শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তুমি এসেছিলে বলেই আমরা আজ স্বাধীন

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও মুজিববর্ষ উদযাপিত হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও কর্মময় জীবন এবং সংগ্রাম ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে যেমন আমরা তুলে ধরেছি ও ধরব, তেমনি মুজিববর্ষের অঙ্গীকার হবে জাতির পিতার স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যহীন একটি অসাম্প্রদায়িক উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। আসুন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করি।
ডা. এস এ মালেক
  ১৯ মার্চ ২০২০, ০০:০০

বিশ্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতি বা জনগোষ্ঠী যখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন; তখন এমন একজন মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটে, যিনি ওই সংকট উত্তীর্ণ করে বিপর্যস্ত জনগণকে মহামুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যান। আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ যা এক সময় ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের আধা ঔপনিবেশিক দখলদারদের দ্বারা শোষিত ও শাসিত হয়েছিল। বিশেষ করে এই ভূখন্ড যখন ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রায় ২৩ বছর ধরে শাসিত হয়েছিল। স্বাধীন হয়েও পূর্ব বাংলার বাঙালিরা পরাধিনতার দাসত্বে আবদ্ধ ছিল। তখনই শেখ মুজিবের মতো একজন মহান নেতার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশের জনগণই ভোট দিয়ে পাকিস্তান নামক ধর্মরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে। লক্ষ্য ছিল দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক মুসলমানদের জন্য একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। আর বাস্তবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের স্বাধীন পাকিস্তানে পরাধীনতার শিকল পরিয়ে দেওয়া হলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও পূর্ব বাংলার জনগণ হয়ে গেলেন পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, আর হিন্দুরা ভারতের চর। পাকিস্তানি শাসকরা ভেবেছিল প্রায় ১২০০ মাইল দূরে বিচ্ছিন্ন এক ভূখন্ড স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী নিয়ে কখনো ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রক হতে পারবে না। তাই রাষ্ট্রশক্তি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে সুদীর্ঘ দিন পূর্ব বাংলার সম্পদের বিনিময়ে পাকিস্তাননামক রাষ্ট্র ঠিকই পাকিস্তানিদের কল্যাণে ব্যবহার করা যাবে। পূর্ব বাংলায় চলবে চরম শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ন। অন্যদিকে পাকিস্তানকে করা হবে উৎপাদন, উন্নয়ন প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধিকরণ। কিন্তু সচেতন বাঙালি পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই এই ষড়যন্ত্র বুঝতে সক্ষম হয়। বাঙালির জাতিসত্তাকে হত্যা করার জন্য সর্বপ্রথম আগ্রাসন চালায় ভাষার ওপর। তারপর শুরু হয় পাকিস্তানিদের নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিরোধ। দাবি ওঠে স্বায়ত্তশাসনের। ঘোষিত হয় ৬ দফা। বাংলার রাখাল রাজা শেখ মুজিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় সৃষ্টি হয় গণআন্দোলন। শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে জীবনের বিনিময় হলেও ৬ দফা প্রতিষ্ঠিত করবে। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শুরু করেন এ আন্দোলন। '৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ও শেখ মুজিব '৫৪-র যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে স্বশাসনই জনগণের দাবি। এরপর '৫৮-তে জারি করে সামরিক আইন। শেখ মুজিব আহ্বান জানান রুখে দাঁড়ানোর। '৬৬ সালে লাহোরের মাটিতে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব বেশ কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা ঘোষণা করেন, ওটাই ৬ দফা। ওই ৬ দফাভিত্তিক ম্যানডেট পেয়ে '৭০-এ একচ্ছত্রভাবে নির্বাচিত হয়ে গোটা বিশ্বকে বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দেন বাঙালিই বাংলাদেশ শাসন করবে, পাকিস্তানিরা নয়। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে পাকিস্তানি শাসকরা যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন তিনি ঘোষণা দেন অসহযোগ আন্দোলনের, আর ওই আন্দোলনে প্রকৃত অর্থে জাতিরাষ্ট্রের অভু্যদ্বয় ঘটে। ৩ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ এই ২৩ দিন বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। শেখ মুজিবের নামে চলছিল দেশশাসন। আকাশে উড়ছিল লাল-সবুজ পতাকা। এর ভিতরেই বিপস্নবের মহান নেতা শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ঘোষণা দিলেন- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'

আরও বললেন, 'রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশালস্নাহ্‌।' বললেন, 'যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবিলা করতে হবে।' আরও বললেন, 'দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্য জীবিত থাকা অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে।'

