ভারপ্রাপ্তদের ভারে নু্যব্জ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অত্যন্ত বড় একটি প্রতিষ্ঠান। ডিগ্রি (পাস ও অনার্স) ও মাস্টার্স স্তরে পাঠদানকারী ২ হাজার ২০০-র মতো কলেজ এর অধিভুক্ত। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি। আকৃতি-প্রকৃতি, বিস্তৃতি ও কর্মপরিধি এ সবকিছু বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটি। অথচ শুনলে বা ভাবলেই যেন কেমন মনে হয়। আমাদের দেশ তো বটেই, সারা দুনিয়ায় বোধ করি এমন একটিও নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেউ কি বিশ্বাস করবেন, নাকি সহজে কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে যে দেশের অত্যন্ত সুপরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সুদীর্ঘ এক যুগ (১২ বছর) সময় ধরে চলছে একজন ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দিয়ে। যত বিস্ময়কর আর কৌতূহলোদ্দীপকই হোক, ঘটনা বা বিষয়টি বাস্তবে এমনই। একদিক থেকে বেশ মজারই ব্যাপার। আমাদের দেশে উপদেষ্টা, সিইসি (প্রধান নির্বাচন কমিশনার), পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি-জিএম বা ম্যানেজার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান- সব পাওয়া যায়; কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছাড়া! শুধু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তর নয়, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, রেজিস্ট্রার, কলেজ পরিদর্শন, গ্রন্থাগার দপ্তর, অর্থ ও হিসাব দপ্তর, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা দপ্তরসহ এমন অন্তত এক ডজন দপ্তর চালানো হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত বা অস্থায়ী হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে এবং তা বছরের পর বছর ধরে। সবারই জানা যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরজুড়ে ডিগ্রি (পাস), অনার্স ও মাস্টার্সসহ বিভিন্ন কোর্সে ও শ্রেণিতে একের পর এক পরীক্ষা লেগেই থাকে। একটির পর একটি পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশ করা, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন ও ফরম-পূরণ- এ সবকিছু নিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে, আর ভোগান্তি হয় শিক্ষার্থীদের। 'অস্থায়ী' ও 'ভারপ্রাপ্ত' শব্দ-দুটি একমাত্র আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য ও যথার্থ বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি। বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। পঁচিশে মার্চ রাত থেকে পাকবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা-অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনসহ ব্যাপক তান্ডবে কেবল গোটা বাঙালি জাতি নয়, বলতে গেলে সারা বিশ্ব হতবাক। অবরুদ্ধ দেশের মাটিতে চলছে অসম শক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই। সাধারণ মানুষ দিশাহারা। সম্পূর্ণ বৈরী ও এমনই দুঃসহ এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে ১০ এপ্রিল 'মুজিবনগর সরকার' গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাঁধে বর্তায় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার। তার নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ করে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সৈয়দ নজরুল ইসলামই ছিলেন রাষ্ট্রের 'ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি'। কিন্তু সেটা তো ছিল সময়ের প্রয়োজনে। জাতির ক্রান্তিকালে এর চেয়ে ভালো কোনো সিদ্ধান্ত বা বন্দোবস্ত আর সামনে ছিল না। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় হচ্ছেটা কী? বিভিন্ন সুদৃশ্য বহুতল ভবনের করিডোর দিয়ে হেঁটে যেদিকে তাকানো যায় যেন ভারপ্রাপ্ত আর ভারপ্রাপ্ত অথবা চলতি দায়িত্ব। পাঁচ বছর আগে যা, এখনো তা-ই! স্বভাবতই মনে প্রশ্ন দেখা দেয়- এ আবার কোন বন্দোবস্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হলেন বদরুজ্জামান। বছরের পর বছর ধরে তিনি 'ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক'। তার নাকি কোনো 'মেয়াদ-টেয়াদ' নেই। আছেন তো আছেনই। কখন থেকে তার ওপর বর্তেছে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বভার এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তবে বছর-দুই আগে (২০১৮) একবার বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গেলে বাইরে ফাঁকা জায়গায় সাধারণ দুজন কর্মচারীর মধ্যে কথোপকথনের সময় কিছুটা আঁচ করতে পারি। বেশ ক্ষোভের সঙ্গে অধীনস্ত তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির দুজন কর্মচারীর মধ্যকার কথোপকথনের রেশ যেন আমার কানে আজও ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়। জেনে খুবই বিস্মিত হয়েছি এবং আমি আশা করি আরও যারা জানতে পারবেন তারাও ঠিক আমার মতোই বিস্মিত হবেন যে ২০০৮ সাল থেকে ওই কর্মকর্তা বদরুজ্জামান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ভারপ্রাপ্ত' পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। সে হিসেবে পুরো এক দশক (দশ বছর) বা এক যুগ ধরে একই পদে তিনি আছেন দায়িত্বে (যে-কারও মনে কৌতূহল এবং বিস্ময়ের উদ্রেক হতেই পারে যে, দীর্ঘদিনে কেন একজন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দেওয়া হয় না; নতুুন কাউকে খুঁজে একেবারেই না পাওয়া গেলে যিনি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন তাকেই স্থায়ী করে নেওয়া হয় না)। কৌতূহল আর ধরে রাখতে পারিনি। নিজের চোখে দেখার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে, তিনতলায়। এ সময়টিতে তিনি ভেতরে না থাকায় কক্ষটি বন্ধ রয়েছে দেখতে পাই। বাইরে দেওয়ালে খুব মজবুত করে সাঁটানো সোনালি রঙে লেখা নাম ও পদবি দেখলে যে কেউ-ই আন্দাজ করতে পারবেন যে এ কোনো সাময়িক নয়, একেবারে শক্ত ও পাকাপাকি বন্দোবস্ত। আমাদের দেশে চাকরিতে সেই ইংরেজ আমল থেকেই বদলিব্যবস্থা চালু আছে। একই ব্যক্তি একই পদে তিন বছরের বেশি কিংবা বছরের পর বছর ধরে একই স্থানে থাকার সুবিধা-অসুবিধার কথাও নতুন করে বলার কিছু নেই। চিকিৎসক বা শিক্ষকদের বদলির প্রসঙ্গটি মাঝেমধ্যেই বেশ বড় পরিসরে আলোচনা-সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বিমল সরকার অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক বাজিতপুর