করোনাভাইরাস

প্রকাশ | ১৫ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
করোনাভাইরাস মার্চের ৮ তারিখে প্রথম শনাক্ত হলো আমাদের দেশে। তার মানে এই ভাইরাসের প্রতিকার, প্রতিরোধ ও করণীয় নিয়ে আমরা ১১০ দিনের বেশি সময় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পেরেছি। তাছাড়া এই ভাইরাসটি আবির্ভাবের পর আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও একজন বাংলাদেশির মৃতু্য হয়নি। অন্যদিকে গতকালের আগের দিন সড়ক দুর্ঘটনায় একদিনেই ৩০ জন মানুষ মারা গেছে। শুধু ফেব্রম্নয়ারিতে মারা গেছে- ৫৩৪ জন। আমি কিন্তু কাউকে বাস-ট্রেন বা গণপরিবহণে আতঙ্কিত হতে দেখি না, এমনি দেখি নাই কেউ আতঙ্কিত হয়ে বাস-ট্রেন বা গণপরিবহণে হেলমেট বা সেইফ ইন্সট্রুমেন্ট পরে বসে আছে। একই দিনে আমি দেখলাম নৌকা ডুবিতে নববধূসহ ৯ জন মারা গেছে। আপনি জানেন, ওহঃবৎহধঃরড়হধষ রহলঁৎু ৎবংবধৎপয ঁহরঃ-এর তথ্য অনুসারে প্রতিদিন বাংলাদেশে ৩২ জন শিশু পানিতে পড়ে মারা যায়, কই আমরা তো দেখি নাই লঞ্চ বা নৌকায় কেউ লাইফ গার্ড বা বয়া নিয়ে বসে আছে। কারণ এই মৃতু্য সংবাদগুলো আমাদের কাছে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে অথবা অনেকেই প্রকৃত সংখ্যাটাই জানিনা। অন্যদিকে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের সংবাদগুলো গণমাধ্যম প্যানিক তৈরির মতো উপস্থাপন করছে। আজ পর্যন্ত ১১০ দিনে ১১৫ দেশে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪০০০-এর কিছু বেশি মানুষ মারা গেছে অথচ এরকম ফ্লু-জাতীয় রোগে বিশ্বে প্রতিবছর ৪-৫ লাখ মানুষ মারা যায়। আজ গণমাধ্যমের প্যানিকে আমরা ৭০০ কোটি মানুষ আছি। সারা বিশ্বে আক্রান্ত রোগীর মাত্র ১-২% মারা যাচ্ছে (সূত্র বিবিসি) তাও আবার ষাটোর্ধ্ব ও বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। এখন পর্যন্ত শুনিনি একটি শিশুও (১২ বছরের নিচে) মারা গেছে (সূত্র ডঐঙ) অথচ আমরা তাদের নিয়েই বেশি চিন্তায় আছি। ভাই দুশ্চিন্তা, হতাশা বা আতঙ্ক আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই আতঙ্কিত না হয়ে আত্মবিশ্বাসী ও সচেতন হতে হবে। হুজুগে বাঙালি আমরা: গত ২/৩ দিনের নিউজে দেখেছি মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার সংকট তৈরি হয়ে গিয়েছে যা খুবই দুঃখজনক। আমরা যদি এগুলো প্রয়োজন অতিরিক্ত কিনি তবে কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে তখন দরিদ্র মানুষ প্রয়োজনে এগুলো না পেয়ে আক্রান্ত হবে তখন কি আপনি বা আমি নিরাপদ থাকব। কারন আমাদের বাড়ির দারোয়ান, কাজের বুয়া, ড্রাইভার বা অফিসের আয়া, পিয়ন আক্রান্ত হলে আমরা কি বাঁচতে পারব। সংক্রমণ রোগগুলো সবাইকে নিয়ে এগোতে হবে, আমি একা বা আমার পরিবার নিয়ে ভালো থাকব এই চিন্তা করলে শেষ। উদাসীন