বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গাইড-নোট ও কোচিংনির্ভর শিক্ষা

শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষাক্ষেত্রে সব ধরনের দুর্যোগ প্রতিরোধ অবশ্যই সম্ভব। দেশজুড়ে লাখ লাখ শিক্ষক যদি একযোগে কোচিং, নোট-গাইডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা সময়ের ব্যাপার।
সাধন সরকার
  ১৪ মার্চ ২০২০, ০০:০০

শিক্ষাক্ষেত্রে সৃজনশীল পদ্ধতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীর চিরন্তন ও কল্পনা শক্তির প্রসার, মুখস্থ প্রবণতা কমানো, গাইড-নোটের নির্ভরতা বন্ধ, কোচিংবাণিজ্যের দৌরাত্ম্য থামানো, নকল বন্ধ করা ইত্যাদি। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা হলো পরীক্ষানির্ভর বা নম্বরভিত্তিক তথা সার্টিফিকেট অর্জনই মুখ্য! বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মূল্যায়নের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো পরীক্ষার ফলাফল। ফলে যে করেই হোক, ভালো ফলাফল করতেই হবে। এখন প্রশ্ন হলো, কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীরা কেন যায়? কেন নোট-গাইড বই শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করে? কারণ হলো, কোচিংয়ে শিক্ষার্থীকে ভালো নম্বর বা ফলাফল তথা 'এ পস্নাস' পাওয়ার সব চেষ্টায় করানো হয়। কোচিংয়ে মূলত ক্লাস নেওয়া, সাজেশন দেওয়া, বিগত সালের প্রশ্নের ধরন অনুসারে গুছিয়ে নোট করে পড়াশোনা করা, কঠোর প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি, পরীক্ষা নেওয়া, হোমওয়ার্কসহ মাঝে মাঝে ফলাফলের ভিত্তিতে পুরস্কারও দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা বাজারের নোট-গাইডগুলোতে সাজানো-গোছানোভাবে মোটামুটি সহজ-সরলভাবে উত্তরগুলো পেয়ে থাকে। এ কারণেই মূলত শিক্ষার্থীরা কোচিং, নোট-গাইডের পেছনে দৌড়ায়! কোচিং সেন্টারের আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল- 'এ পস্নাস' পেতে বই লাগে না, গাইড হলেই যথেষ্ট! কিন্তু শিক্ষার্থীদের মূল ঠিকানা হওয়ার কথা তো সভ্যতার ফুল ফোটানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু কী এমন হলো যে, শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের দারস্থ হতেই হচ্ছে। এর কারণ কী পরীক্ষানির্ভর ভালো নম্বরের অসুস্থ প্রতিযোগিতা? কাছের একজন অভিভাবকের কাছ থেকে শুনেছিলাম দুটি সন্তানের কোচিং খরচ আর বিভিন্ন নোট-গাইড বই দিতে প্রত্যেক মাসে তাদের উপার্জনের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি টাকা চলে যায়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ক্লাস হয় না, পাঠদান আনন্দদায়ক হয় না, সহজ-সরল ভাষায় বোঝানো হয় না, এমন অনেক কথা মাঝেমধ্যেই শোনা যায়! এমনকি অনেক শিক্ষকের কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও শোনা যায়। আমাদের দেশের বইগুলো এক বছরের জন্য তৈরি করা হলেও সে অনুযায়ী পড়ানোর সুযোগ হয় না। তার বিভিন্ন কারণও রয়েছে। এর পেছনে প্রাপ্য ছুটিছাটা, শুক্রবার, বিভিন্ন সময়ে পাবলিক পরীক্ষা, পাঠদান বহির্ভূত কাজকর্ম, শিক্ষকসল্পতাসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান কম হওয়ার ফলে পাঠ্যবই নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা যায় না! ফলে এখন বেশি বেশি নম্বরের আশায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছে নোট-গাইড বই আর কোচিংয়ের পেছনে। আবার পাঠ্যপুস্তকগুলো সহজ-সরল না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ের শরণাপন্ন হচ্ছে। কোচিংয়ে ভালো নম্বর পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বৈকি! কিন্তু শুধু মুখস্থ করার ফলে শিক্ষার্থী কিছুই শিখতে পারছে না, শুধু সাময়িক সময়ের ভালো সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য না বুঝেই পড়া গিলছে। কোচিং, নোট-গাইড বইয়ের প্রসার হওয়ার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। লাখ লাখ দরিদ্র শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে বৈষম্য, ফলে অনেকে ঝরে পড়ছে। সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে এখনো অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের মনে আতঙ্ক কাজ করে! আবার এও শোনা যায়, অনেক শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি পুরোপুরি বোঝেন না! আবার সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে! আর তাই যদি না হবে তাহলে কেন নোট-গাইডের প্রশ্ন হুবুহ পাবলিক পরীক্ষায় দেওয়ার অভিযোগ আসে! অনেক শিক্ষকও গাইডের ব্যবহার করেন, গাইডের দারস্থ হন। বর্তমান বাস্তবতায় লেখাপড়ার ধরন বদলেছে কিন্তু বইয়ের ধরন কি বদলেছে? তবে বইগুলো কেন আরও সহজ-সরলভাবে তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় না। নির্দিষ্ট শ্রেণির নির্দিষ্ট বইগুলোর ৫০ ভাগ লেখা বা বিষয় ওই শ্রেণির শিক্ষার্থী যেন একা নিজে নিজেই যাতে পড়তে পারে তেমন হওয়া দরকার। ২০১২ সালে কোচিংবাণিজ্য বন্ধের আদেশ বা নির্দেশনা জারি হলেও কোচিংবাণিজ্য সবার চোখের সামনেই হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে যারা 'এ পস্নাস' পাচ্ছে, যারা খুব ভালো ফলাফল করছে এদের মধ্যে এমন কাউকে কী পাওয়া যাবে যারা নোট-গাইড পড়েনি, কোচিং করেনি? উত্তর হলো 'না'! ভাবলাম এ মুহূর্ত থেকে কোচিং, নোট-গাইড বন্ধ হয়ে গেল; তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কি নিয়মিত, সহজ-সরল ও শিক্ষার্থীবান্ধব পাঠদান হবে?

