ও ভ্রাম্যমাণ প্রশাসনিক বাহিনী দরকার বলে মনে করি। খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা। এই চাহিদার মধ্যে রয়েছে কিছু নিত্যব্যবহার্য পণ্য। যেমন- চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ ও আদা। পেঁয়াজ ও রসুনসহ সব পণ্যের দাম সহনীয় ও স্থিতিশীল রাখতে করণীয় অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটবাজদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। নিত্যব্যবহার্য পণ্য, পেঁয়াজ, রসুন, আদার উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিপস্নব ঘটাতে হবে। কৃষক পর্যায়ে বাম্পার ফলনের জন্য স্বল্প কিংবা বিনামূল্যে পেঁয়াজের বীজ, সার, কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। সরকারিভাবে পেঁয়াজের মজুদ বাড়াতে হবে। কৃষকরা যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি চালু করতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজার সারা বছর মনিটর, নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে স্থিতিশীল থাকে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণাগার স্থাপন করুন। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে, যাতে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীরা শাস্তি পান। দেশব্যাপী ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু রাখতে হবে। রাজধানীর বাইরে অন্যান্য জেলা শহরে টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপণ্য বিক্রি বাড়িয়ে জনগণের মধ্যে সহজলভ্য করতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ বহুবিধ, অপরিকল্পনাও দায়ী। কোনো সময় কোনো দ্রব্য বা পণ্য বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয় এবং কোনো সময় আমাদের উৎপাদন কম থাকে বা ব্যবহার বেড়ে যায়, তা কিন্তু জানা আছে সবার। বাজারে অস্থিরতা তৈরির জন্য আবার কিছু মানুষ অপেক্ষায় থাকে। যখন ভারত বলল, তারা পেঁয়াজ রপ্তানি করতে পারবে না তখনই একেবারে ১০০ টাকার ওপরে উঠে গেল পেঁয়াজের দাম। মিয়ানমার থেকেও পেঁয়াজ সময়মতো এলো না। সংকট তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানুষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য আটকে দেয় এবং দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি করে। সরকারি মজুদের পরিমাণ এবং বেসরকারি মজুদের পরিমাণ দুটিই সরকারের জানা থাকতে হবে। আমদানি নির্ভরতাও কমিয়ে আনা দরকার। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে নিত্যপণ্যের দাম নাগালে রাখা সম্ভব হবে। শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই ক্রমবর্ধমান চাপ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোধ করা প্রয়োজন। এ জন্য দেশের কালোবাজারি, চোরাচালানি রোধ করতে হবে সবার আগে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতে হবে আরো কঠোর ও দায়িত্বশীল। গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষকদের ঋণদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে যাতে তারা সহজে পণ্য বাজারজাত করতে পারে এবং ন্যায্যমূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করতে পারে। সরকারকে প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আয়ত্বে থাকবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই দুঃখের দিনেও আশার কথা হচ্ছে দ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দ্রব্যমূল্য যাতে বিক্রেতারা ইচ্ছামতো বাড়াতে না পারে তার জন্য দোকানে পণ্যের নির্ধারিত মূল্য তালিকা টানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এ বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য 'টিসিবি'কে (ঞৎধফরহম ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরড়হ ড়ভ ইধহমষধফবংয) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে স্পর্শকাতর পণ্যের খুচরা ও পাইকারি মূল্যের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আইন অনুযায়ী দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টাঙানো বাধ্যতামূলক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই আইন প্রয়োগের ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে থাকে। এ ছাড়া দেশের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছে সরকার। বর্তমানে সরকার ও জনগণ সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সজাগ হয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে। চোরাচালানি ও কালোবাজারিরা ইতোমধ্যেই আইনের আওতায় এসেছে এবং শাস্তিভোগ করছে। ব্যবসায়ীরা সরকারি আদেশ মানতে শুরু করেছে। দেশের গণমাধ্যমগুলো এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। এভাবে সরকার, জনগণ ও ব্যবসায়ী সমাজের সম্মিলিত সহযোগিতায় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এটাই আজ দেশের মানুষের চাওয়া ও স্বপ্ন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। প্রথমত, সরকারের সদিচ্ছা ও বাস্তব পরিকল্পনা। দ্বিতীয়ত, পণ্যসামগ্রীর চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করা। এ জন্য দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যবাজারের ওপর সরকারের সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার, যেন অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে খুশিমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে না পারেন। রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সমঝোতা সৃষ্টি করে এ সমস্যা লাঘব করা দরকার। চোরাচালান ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। বাজার নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। দুর্নীতির লাগামহীন ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের অধীনে বাজার নিয়ন্ত্রণ বা মনিটরিং সেল থাকলে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে যে কোনো পণ্যের সময়োপযোগী সরবরাহ নিশ্চিত করে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। আমদানি নির্ভরতা কমাতে হলে উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। কিন্তু দেশে অনেক কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ওই পণ্যের আমদানির তুলনায় অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা মোকবিলায় সংশ্লিষ্ট সরকারের তরফ থেকে সহজ শর্তে কৃষিঋণ এবং প্রয়োজনে পর্যাপ্ত ভর্তুকি প্রদান করে কৃষিজীবীদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার। রবিশস্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। পাশাপাশি আমাদের রুচিবোধের কারণে কৃষি ফার্মভিত্তিক বছরব্যাপী উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা চাহিদা কম। নগরভিত্তিক নাগরিকদের ব্যস্ততা ও সময়ের মূল্য দিতে গিয়ে যদিও এই রুচিবোধের অনেকটা পরিবর্তন এসেছে; কিন্তু গ্রামনির্ভর বাংলাদেশের সেই চিত্র ভিন্ন। আমজনতার মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা, কৃষি ফার্মভিক্তিক চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত মাছ, মাংস, ডিম, তরিতরকারি ও বছরব্যাপী উৎপাদিত অন্যান্য শস্যের স্বাদ নেই। মূলত স্বাদের দিকে নজর না দিয়ে পুষ্টিজ্ঞানের প্রতি নজর দিলে আমাদের নিত্যপণ্যের জোগানের সমস্যা অনেকাংশে লাঘব সম্ভব। কৃষি ফার্মভিক্তিক মাছ, মাংস, ডিম, তরিতরকারি ও বছরব্যাপী উৎপাদিত অন্যান্য শস্য উৎপাদনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা চালালেও কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্য তা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজনের গাফিলতির কথা শোনা যায়। আবার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবের কথাও জানা যায়। ফলে দায়ী ব্যবসায়ীরা যেমন পার পেয়ে যান, তেমনি আবার একই ধরনের অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবের সময় এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য মরিয়া হয়ে যান। তাদের কাছে ধর্মীয় নির্দেশনা বা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেন অসহায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগ একটু দূরদর্শী ও সতর্ক হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের এ সব অপকর্ম থেকে জনগণ রক্ষা পেতে পারে। আর বিক্রেতারা যদি ক্রেতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতেন তাহলে হয়তো লাগামহীনভাবে মূল্যবৃদ্ধি করতেন না। দাম বৃদ্ধির এই হার স্থানভেদে পার্থক্য থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু দ্রব্যের মূল্য সবক্ষেত্রে একই হারে বেড়ে থাকে। ক্রেতা সাধারণের তখন অধিক মূল্যে পণ্য কেনা ছাড়া কোনো পথ থাকে না। অবশ্য টিসিবি কয়েকটি পণ্য স্বল্পমূল্যে ভোক্তা সাধারণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। প্রথমত, সরকারের সদিচ্ছা ও বাস্তব পরিকল্পনা। দ্বিতীয়ত, পণ্যসামগ্রীর চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করা। এ জন্য দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যবাজারের ওপর সরকারের সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার, যেন অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে খুশিমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে না পারেন। রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সমঝোতা সৃষ্টি করে এ সমস্যা লাঘব করা দরকার। চোরাচালান ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। বাজার নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। দুর্নীতির লাগামহীন ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সরকারকে কঠোর হাতে অতিলোভী ও অসাধু এসব ব্যবসায়ীকে দমন করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যতালিকা টাঙানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কি না, সরকারকে তা তদারকি করতে হবে। \হসরকার ও ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষের আরও একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মুনাফালোভী, কালোবাজারি ব্যবসায়ী শ্রেণি, ঘুষখোর কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে হবে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। তাহলেই দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পাবে। জনমনে হতাশা, ক্ষোভ দূর হয়ে শান্তি ফিরিয়ে আসবে। বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে জনমানসের চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। নিশ্চিত করা হবে সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে