বাংলা একটি ভাষার নাম। একটি চেতনার নাম। আর এই ভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলায় ১৩৫৮ সালে ইংরেজিতে ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন হয়েছিল তাই ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিত। বাংলা সারা বিশ্বের অহংকার। কেননা পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিরাই প্রথম ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল। তাই ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রম্নয়ারি শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তবে ভাষাকে নিয়ে ভাবার ইতিহাসটা আরও আগের। ১৯৪০ সালে পাকিস্তানের লাহোরে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পৃথক রাষ্ট্রগঠনসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে একটি প্রস্তাব করা হয়। যা ইতিহাসে 'লাহোর প্রস্তাব' নামে খ্যাত। ১৯৪৭ সালে শুধু ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র। পাকিস্তানের আবার দুটি ভাগ ছিল আগে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) আর পশ্চিমে পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই দুই পাকিস্তানের মধ্যে শুরু হয় দূরত্ব। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় আসেন। ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কি হবে সেটা পূর্ব বাংলার জনগণই নির্ধারণ করবে। কিন্তু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ'। ২১ ফেব্রম্নয়ারি প্রদেশব্যাপী 'রাষ্ট্রভাষা দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই দিবসের কর্মসূচিকে সফল করতে ৪ ফেব্রম্নয়ারি 'হরতাল এবং ১১ ও ১৩ ফেব্রম্নয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। ৫২ সালের ১৬ ফেব্রম্নয়ারি 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা' ও বন্দি মুক্তি' দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহম্মদ অমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সব ন্যায্য অধিকারের দাবিতে বাঙালিরা যখন ঐক্যবদ্ধ তখন ২০ ফেব্রম্নয়ারি নুরুল আমিনের ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ সরকার ২০ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ঢাকা শহরে ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি বাংলায় ৮ ফাল্গুন মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্র-জনতা মিছিল বের করে। সেদিন হাতে ছিল পস্নাকার্ড। মুখে ছিল সেস্নাগান। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'। পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্রছাত্রীরা শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলতে থাকে পরিষদ ভবনের দিকে। শান্তিপূর্ণ মিছিলটি মেডিকেল কলেজের সামনে এলে পুলিশ সেদিনের সেই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। রাজপথে শহিদ হন জব্বার, শফিউর, রফিক, বরকতসহ নাম না জানা আরও অনেকে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেদিনের সেই ভাবনা, সেদিনের সেই চেতনা পরবর্তী সব আন্দোলনে জুগিয়েছে প্রেরণা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ১৯৬৬ ছয়দফা, ১৯৬৯-গণঅভু্যত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় সবই ভাষা আন্দোলনের ফসল। সেদিন যে বাঙালি জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়েছিল তা বাঙালির সব আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আন্দোলন ছাড়া যে বিজয় হয় না তা ভাষা আন্দোলন থেকে শিখতে পেরেছিল। পাকিস্তানিরা যে পূর্ব বাংলার উন্নতি বা সমৃদ্ধি চায় না তা বোঝা গিয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে। তাই বলা হয় ভাষা আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার বীজ লুকায়িত ছিল। বাঙালির অদম্য মনোবল দেখে, বাঙালির ভাষার জন্য আন্দোলন দেখে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে অধিকার আদায়ের শিক্ষা নেই। ভালোবাসার শিক্ষা নেই। দেশপ্রেমের শিক্ষা নেই। একত্রে পথচলার শিক্ষা নেই। বাংলাকে ভালোবাসি। বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করি।
গোপাল অধিকারী
ঢাকা