৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের পর কারও কি ঘোষণা দেওয়ার অপেক্ষা রাখে?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অজেয় বজ্রকণ্ঠ আজও কাঁপন ধরায় বাঙালির রক্তে। আলোড়ন তোলা সেই আহ্বানের জন্যই যেন বাঙালি জাতি অধীর অপেক্ষায় ছিল। বিদু্যৎ বেগে সেই আহ্বান সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর' স্স্নোগানে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। জাতির উদ্দেশে প্রশ্ন, এর পরও কি আর কারও স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার অপেক্ষা রাখে?

প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২০, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক মার্চ মাস। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের ৭ তারিখে ঢাকার রমনার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র জাতির আকাঙ্ক্ষাকে আত্মস্থ করে ঘোষণা করেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু জনগণকে মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল'। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী টালবাহানা শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে দেশের জনগণ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১ মার্চ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চের দিকনির্দেশনামূলক সেই ভাষণের পথ ধরেই ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল অস্থায়ী সরকার। এ সরকারের নেতৃত্বেই দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। অভু্যদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতীয় জীবনেই শুধু নয়, মুক্তিকামী সারা বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কাছে এক অনন্য সাধারণ ভাষণ হয়ে আছে। ওই সময়ে আমি ছিলাম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। গাজী গোলাম মোস্তফা সভাপতি মোহাম্মদ সুলতান সেক্রেটারি আর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন মনসুর ভাই। সাধারণত ঢাকার কর্মসূচিগুলো পালনের দায়িত্ব থাকতো আমাদের ওপর। সেই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ সকালে আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি বাড়ির চারপাশে লোকে লোকারাণ্য। আমরা নগর আওয়ামী লীগের নেতারাই বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় নিয়ে আসি। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন তখন আমরা মঞ্চের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই ঐতিহাসিক দিনে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে সর্বদা ধন্য মনে করি। একাত্তরের ৭ মার্চের বিকেলটা ছিল অন্যরকম। এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় ছিল সমগ্র জাতি। এক পাতাঝরা বসন্তের বিকেল এভাবে বদলে দিতে পারে ইতিহাসের মোড়, বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। সেদিন বেলা ৩টা ২০ মিনিটে দেওয়া মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে যেভাবে উজ্জীবিত করেছিল, তার তুলনা আর কোনো কিছুর সঙ্গে হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হন, তখন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ ময়দান। মুহুর্মুহু স্স্নোগানে প্রকম্পিত চারদিক, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা। সেদিন বঙ্গবন্ধু আমাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন। বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ওই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময়ের বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। তাই এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিটি বাংলাদেশির স্মরণ করা উচিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যার অনন্য সাধারণ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের ভেতর দিয়ে ফুটে ওঠে এক দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক নেতার পরিচয়। স্পষ্ট করেই তিনি বলেছিলেন, শহিদের রক্তের ওপর দিয়ে, পাড়া দিয়ে, আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল' উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। সেই অধিকার তিনি এনে দিয়েছিলেন এ দেশের মানুষকে। মূলত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যেই পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি, সেটা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আগেই। বুঝে গিয়েছিলেন যে, জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধ আসন্ন। আর সে যুদ্ধে তিনি উপস্থিত নাও থাকতে পারেন, আবার গ্রেপ্তার করা হতে পারে তাকে, এটাও যেন তার কাছে স্পষ্ট ছিল। বোধহয় সে কারণেই তিনি স্পষ্ট করে বলে দেন, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, ...... তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল: প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবিলা কর। ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে যেমন মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি তেমনি আসন্ন সে যুদ্ধের জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বানও জানিয়েছিলেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহলস্নায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা: রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশালস্নাহ্‌। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অজেয় বজ্রকণ্ঠ আজও কাঁপন ধরায় বাঙালির রক্তে। আলোড়ন তোলা সেই আহ্বানের জন্যই যেন বাঙালি জাতি অধীর অপেক্ষায় ছিল। বিদু্যৎ বেগে সেই আহ্বান সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর' স্স্নোগানে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। জাতির উদ্দেশে প্রশ্ন, এর পরেও কি আর কারও স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার অপেক্ষা রাখে? আর কে চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা