নারীর ক্ষমতায়ন: রোল মডেল বাংলাদেশ

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তথা সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার নারী। বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে নারী রয়েছেন, সচিবও রয়েছেন বেশ কজন। বিচারপতি, উপাচার্য, নির্বাচন কমিশনার, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তাও রয়েছেন নারী। বৈমানিক, নারী উদ্যোক্তা ও শিল্পপতিদের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত পর্যায়েও নারী রয়েছেন। বাংলাদেশে যে নারীর অগ্রগতি এর মূল কৃতিত্ব বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। নারী বিষয়ে তার উদারনৈতিক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অসাধারণ।

প্রকাশ | ১১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নব জাগরণ ঘটেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। নারীর স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের ক্ষেত্রে দেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন দেশ শাসন করে বিশ্বের শীর্ষ নারী শাসকদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে নারী সরকারপ্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দেশ পরিচালনায় তিনি পেছনে ফেলেছেন ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাজ্যের মার্গারেট থ্যাচার ও শ্রীলংকার চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার মতো জনপ্রিয় নেতাদের। আন্তর্জাতিক সংস্থা উইকিলিকস এক জরিপের ভিত্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। নারী হিসেবে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা ও বিশ্বে পরিচিতির দিক বিবেচনায় এ তালিকা করা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় ছিলেন। মার্গারেট থ্যাচার যুক্তরাজ্য শাসন করেছেন ১১ বছর ২০৮ দিন। চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুভাবেই ক্ষমতায় ছিলেন ১১ বছর ৭ দিন। আর চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ১৬ বছরেরও বেশি সময় পার করে ফেলেছেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং গত বছরের ৭ জানুয়ারি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। তার আমলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। আগে যেখানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল সাত থেকে আটশ ডলার, কয়েক বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে ১৯০০ ডলার ছাড়িয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছে নেদারল্যান্ডের নামকরা ডিপেস্নাম্যাট ম্যাগাজিন। সাময়িকীটি তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে শিরোনাম করেছে 'শেখ হাসিনা: মাদার অব হিউম্যানিটি'। প্রচ্ছদজুড়ে ব্যবহার করা হয়েছে শেখ হাসিনার ছবি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তথা সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার নারী। বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে নারী রয়েছেন, সচিবও রয়েছেন বেশ কজন। বিচারপতি, উপাচার্য, নির্বাচন কমিশনার, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তাও রয়েছেন নারী। বৈমানিক, নারী উদ্যোক্তা ও শিল্পপতিদের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত পর্যায়েও নারী রয়েছেন। বাংলাদেশে যে নারীর অগ্রগতি এর মূল কৃতিত্ব বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। নারী বিষয়ে তার উদারনৈতিক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অসাধারণ। নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর অন্তর্ভুক্তি তথা উন্নয়নের মূল ধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রথম উদ্যোগ ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সরকার গ্রহণ করে। সরকারি চাকরিতে মেয়েদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ অবারিত করে দশ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৭৩ সালে দুজন নারীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৭৪ সালে একজন নারীকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক করা হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সব ক্ষেত্রেই নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টিতেও সরকার গুরুত্বারোপ করেছে। আমাদের দেশে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ ইতিবাচক। এটা সত্য এখনো বন্ধ করা যায়নি নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন। পারিবারিক সহিংসতা আগের চেয়ে বেড়েছে। বেড়েছে ধর্ষণ গণধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনা। এমনকি আমাদের কোমলমতি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। ধর্ষণের পর তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। গণপরিবহণে দিনে দিনে বাড়ছে যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা, বাড়ছে ধর্ষণ গণধর্ষণ। এর ফলে দেশের সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০১৯ সালে গণপরিবহনে ৫২ ঘটনায় ৫৯ নারী ধর্ষণ ও যৌননির্যাতনের শিকার হয়েছে। দেশের সড়ক, রেল এবং নৌপথে এসব ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে ১৬টি ধর্ষণ, ১২টি গণধর্ষণ, ৯টি ধর্ষণের চেষ্টা, ১৫টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৪৪টি মামলা হয়েছে এবং ৯৩ জন গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া গণপরিবহণে যাতায়াতকালে নারীরা অসম্মানজনক আচরণেরও শিকার হচ্ছে। অবাক ব্যাপার- শুধু পরিবহণ শ্রমিক, চালক, হেলপার নয় কখনো কখনো সহগামী পুরুষযাত্রী দ্বারাও এ ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হতে হয় নারীদের। প্রকৃতপক্ষে ঘটনার ভয়াবহতা অনেক বেশি। রক্ষণশীল সমাজ হিসেবে বাংলাদেশের নারীদের লোকলজ্জা, সামাজিক মর্যাদা, মামলা করে হয়রানি এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অসংখ্য ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে। সোমবার বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গণপরিবহণে নারী নির্যাতন বন্ধে গণপরিবহণে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা জরুরি। চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারের আলাদা আলাদা নেইম পেস্নটসহ পোশাক বাধ্যতামূলক করতে হবে। চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারের নিয়োগপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিয়ে ডেটাবেইজ তৈরি করাসহ গাড়ির ভিতরে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের হটলাইন নাম্বার, ফোন নম্বর ও গাড়ির নম্বর লাগানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাশাপাশি গণপরিবহণের সংখ্যা বাড়ানো, বাস মিনিবাসে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন দরজার পাশে রাখা এবং গণপরিবহণে যৌন সহিংসতার মামলা, গ্রেপ্তার ও বিচার দ্রম্নত শেষ করার উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে সামাজিক অস্থিরতা ও বিচারহীনতার কারণেই যৌন সহিংসতা নির্যাতন ও হয়রানি বাড়ছে। অপরাধ করে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটি সংস্কৃতি দেশে চালু রয়েছে। যদিও সরকার এ ব্যাপারে বেশ কঠোর। এর পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ও একটা কারণ। এর আগে ২০১৭ সালে গণপরিবহণে চাঞ্চল্যকর রূপা গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দেশবাসী ফুঁসে উঠলে জনগণের তীব্র প্রতিবাদের কারণে স্বল্পতম সময়ে এ ঘটনার বিচার সম্পন্ন হয়। চার পরিবহণ শ্রমিককে ফাঁসি ও একজনকে সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়া হলে তৎসময়ে এ ধরনের ঘটনা কিছুটা কমে আসে। তবে বর্তমানে নিপীড়নকারী, ধর্ষক, হত্যাকারীদের মামলা, গ্রেপ্তার ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় এ ধরনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সমাজে নারীর অগ্রগতি হয়েছে এটা যেমন সত্য- একইভাবে সত্য পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির এখনো পরিবর্তন হয়নি। যার কারণে নারী ঘরে, বাইরে নির্যাতিত হচ্ছে। সমাজ পরিবর্তন মানে সামাজিক কাঠামো ও সমাজের মানুষের কার্যাবলি ও আচরণের পরিবর্তন। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন। বিশৃঙ্খল অপরাধপ্রবণ অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজে বসবাস করে উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া যায় না। এমন সমাজে হত্যা সন্ত্রাস যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ করা সহজ কাজ নয়। আমরা চাই, পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত সমাজ। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি, যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কোনোভাবেই আমাদের সমাজ যেন আলোর দিকে অগ্রসর হতে পারছে না। কূপমন্ডূকতা যেমন আমাদের সমাজকে দিন দিন গ্রাস করছে, তেমনি নারীর ক্ষেত্রেও যেন সমাজ দিন দিন আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। নিষ্ঠুরতার বলি হচ্ছে নারী। কোনোভাবেই তা রোধ করা যাচ্ছে না। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীরা নির্যাতন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হতে থাকবে- এটা যেখানে সমর্থনযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে দ্রম্নত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে এখন বলা হয় উন্নয়নের রোল মডেল, বলা হয় এশিয়ার বাঘ। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। একাত্তরের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ এক নয়। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দেশের বিদু্যৎ সংকট সিংহভাগই কেটে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান সরকার দেশের ইপ্সিত প্রবৃদ্ধির ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রাপ্তির হারও অনেক বেড়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। মাতৃমৃতু্য ও শিশুমৃতু্যর হার কমেছে। মুদ্রাস্ফীতি নেমে এসেছে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে। তথ্যপ্রযুক্তিতে, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক ভালো। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আশাব্যঞ্জক অবস্থানে রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে 'ভিশন ২০২১' ও 'ভিশন ২০৪১' কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার, যা সফল হওয়ার পথে। শুধু দেশেই নয়- আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর স্বীকৃতি মিলেছে। আমাদের এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। তবে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারত। এ ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা ও দুর্নীতি বড় বাধা। দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের বেতন দ্বিগুণ করেও কোনো লাভ হয়নি। তাদের লোভ ও মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুদকের বর্তমান তৎপরতার মাধ্যমে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। এর দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা অনেক কঠিন কাজ। এ জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। নারীর স্বনির্ভরতা অর্জন ও নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি নিমূল করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাশালী ও গর্বিত দেশ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সমহিমায় তার উজ্জ্বলতা নিয়ে, আমরা আশাবাদী। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক