মশা প্রতিরোধে তিন কাজ

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
গত বছর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। মশা নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্কের শেষ নেই! ২০১৮ সালে চিকুনগুনিয়া নিয়ে বেশ আতঙ্কেই ছিল শহরবাসী। বছর বছর বেড়েই চলেছে মশাবাহিত রোগ ও রোগীর সংখ্যা। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঋতুবৈচিত্র্য ও বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন রোগের যেমন সম্পর্ক আছে, ফলে একই রোগ ভিন্ন ভিন্ন ধরন ও লক্ষণ নিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রভাব পড়ছে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার ওপর। আগে যেসব জায়গায় মশা টিকতে পারত না, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সেসব জায়গায় মশা অবস্থান করছে! আবার বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় এডিস মশার বংশবিস্তার বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় পানি জমে থাকার কারণে এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ডেঙ্গু ব্যাপকতা লাভ করছে! প্রকৃতপক্ষে মশা নতুনভাবে নতুন নতুন ঝুঁকি নিয়ে জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মশা ছোট্ট কীট হলেও এর আতঙ্কে প্রতিবছরই নগরবাসীকে ভুগতে হয়। মশার কামড়ে মানুষের মৃতু্য পর্যন্ত হচ্ছে! বাংলাদেশে ডেঙ্গু মশার ভয়াবহতা বিবেচনায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে হবে। মশা নির্মূলে প্রত্যেক বছর ব্যাপক বাজেট হয়, আলোচনা-সমালোচনা হয়, কিন্তু পরের বছর আবার সেই চিরচেনা আতঙ্ক! গত বছর কমবেশি সারা দেশে ডেঙ্গু আতঙ্ক ছড়িয়েছে! মশা নির্মূলে শুধু ওষুধ প্রয়োগে কাজ হবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই! তিনটি বিষয় এখানে বিবেচনায় আনতে হবে। বিষয়গুলো হলো- ১. সার্বিক পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাজ) ২. ওষুধ ছিটানো (কর্তৃপক্ষের কাজ) ৩. জনগণের দায়বদ্ধতা ও সচেতনতা (জনসাধারণের কাজ)। সার্বিক পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নগরের খাল, নালা, সব ধরনের জলাশয়, রাস্তাঘাট, পার্ক-উদ্যান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধে ওষুধ ছিটানোর কাজ কর্তৃপক্ষকে পরিকল্পিতভাবে এবং যথাযথভাবে করতে হবে। আরও যে কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো জনসচেতনতা। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। জনসাধারণকেই তাদের বাসাবাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখাসহ ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, পানির ট্যাংকের বহু দিনের জমে থাকা পানি, ছাদ বাগানের পানি, নারকেলের খোলায় জমে থাকা পানি, এসি-ফ্রিজে কয়েকদিনের জমে থাকা পানি পরিষ্কারসহ মশার বংশবিস্তারের সব ধরনের উৎসস্থল ধ্বংসে সচেতন হতে হবে। মশা নির্মূলে কলকাতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। বিজ্ঞানসম্মত লড়াই চালানোর ফলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেয়েছে কলকাতা। সেখানে কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি জনগণও সমানতালে এ ব্যাপারে সক্রিয়। কলকাতায় আইন করে কর্তৃপক্ষ জনগণকে বাধ্য করেছে ডেঙ্গু নিমর্ূলে অংশ নিতে। কলকাতায় ডেঙ্গু নির্মূলে জনসাধারণের গাফিলতি বা অবহেলা হলে জরিমানার বিধান সক্রিয় আছে। ঢাকাসহ প্রতিটি নগরে এমন কিছু করা যেতে পারে। ঢাকা শহরের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা বেশ নাজুক। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঢাকা শহর আজ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। জনঘনত্ব এ শহরে সর্বাধিক। একটু বৃষ্টি হলেই সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে পানি জমে যায়। শহরের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। দখল-দূষণে জর্জরিত হয়ে খালগুলো যেন এক একটি মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে! ঢাকার বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেম এখন ভারসাম্য হারাতে বসেছে! ব্যাঙ, চামচিকা, টিকটিকি এখন রাজধানী শহরে নেই বললেই চলে! এগুলো মশাকে খেয়ে ফেলত। ফলে মশার বংশবিস্তার কম হতো! পরিবেশ ও জলবায়ুগত অবস্থার কারণে ডেঙ্গুর ধরন বদলে যাচ্ছে! বিভিন্ন ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের কথা এখন শোনা যাচ্ছে। এখন এটা নিশ্চিত হতে হবে যে, ঠিক কোন ধরনের ভাইরাস এখন সক্রিয় রয়েছে। এটা নিশ্চিত হতে না পারলে সে অনুযায়ী ওষুধ ছিটানো যাবে না। মশা নির্মূলে কর্তৃপক্ষকেও নিজেদের জবাবদিহিতার জায়গাটাও পরিষ্কার করতে হবে! কেননা কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার চর্চা থাকলেও জনসাধারণও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে। বলে রাখা ভালো, সঁ্যাতসেঁতে বা উপযুক্ত পরিবেশে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা দুই বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তাই এখন ডেঙ্গু মশার ভাইরাস প্রতিরোধে শুধু বর্ষা মৌসুম বা মশার উৎপাতের সময়ে নয়, বছরব্যাপী ডেঙ্গু মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধে ধারাবাহিক অভিযান সক্রিয় রাখতে হবে। সার্বিক পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, ওষুধ ছিটানো, নাগরিক সম্পৃক্ততা এ তিনটি কাজ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধ হবে বলে মনে করি। মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে এ ব্যাপারে কার্যক্রম নেওয়া যেতে পারে। ওয়ার্ডের সদস্যসহ তরুণদের সম্পৃক্ত করে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা যেতে পারে। এ ছাড়া মশা নির্মূলে দেশব্যাপী সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সরাসরি সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজে লাগানো যেতে পারে। যা হোক, মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধে গণসচেতনতা ও সামাজিকভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সাধন সরকার পরিবেশকর্মী, ঢাকা