এরপর ২৫ মার্চের কালো রাতের পাক-হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ আক্রমণ করলে ও নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ হত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন। এভাবেই 'এক নেতার এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে- ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ধ্রম্নবতারার মতো বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আগমন না ঘটলে স্বাধীনতার সংক্ষিপ্ত যে ইতিহাস এখানে বর্ণনা করলাম, তা কি কার্যকর হতে পারত? কেউ কি বঙ্গবন্ধু ছাড়া এমন কোনো একজন ব্যক্তির নাম অবহিত করতে পারেন, যিনি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এই কাজগুলো করতে পারতেন। নির্দ্বিধায় এখন বলা যায়, এমন কেউ ছিলেন না। নেতার সত্যিকার পরিচয় মেলে চরম সঙ্কটকালে। ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিব, '৫২-তে শেখ মুজিব, '৫৪-তে শেখ মুজিব, '৫৮-তে শেখ মুজিব, '৬২-তে শেখ মুজিব, '৬৬-তে শেখ মুজিব, '৬৯-তে শেখ মুজিব, '৭০-তে শেখ মুজিব। আন্দোলনের কোন পর্যায় নেই যেখনে তিনি নেতৃত্ব দেননি। কখনো অন্যদের সঙ্গে নিয়ে এবং কখনো একচ্ছত্র সংগ্রামে ২৪ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমন নয় যে, আর কোনো নেতা ছিলেন না, যখনই সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে মৃতু্যর সম্মুখীন হতে হয়েছে তখন একমাত্র বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউই প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেনি। ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও তিনি বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। নির্ঘাত মৃতু্য জেনেও কখনো বাঙালির স্বার্থের প্রশ্নে আপস করেননি। আগরতলা মামলা দিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে যখন ক্যান্টনমেন্ট নেওয়া হয় তখন একমুঠো ধুলো কপালে মেখে তিনি মৃতু্যর সঙ্গে লড়াই করতে যান। ললাটে বাংলার মাটি, হৃদয়ে স্বাধীনতার ঘাঁটি অবলম্বন করেই তিনি অগ্রসরবান হন। আবার পাকিস্তানে কবর খুঁড়ে, যখন তার বিচার করা হয়, তখন তিনি নির্বিচারে বলেছিলেন, ফাঁসি দাও আমার কোনো আপত্তি নেই, তবে আমার লাশটা বাংলার মাটিতে পৌঁছে দিও। জীবনের বিনিময়েই হলো স্বাধীনতার এটাই তার রাজনৈতিক মন্ত্র। আসলে রাজনৈতিক স্বাধীনতাই তার লক্ষ্য ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানের বিপরীতের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্যভিত্তিক বাঙালি জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে।

'৭২ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয় তাতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এই চারটি মূল উপাদান এটাই ছিল মুজিব দর্শনের কাজ। কাজটা খুব সহজ ছিল না। পূর্ব বাংলার ধর্মভীরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিকে, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে উদ্বুব্ধ করা। যখনই বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে আন্দোলন শুরু হয়েছে তখনই পাকিস্তানি শাসকদের বলতে শোনা যেত পাকিস্তান গেল, ইসলাম যাবে, আর ইসলাম গেলে মুসলমানের জন্য থাকবে কি? ভাষা আন্দোলনকে ওরা বলেছিল ভারতীয় ষড়যন্ত্র। ৬ দফাকে বলেছিল, বিচ্ছিন্নতার দলিল। আগরতলা মামলা দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য। যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা ও ৭ মার্চ বলেছিলেন বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশালস্নাহ্‌। যে বঙ্গবন্ধুর কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসলাম অন্তত দশগুণ শক্তিশালী হয়েছে। এখনো বাংলাদেশ বিশ্বের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নেতৃত্বে। কি দেখেছি আমরা ইসলাম রক্ষার নামে পাকিস্তান রক্ষা, আর পাকিস্তান রক্ষার নামে ৩০ লাখ বাঙালির নিধন। তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতহানি। সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করা। নেতা কম ছিলেন না, মওলানা ভাসানীর মতো ব্যক্তিও ৬ দফাকে প্রথম মেনে নিতে পারেননি। শেরেবাংলার মতো নেতা ও কেন্দ্রীয় সরকারের গভর্নর হতে দ্বিধাবোধ করেননি। যখন স্বায়ত্তশাসন দশভাগ দেওয়া হয়নি তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হেলিকপ্টার থেকে নেমে ছাত্র সমাবেশে বলতে শুনেছি নিজে কানে ৯০ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে। মুজিব কিন্তু প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি। মওলানা ভাসানীকে তিনি পিতার মতো শ্রদ্ধা করতেন ও শেরেবাংলাকে বড় মাপের নেতা বলে গণ্য করতেন বঙ্গবন্ধু।

এ দেশের বামপন্থিরা ৬০ দশকে বলতে শুরু করেছিলেন, ৬ দফা সিআইএ ডকুমেন্ট। আদমজি চটকলের বিনিময়ে শেখ মুজিব আপস করবেন। '৭০-এর নির্বাচনে ভোটের বাক্সে লাথি মেরে, এভাবে বয়কট করতে চেয়েছেন। আজ প্রমাণিত হয়েছে, ৬ দফার কারণেই দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আরও যে কত চক্রান্ত বিভিন্ন সময়ে করা হয়েছে, তা এখন ইতিহাসের খুঁটিনাটি বিষয়। তাই বলা যায় এক ব্যক্তির নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও মুজিববর্ষ উদযাপিত হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও কর্মময় জীবন এবং সংগ্রাম ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে যেমন আমরা তুলে ধরেছি ও ধরব, তেমনি মুজিববর্ষের অঙ্গীকার হবে জাতির পিতার স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যহীন একটি অসাম্প্রদায়িক উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। আসুন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করি।

জাতির পিতার এই জন্মশুভদিনে তার পুণ্যস্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।

পরিশেষে এই বলে শেষ করছি,

৭ই মার্চ এসেছিল বলেই

এসেছিল ২৬শে মার্চ

১৬ই ডিসেম্বর পেয়েছি স্বদেশ;

তুমি ডাক দিয়েছিলে বলেই

আজ আমাদের এই মাতৃভূমি,

লাল-সবুজের বাংলাদেশ।

\হ

ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<93082 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1