ইতিহাসে চির অম্স্নান

৭ মার্চের ভাষণ

প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বাঙালির জাতীয় জীবনে অবিস্মরণীয় এক দিন ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে রচিত হয়েছিল রাজনীতির এক ঐতিহাসিক মহাকাব্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংমাম'-এই কথাগুলো উচ্চারণ করে কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই ঘোষণার পরিণতির কথাও তিনি আগেভাগেই চিন্তা করেছিলেন। তাই একই সঙ্গে বলে দিয়েছিলেন, 'আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা করতে হবে।' ৭ মার্চের এমন ঘোষণা শুধু বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই দেওয়া সম্ভব ছিল। কারণ দিনে দিনে তিনি নিজেকে চালকের আসনে নিয়ে এসেছিলেন, জাতিকে স্বাধীনতার জন্য তৈরি করেছিলেন। মাত্র ১৯ মিনিটের এই একটি ভাষণ জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে বিশ্বের ইতিহাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের অন্যতম বলে গণ্য করে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ভাষণ নিয়ে গবেষণাও চলমান। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় এই ভাষণ। এই ভাষণই বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেছিল মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও তা প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাঙালিদের যে করতে হবে তাও তার দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল বহু আগে। ৭ মার্চের ভাষণে সেই দিকনির্দেশনাও স্পষ্ট। ভাষণে তিনি বললেন, 'প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।' পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশে ভাষণে উচ্চারিত হলো সাবধানবাণী, 'আর আমার বুকের ওপরে গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।' আবার দেশের সংগ্রামী জনতাকে সাবধান করতেও ভোলেননি তিনি, 'মনে রাখবেন শত্রম্ন বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে।' দিলেন জনযুদ্ধের ডাক, 'প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহলস্নায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশালস্নাহ।' আর এর পরই তার সেই অমোঘ উচ্চারণ- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।' বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা হয়ে গেল সেদিনই। সারা দেশের মানুষ পেয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, 'শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।' বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনীয়। ৭ মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (অলিখিত এবং স্বল্প সময়ের) বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ। এটি একটি মহাকাব্যিক রাজনৈতিক ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কূপমন্ডূকতা থেকে মুক্ত করার দিক-নির্দেশনা ছিল এই ভাষণে। সেদিন 'যার যা আছে তাই নিয়ে' এ দেশের মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাসের নিরন্তর মুক্তির লড়াইয়ের পর বিজয়ী হয় জাতি। তাই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের গুরুত্ব আজও অম্স্নান। মূলত ৭ মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতা অর্জনের নির্দেশিত পথ। বাঙালি জাতি এবছর মহান এই নেতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে, আগামী বছর উদযাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। সুতরাং যতকাল বাংলাদেশ নামক ভূখন্ড থাকবে ততকাল বেঁচে থাকবেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাশাপাশি চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে তার দেওয়া ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। আজকের দিনে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।