হলে সর্বনাশ: চীনের বাইরে ইতালি, কোরিয়া বা ইরানে আমাদের মতোই ৩-৪ জন রোগী ছিল কিন্তু সংক্রামক ঠিকমতো চিহ্নিত/নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বলে আজ সেখানে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। আমরাও যদি ভাবী- মাত্র তো ৩ জন তবে আমাদের অবস্থা ওই ৩ দেশ থেকেও ভয়ঙ্কর হবে। কারণ আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত তাদের মতো উন্নত নয়। কীভাবে ছড়ায়: করোনাভাইরাসটি বাতাসে বিচরণ করতে পারে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি-কাশির সময় যে ড্রপলেট (পানিজাতীয় ফোঁটা) হয় তার ১ মিটারের মধ্যে কেউ থাকলে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। ভাইরাসটি মূলত রোগীর শরীর থেকে হাঁচি-কাশি অথবা স্পর্শের মাধ্যমে কোনো একটি মাধ্যমে/সার্ফেসে অবস্থান করে (বাতাসে নয়) যদি আক্রান্ত ব্যক্তি কাউকে টাকা দেয়, ফ্যান/লাইট/কলিং বেল বা যে কোনো সুইচ বা লিফটের সুইচ, কোনো ফলের দোকানে ফল বা সবজি স্পর্শ করল, ব্যাংকে ব্যবহার করা সবার জন্য কলম বা নিজের কলম, গেটের হ্যান্ডেল, দরজার হ্যান্ডেল, সিঁড়ির রেলিং, গাড়ি বা বাসের হ্যান্ডেল বা যে সিটে সে বসে, রিকশায় বসলে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস, ব্যাংক বা দোকানের প্রবেশ পথের দরজার হ্যান্ডেল, সুপারশপের ব্যবহৃত ট্রলি, আক্রান্ত ব্যক্তি যদি কোনো অফিসের ডেক্স বা ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টার স্পর্শ করে ব্যবহার করে, ওয়াস রুমের ব্যবহৃত কল, কমোড, পুশ সাওয়ার ইত্যাদি ব্যবহার করে, ধূমপায়ী হলে সিগারেট শেয়ার করলে, হোটেলের খাবার টেবিল, জিম বা ব্যায়ামাগারে একই ইন্সট্রুমেন্ট, মসজিদ বা মন্দিরের সিজদার জায়গা, স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেঞ্চ বা বসার জায়গা, সেলুনের কাঁচি, চিরুনি, বা সেভিং উপাদান স্পর্শ করলে। হাত ধোয়া ছাড়া নাক-মুখ-চোখে হাত দিলে বা কোনো খাবার গ্রহণ করলে সুস্থ ব্যক্তিও আক্রান্ত হয়ে যাবে। মুরগি, মাছ-মাংস, ডিম বা কাঁচা সবজি বা ফল স্পর্শ করলে দ্রম্নত হাত ধুতে হবে এবং এগুলো খাওয়ার সময় উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করতে হবে। উপরোলিস্নখিত কোনো কিছু বা নতুন কোনো মাধ্যম বা সার্ফেসে স্পর্শ করলে হাত ধোয়া ছাড়া নাক-মুখ-চোখ হাত দেওয়া যাবে না অথবা কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। সর্বোপরি পরিধানের কাপড় থেকে যাতে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে সেজন্য কাপড়ের ওপর অ্যাপ্রোন পরে থাকা উচিত ঘরে প্রবেশের সময় ব্যবহৃত অ্যাপ্রোনটি দরজার বাইরে স্থাপিত বক্স রাখুন অথবা জীবানুমুক্ত করে ঘরে ঢোকান (লেখকের ব্যক্তিগত মত) মোবাইল ও টাকা কি ভাইরাসকে ঘরে পৌঁছাচ্ছে : বাইরে বিভিন্ন কাজে আমরা যখন ব্যস্ত তখন আমরা (সম্ভাব্য) কোভিড-১৯ ভাইরাসে হাত দিচ্ছি যেমন বিভিন্ন সুইচ, লিফটের সুইচ, কলিংবেল, দরজার হ্যান্ডেল, সিঁড়ির রেলিং আর এরই মধ্যে মোবাইলে বিভিন্ন কল ডায়াল বা রিসিভ করছি আর মনে মনে ভাবছি হাত ধুয়েই রক্ষা পাবো আসলে কি তাই? মোবাইলটা তো ইতোমধ্যে সংক্রমিত হয়ে গেছে যাতে পুনরায় হাত দিয়ে অযাচিত মনে আমরা হাত, নাক, মুখ বা চোখ ব্যবহার করছি (লেখকের ব্যক্তিগত মত)। অন্যদিকে পকেটে থাকা ভিজিটিং কার্ড, কাগজ, টাকা বা কলম জীবাণুমুক্ত করে ঘরে না ঢুকালে কোভিড-১৯ কে আমন্ত্রণ করে ঘরে ঢুকানোর সামিল। থুথু বা হাঁচি-কাশি কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ: আক্রান্ত ব্যক্তির থুথু বা হাঁচি-কাশির ড্রপলেট বা জলীয় ফোঁটার মাধ্যমে কোভিড-১৯ ভাইরাস সার্ফেস বা কোনো মাধ্যমে অবস্থান করে দীর্ঘ সময় সক্রিয় থাকে। যেমন : আক্রান্ত ব্যক্তি হাতের স্পর্শে হাঁচি দিয়ে টাকা স্পর্শ করলে পরবর্তীতে সুস্থ মানুষ ওই টাকায় সংক্রামক হবে। থুথু হয়তো বা মানুষ এড়িয়ে যাবে কিন্তু পশু-পাখি অর্থাৎ বিড়াল, কুকুর, চড়ুই, কাক, মুরগি থুথু খেয়ে বা গায়ে-পায়ে লাগিয়ে সংক্রমিত হবে। পরে আমাদের পোষা পাখি বা গৃহপালিত কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল এদের মাধ্যমে আক্রান্ত হবে অতঃপর আমরাও এদের কাছ থেকে আক্রান্ত হবো। বাড়িতে ভাইরাসকে ঢুকতে না দেওয়া: ধরতেই পারি আপনার ঘর এখনো ভাইরাসমুক্ত নিজেদের ঘরে যাতে কোনোভাবেই কোভিড-১৯ ভাইরাস না ঢুকতে পারে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। বাইরে ব্যবহৃত জুতা-মোজা বা পোশাক (পোশাকের ওপর ব্যবহৃত অ্যাপ্রোন) দরজার বাইরে রক্ষিত ঢাকনা যুক্ত বক্সে রাখা অথবা জীবাণুমুক্ত করে ঘরে ঢুকানো। প্রতিদিনের বাজার যেমন কাঁচা ফল, সবজি, মুরগি, ডিম ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করে ঘরে প্রবেশ করাতে হবে। বাড়ির বুয়া, ড্রাইভার, দারোয়ান বাইরের পরিবেশে থাকায় এরা আক্রান্ত হলে আমরাও আক্রান্ত হবো তাই প্রতিদিন এদের স্পর্শের জায়গাগুলোর ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং তাদের জীবাণুমুক্ত করে বাসায় প্রবেশ করানো। খোলা খাবার এড়িয়ে যাওয়া: খোলা খাবার তৈরিকারী বা বিক্রিকারী সংক্রমিত হলে সুস্থ মানুষের সংক্রমণের ঝুঁকি প্রকট। তাছাড়া প্যাকেটজাত খাদ্য/পণ্য উপরের প্যাকেট যেমন : চিপস, বিস্কুট, শ্যাম্পু ইত্যাদির প্যাকেট প্রথমে জীবাণুমুক্ত করা। তা ছাড়া খাবার পরিবেশনে রিইউজেবল পাত্রগুলো যেমন- পেস্নট, গস্নাস, চামচ ইত্যাদি শুধু পানি দিয়ে পরিষ্কার করলে হবে না বিশেষ করে গস্নাস সাবান দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে সুনিশ্চিত। সিজদার ক্ষেত্রে টিসু্য: আমাদের নাক শুধু সিজদার সময় মাটিতে পৌঁছে তখনি ফ্লোরে থাকা কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশে ৮৮.২% লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী প্রায় ১০.৭০% লোক হিন্দু অর্থাৎ প্রায় ৯৯% লোক হিন্দু-মুসলিম (তথ্যসূত্র উইকিপিডিয়া)। এদের মধ্যে (হিন্দু-মুসলিম) বেশিরভাগ ধর্মভীরু যারা সারাদিনে একবার হলেও সিজদায় যায়। তাই সিজদায় যাওয়ার মুহূর্তে সিজদার জায়গায় টিসু্য ব্যবহার করা। কি করণীয়: ১। করোনাভাইরাস কীভাবে সংক্রমিত হয় বা বিস্তার করে এবং কীভাবে তা রোধ করা যায় সে সম্পর্কে পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, অধস্তন, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আলোচনা করা। ২। বাড়ি বা অফিসে সাহায্যকারী আয়া-বুয়া, দারোয়ান, ড্রাইভার ইত্যাদি পেশার বা অন্যান্য বহিরাগত ব্যক্তিদের জীবাণুমুক্ত করে কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানো উচিত। ৩। কোনো কিছু খাওয়ার আগে অথবা নাক-চোখ ও মুখে হাত দেওয়ার আগে হাত জীবাণুমুক্ত বা ধোয়া আবশ্যক। ৪। যেখানে-সেখানে থুথু ফেলা যাবে না। হাঁচি-কাশির সময় হাতের কনুই অথবা টিসু্য ব্যবহার করে ঢাকনাযুক্ত ময়লা ফেলার স্থানে ফেলতে হবে। ৫। কাঁচা ফল ও খোলা খাবার খাওয়া ত্যাগ করতে হবে। ৬। ব্যক্তিগত ওয়াসরুম ব্যবহার করুন। পাবলিক গাড়ি, পাবলিক প্যালেস, পাবলিক টয়লেট, জনসমাগম, হোটেল, সেলুন, জিমনেশিয়াম হাসপাতাল এড়িয়ে চলুন। ৭। মাংস ও ডিম পরিপূর্ণ তাপমাত্রায় রান্না করুন। ৮। ঠান্ডায় আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকুন। ৯। কুকুর, বিড়াল, মুরগি বা অন্যান্য পশু-পাখি খালি হাতে স্পর্শ না করা। ১০। বাইরে যাওয়ার সময় সম্ভব হলে অ্যাপ্রোন ব্যবহার করা এবং ব্যবহৃত অ্যাপ্রোন বাইরেই রাখা অথবা জীবাণুমুক্ত করে ঘরে নেওয়া। (লেখকের ব্যক্তিগত মত) ১১। শারীরিক স্পর্শ এড়িয়ে যেতে হবে কোলাকুলি, হ্যান্ডশেক, হাইফাইভ কঠোরভাবে এড়াতে হবে। ১২। সিজদার জায়গায় টিসু্য দিয়ে সিজদা দেওয়া। ১৩। প্যাকেটজাত খাদ্য/পণ্যর প্যাকেট বা নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার সদাই জীবাণুমুক্ত করে ঘরে ঢুকানো। সবশেষে যে কথাটি বলতে চাচ্ছি প্রতিবেদনটি তৈরির সময় সংবাদে শুনছিলাম আওয়ামী লীগ বলছে করোনাভাইরাস নিয়ে বিএনপি অপরাজনীতি করছে। এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি কাদা ছোড়াছুড়ির সময় নয়- জাতীয় সংকটের মুখোমুখি আমরা। ভয়ঙ্কর এই সংকট মোকাবিলার জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সম্মিলিতভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হবে। 'চলুন নামি যুদ্ধে করোনার বিরুদ্ধে' নাজমুল হক বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঢাকা