অপ্রাসঙ্গিক ভাইরালপ্রবণতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতির কারণ হবে

প্রকাশ | ১৫ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ভাইরাল শব্দটি বর্তমান সময়ে সব থেকে বেশি ব্যবহৃত একটি শব্দ যেটি একই সঙ্গে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক অথবা অপ্রাসঙ্গিক কোনো বিষয়ের হতে পারে। মূলত ইংরেজি ভাইরাস থেকে আসা এ শব্দটির মানে হলো ভাইরাসজনিত। আবার এর আরেকটি অর্থ রয়েছে যেটির মানে দাঁড়ায় ব্যাপকভাবে অনলাইনে প্রচার। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে- ২০১৭ সালে গুগল, ইউটিউব, ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দগুলোর মধ্যে 'ভাইরাল' একটি। বর্তমান অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতাপের এই যুগে অনেক বিষয় মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে পড়ছে খুব সহজে। লোকে সেই ভাইরাল হওয়া বিষয় নিয়ে হাসাহাসি, মজা, সমবেদনা, ভর্ৎসনা, গালাগাল যা ইচ্ছা করছে। এই ভাইরাল হওয়া বিষয়ের কল্যাণে কেউ নিতান্ত পথের মানুষ থেকে হয়ে যাচ্ছে প্রাসাদের মানুষ। অখ্যাত জন থেকে বিখ্যাত বা ঠিক তার উল্টোটা। কিছুদিন আগেই অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলার সময় আমরা দেখেছিলাম একটি ইতিবাচক ভাইরালের নমুনা। ড. ফ. র সিদ্দিকী, ভিন্ন চিন্তাধারায় লিখতেন বলে তার বই বছরের পর বছর ঘুরেও কোনো প্রকাশক পাচ্ছিল না। বিষয়টি কেউ একজন ফেসবুকে পোস্ট করলে মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায় সেটি এবং পরে বইটি প্রকাশ করার জন্য অনেক প্রকাশক আগ্রহ দেখায় এবং প্রকাশিতও হয়। এ ধরনের ইতিবাচক ভাইরালের মাধ্যমে সমাজ অনেক বেশিই উপকৃত হতে পারে। মেধাবী, সৃষ্টিশীল, বঞ্চিত মানুষের প্রাপ্য মর্যাদা এবং অধিকার ফিরিয়ে দিতে এ ধরনের ভাইরাল নিয়ামকের ভূমিকাটি পালন করে থাকে। মূলত এর উল্টো দিকটিই আমরা আজকে দেখবো। কেননা ভাইরাল যেমন ইতিবাচক বিষয় নিয়ে হতে পারে ঠিক এই ভাইরাল হতে পারে নেতিবাচক অথবা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের উপরেও। কিছুদিন আগেই পত্রিকায় একটি ছোট নিবন্ধ পড়ছিলাম যেটি লিখেছিলেন একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তিনি ক্লাস নিতে গিয়ে কোনো এক শিক্ষার্থীর পড়া না পড়ে আসার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলেন তার কি শাস্তি হওয়া উচিত। পেছন থেকে আরেক ছাত্র ফস করেই বলে ফেললেন 'মদ খা'। শিক্ষক বিস্মিত হলেন; কিন্তু বুঝতে পারলেন এখনকার প্রজন্ম খুব অল্প বয়সেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে পরিচিত এবং এই মাধ্যমগুলোর কল্যাণে তারা ইতিবাচক বিষয়ের পাশাপাশি অনেক নেতিবাচক বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। অনেকে মজার ছলে বা গুরুত্বহীন মনে করে আবার অনেকে খুব ভেবে-চিন্তে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অবগত হয়েও এমন কিছু বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে যা কেউ কেউ হয়তো শুধু মজা করার জন্যই গ্রহণ করছে; কিন্তু নতুন প্রজন্মের মধ্যে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যেটি ভবিষ্যতে মানবিক মূল্যবোধ এবং আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সুস্থ ধারাকে ব্যাহত করবেই করবে। যে কথাটি বলছিলাম, একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থী যখন শিক্ষককে 'মদ খা' শব্দটি বলতে পারে তখন বুঝতে আর দেরি হয় না যে সমাজে সে শব্দটির প্রচলন কতটা সাবলীল বা বহুল উচ্চারিত হয়ে গেছে। ঠিক তাই, আমাদের সমাজের কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষ আছে যাদের কারণে আমাদের নতুন প্রজন্মের এই অবক্ষয়ের পথটি সব থেকে বেশি অবারিত হচ্ছে। এই বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষগুলো অন্য কারও সমালোচনা করতে গিয়ে কোনো প্রাসঙ্গিকতার বালাই না রেখে যাচ্ছেতাই গালাগালা করে আর আমাদের ভাইরাল প্রজন্মের কল্যাণে সেটি হাসি-ঠাট্টার খোরাক হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যখন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেখছে যে কারও সমালোচনা মানেই গালাগাল তখন তারা সেটাকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। আবার এটা গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা আশপাশের মানুষ থেকে নিষেধাজ্ঞার বদলে কিছুটা সমর্থনও পাচ্ছে। একটা সময় যারা শিখত কাউকে গালি দেয়া যাবে না, কেউ কোনো ভুল করলে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এখন তারা সেটি না করে এমন সব অসামাজিক গালির চর্চা করেছে যা আমাদের সমাজেও ধীরে ধীরে একটা স্বাভাবিক জায়গা করে নিচ্ছে। মানুষের মধ্যে এই শব্দগুলোর একটা চলনসই মান এসে গেছে। এখন আর সেগুলোকে কেউ তেমনভাবে নিষেধও করছে না। সেফাত উলস্নাহ নামক একজন মাত্র ব্যক্তির এই মস্তিষ্ক বিকৃতির লজ্জাহীন আস্ফালন আমাদের একেবারে নতুন অল্প বয়সি প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে একটা শক্তিশালী জায়গা দাঁড় করিয়ে তাদের এই অবনতির দিকে ঠেলে দেয়ার পেছনে সব থেকে বড় দায়টি আমাদের ভাইরাল প্রজন্মের নিতে হবে। একদিকে যেমন একজন বিজ্ঞানীর অবহেলায় পড়ে থাকা পান্ডুলিপির অক্ষরগুলো নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পাওয়ার কৃতিত্ব তারা পাবে তেমনি সামাজিক অবক্ষয়ের নেপথ্যে ভূমিকা রাখা নানা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের ভাইরালে আমাদের আগামী প্রজন্মের বিপথগামী হওয়ার দায়ও তাদেরই বহন করতে হবে। আমরা এখানে মাত্র দুটি বিষয়ের উলেস্নখ করলাম; কিন্তু এরকম আরও অহরহ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের ভাইরাল অতীতে এবং সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে চলেছে। 'মদ খা' শব্দটি যেমন নতুনদের মধ্যে নেতিবাচক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে তেমনি এখনো কারও কোনো বিষয়ের সঙ্গে বা মতের অমিল হলে যে শব্দটি সব থেকে বেশি শোনা যাচ্ছে সেটি হলো 'ওরে বাটপার, ওরে চিটার'। দুই মাওলানা সাহেবের মতের অমিলের সূত্র ধরে প্রসব করা এই 'ওরে বাটপার বা ওরে চিটার' শব্দদ্বয়ের প্রয়োগকে আমরা তীব্রভাবে নিন্দা জানাই কিন্তু তার থেকে আরও শতগুণ নিন্দা জানানো প্রয়োজন এই শব্দদ্বয়ের বহুল এবং বহুমুখী নেতিবাচক ব্যবহারকে। আমরা এমন একটা সময়ে বসবাস করছি যেখানে শিক্ষক তার ছাত্রকে, বন্ধু বন্ধুকে, ভাই তার ভাইকে, পথচারী রিকশাওয়ালাকে, মালিক শ্রমিককে বলছে 'ওরে বাটপার, ওরে চিটার'। এমনকি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমাদের ছেলেমেয়েদের টি-শার্টের গায়েও এখন এই শব্দদ্বয়ের স্থান দেখে ভাবতে বাধ্য হই আমরা যে সমাজে বসবাস করে চলেছি সে সমাজ গন্তব্য কোথায়? আমরা শুধু এখানেই থেমে থাকিনি, আমাদের মানসিকতা যে কতটা অনুকরণপ্রিয় সেটা আগে থেকেই আমরা কিছুটা জানি। প্রত্যেক বিষয়েই আমরা অন্যকে অনুসরণ করতে পছন্দ করে থাকি সেটা হোক সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক। ইদানীং ফ্যাশন আর লাইফ স্টাইলে সব থেকে অনুকরণ প্রিয়তার নজির আমরা রেখেছি। কিন্তু সাহিত্য বিকৃতির একটা বড় পরিসর কান্ড আমরা ঘটিয়ে ফেলব অন্যের দেখাদেখি সেটা বোধকরি কেউ কল্পনা করেননি। আর এটি করতেও সাহায্য করেছে আমাদের অপ্রাসঙ্গিক ভাইরাল প্রজন্মের অনুকরণ প্রিয়তা। পশ্চিমবঙ্গের রোদ্দুর রায় নামক যে ব্যক্তিটি নেশা করে অশ্লীল কিছু শব্দ প্রয়োগে কবিতা রচনা করে চলেছে সেখানে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। কারণ সে কবিতা লিখতে পারে হোক সেটা অশ্লীল। কিন্তু বিপত্তিটা এখানে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সঙ্গে কিছু অশ্লীল শব্দের যোগ করে যে গানটি গাইলেন। রাতারাতি তা ভাইরাল হলো এবং সেই গান আমাদের প্রজন্মও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস রুম, পিকনিক পার্টিতে, বন্ধুদের আড্ডায় সবখানেই গেয়ে চলেছেন। অনেকে হয়তো বলবেন ভাইরাল না হলে তো এই বিষয় নিয়ে কারও মাথাব্যথা থাকত না তাহলে এখন কেন এ নিয়ে এত কথা। ফরহাদ আলী শিক্ষার্থী, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়