প্রশ্ন জাগে, শহরের শিক্ষার্থীরা এখন কোথায় বেশি সময় দিচ্ছে, আনন্দ পাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাকি কোচিং সেন্টারে? বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোচিংবাণিজ্যের বেশি অভিযোগ শোনা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির পর কোচিং সেন্টারের পেছনে ছুটতে ছুটতে শিশু-কিশোরদের শৈশব-কৈশোরগুলো জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ভালো ফলাফলের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে শিক্ষার্থীদের জীবনে অন্যসব প্রতিভাও চাপা পড়ে যাচ্ছে। টাকা ঢেলে কোচিংয়ের দারস্থ হয়ে না বুঝে কোনো রকমে মুখস্থ করে বর্তমান বাস্তবতায় ভালো ফলাফল করা যাবে সত্য তবে মানহীন পড়া ও বইয়ের পড়া না বুঝে পড়ার ফলে পরবর্তী জীবনে তার নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে নোট-গাইড, কোচিং সেন্টার কখনো মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না। আমরা নোট-গাইড, কোচিংয়ের বিরুদ্ধে বলি কিন্তু এগুলো যখন তৈরি হয়, গড়ে ওঠে তখন কর্তৃপক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয় না! প্রশ্ন হলো, কেন বাজারজুড়ে নিষিদ্ধ মানহীন গাইডের ছড়াছড়ি? গাইড-নোট, কোচিং সেন্টার আগেও নিষিদ্ধ ছিল (যদিও এখন শিক্ষা আইনের খসড়া নীতিমালায় শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে!), এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে বলে মনে হয় ! তবে বিদ্যমান শিক্ষা আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োগ না হওয়ায় এসব সবার সামনেই চলছে (যদিও নোট-গাইডের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হলে ব্যবসায়ীরা নোট-গাইডকে সহায়ক বই হিসেবে চালিয়ে দেয়!)। নিষিদ্ধ নোট-গাইড ও কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে একটা গণজাগরণ দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত পাঠদান হলে, দেশের সব শিক্ষকরা নোট-গাইড ও কোচিংয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে, শিক্ষকরা যদি শিক্ষার্থীদের পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শেষ করে দেয় ও দেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং অভিভাবকদের সচেতন হয় তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে কোচিং, নোট-গাইডের চিরতরে অবসান সম্ভব।

শিক্ষা ও শিক্ষকতা পেশা পৃথিবীর অন্য সব পেশার চেয়ে ভিন্ন ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশা। পৃথিবীর সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সর্ব্বোচ মেধাবীরাই শিক্ষকতা পেশায় আসে, কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশায় মর্যাদা ও অন্যান্য সুবিধাদি কম হওয়ার কারণে সর্বোচ্চ মেধাবীরা আসতে চান না! শিক্ষাক্ষেত্রে ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করতে হলে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আনতে হবে। সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা দরকার, আইনের বাস্তবায়ন দরকার। তা না হলে লোক দেখানো আইন করে কোনো লাভ হবে না। শিক্ষাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের চোখে না দেখে জাতি গঠনের হাতিয়ার হিসেবে দেখতে হবে। দেশজুড়ে কোচিং, গাইড-নোট বন্ধ করতে হলে কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়া দরকার। ১. পাঠ্যপুস্তক বোধগম্য ও পাঠদান পদ্ধতি সহজ-সরল হতে হবে। ২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পাঠদান হতে হবে, প্রতিদিনের পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই বুঝিয়ে দিতে হবে। ৩. শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো প্রস্তুত, সর্বোচ্চ মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আনা ও মর্যাদা দিতে হবে। ৪. শিক্ষাক্ষেত্রে নোট-গাইড ও কোচিং বন্ধে বিদ্যমান আইন, বিধিমালা ও আদেশের প্রয়োগ করতে হবে, নতুন করে কোনো কোচিং সেন্টার যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে এবং বাজারে পাওয়া নোট-গাইড বইয়ের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কয়েক দফায় সুযোগ দিয়ে আইন না মানলে সবশেষে সিলগালা করে দিতে হবে। ৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীবান্ধব আনন্দদায়ক পাঠদানের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ৬. শিক্ষাব্যবস্থা শুধু পরীক্ষানির্ভর না করে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর জোর দিতে হবে। ৭. শুধু পরীক্ষায় নয়, খেলাধুলায়, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ও অন্যান্য সহশিক্ষাক্রম কার্যাবলিতে নম্বর বণ্টন করতে হবে। ৮. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকস্বল্পতা দূর করতে হবে। ৯. সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান ও প্রশ্নপত্র তৈরিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলমান রাখতে হবে। ১০. শুধু লাগামহীন নম্বরের পেছনে ছুটে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীর শৈশব-কৈশোর না হারিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের ভরসা রাখতে হবে। সরকার দেশের স্বার্থে অনেক বড় বড় কাজ সম্পন্ন করেছে; তাই কোচিং, গাইড-নোট বন্ধে দরকার দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ধারাবাহিক-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষাক্ষেত্রে সব ধরনের দুর্যোগ প্রতিরোধ অবশ্যই সম্ভব। দেশজুড়ে লাখ লাখ শিক্ষক যদি একযোগে কোচিং, নোট-গাইডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা সময়ের ব্যাপার।

\হ

সাধন সরকার : কলাম লেখক ও পরিবেশকর্মী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<92388 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1