বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস আতঙ্ক

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা মুনাফা অর্জনের দিকে অতিরিক্ত আসক্ত বলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ একটি প্রয়োজনীয় দিক। করোনাভাইরাসের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাস্কের দাম রাতারাতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যেই ঢাকার ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে ফেলেছেন। এরপর ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি করলে সর্বশ্রেণির মানুষ একদিকে করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধরত অন্যদিকে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করতে বাধ্য হবেন অসহায়ভাবে।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  ২০ মার্চ ২০২০, ০০:০০

'নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়' বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের শেষপ্রান্তের এক কবি তার কবিতায় এই চরণটি লিখেছিলেন। পৃথিবীর কয়েকটা দেশ ছাড়া অনেক দেশেই মারাত্মক ব্যাধি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস বৃদ্ধি পাওয়ার পর শুধু সাধারণ মানুষ নয় সবাইকে সচকিত করে তোলে একটা সংবাদে- কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। পরবর্তী কয়েকদিন পর সংবাদপত্রে অন্যান্য দেশেরও কয়েকজন মন্ত্রী সম্পর্কে সমশ্রেণির সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ থেকে একটি দিক উপলব্ধি হয় যে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, উচ্চপদের মানুষও এই ব্যাধি থেকে অব্যাহতি পান না।

বর্তমানে বিশ্বের অসংখ্য দেশ করোনাভাইরাসের ছোবলে আক্রান্ত ও বিপর্যস্ত, বৈশিক পরিবেশও পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। চীন থেকে প্রথমে করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার পর বিশ্বের অসংখ্য দেশে তা পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ইটালি ও ইরান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ব্যাধি যাতে দেশে ছড়িয়ে না পড়তে পারে সেজন্য ইতোমধ্যেই বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে ভারত এবং অন্য দেশ থেকে বিমানের আগমনও। কারণ বাইরের পর্যটক ভাইরাস বহন করে যেমন আনতে পারে, ঠিক একইভাবে ভারতের পর্যটকরাও বাইরে থেকে দেশে ভাইরাস আনতে পারে। ভারতের বিমান বন্দরে উন্নতমানের কীটের ব্যবস্থা আছে, সে জন্য তারা অনেক সচেতন এবং আসা বিমানযাত্রীকে সরাসরি ছেড়ে না দিয়ে কোয়ারেন্টিনেরও ব্যবস্থা করেছে। শুধু তাই নয়- ব্যাধি যাতে বিস্তার লাভ করতে পারে সে জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, জনসমাবেশের কারণে ভাইরাস ছড়াতে পারে। এই শ্রেণির সতর্কতাই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বিশ্বে মার্চের পনেরো তারিখ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মৃতু্য হয়েছে ছয় হাজার মানুষের। এর বাইরেও মৃতু্যর সংখ্যা বাড়তে পারে এবং আক্রান্তের সংখ্যাও দেড় লাখ হওয়ার সম্ভাবনা। বাংলাদেশে প্রথম পর্যায়ে বা এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস আক্রান্তের মৃতু্য বা অসুস্থতার সংবাদ তেমন ভয়াবহ না হলেও একেবারে বিপদের বাইরে বলা যাবে না। কারণ, ইটালি থেকে অসংখ্য বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছে। বিশেষ কোয়ারেন্টিনে তাদের না রেখে তাদের বাড়িতেই কোয়ারেন্টিনে রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থা কতখানি সম্ভবপর ও নিরাপদ তা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষই বলতে সক্ষম। বরং কেউ যদি ইটালি থেকে ভাইরাস নিয়ে আসে তাহলে বাড়ির লোকদের এবং গ্রাম বা শহরে প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এটা ঘটলে ভাইরাস আরও বিস্তৃতি লাভের দিকই বেশি। অভিধানে এ সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ঞযব বহভড়ৎপবফ রংড়ষধঃরড়হ ভড়ৎ ধ ভরীবফ ঢ়বৎরড়ফ ড়ভ :রসব ড়ভ ঢ়বৎংড়হং, ংযরঢ়ং, ড়ৎ মড়ড়ফং ধৎৎরারহম ভৎড়স ঢ়ষধপবং রহভবপঃবফ রিঃয ড়ৎ বীঢ়ড়ংবফ :ড় পড়হঃধমরড়ং ফরংপধংব. বিদেশ থেকে দেশে ফেরা আক্রান্তদের বাড়িতে রাখার অনুমতি কোনোমতেই কোয়ারেন্টিন বলে চিহ্নিত করার উপায় নেই। এই দিকটি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন অন্যদের জন্য ও নিজেদের জন্য সামগ্রিকভাবে দেশের প্রয়োজন। ভাইরাসের প্রকৃতি সম্পর্কে এখানে বিস্তৃত আলোচনা অপ্রয়োজনীয়, শুধু একটা ছোট অংশ অভিধান থেকে তুলে ধরা যায়: অহু ারৎঁষবহঃ ংঁনংঃধহপব ফবাবষড়ঢ়বফ রিঃযরহ ধহ ধহরসধষ নড়ফু, ধহফ পধঢ়ধনষব ড়ভ :ৎধহংসরঃঃরহম ধ ংঢ়বপরভরপ ফরংবধংব. সম্ভবত করোনাভাইরাস এভাবেই মানবদেহে প্রবেশ করে আক্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছে। কিছুদিন আগে থেকেই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, চীনারা বাদুড়ের সু্যপ খাওয়ার পর এই রোগের বিস্তৃতি ঘটেছে। শুধু বাদুড়ের সু্যপ নয়- বিভিন্ন দেশে কাঁচা জন্তু, জন্তুর রক্ত, আধ-সেদ্ধ কাছিম থেকে অনেক জন্তু খাওয়ার অভ্যেস দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত। ব্যাঙ তো ফরাসিদের প্রিয় খাদ্য। এভাবে খাদ্য-জন্তুর মধ্যদিয়ে ভাইরাস ছড়ানো অসম্ভব নয়।

করোনাভাইরাস শুধু মানুষের মৃতু্য বা অসস্থতা ঘটায়নি, সারা পৃথিবীর অর্থনীতির ওপর যে আঘাত করেছে তা অতিক্রম করতে খানিকটা সময় লাগবে ঠিকই, কিন্তু দরিদ্র দেশের মানুষের ক্ষতি করবে সবচেয়ে বেশি। মানুষের আন্তঃ ও বহিঃস্থ অর্থনীতি দুভাবেই মানুষকে ক্ষতি করবে। পৃথিবীর অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেরও তুলনা করা যায়।

পৃথিবীর কয়েকটি দেশ ছাড়া বেশির ভাগ দেশেই বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ধরা যায় পনেরো দিনের জন্য আকাশপথ প্রায় শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এর ফলে বিমান কোম্পানিগুলোকে কোটি কোটি টাকা ক্ষতি গুনতে হবে এবং ভবিষ্যতে বিমান ভাড়া বাড়ার সম্ভাবনা। এর ফলে অনেকেই বিমান ভ্রমণ করতে সক্ষম হবে না।

বাংলাদেশ পোশাক তৈরি শিল্পে যে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে, তার ওপর আঘাত এলে শিল্পপতিদের সঙ্গে সবেচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র কর্মচারীরা। যাদের সংসার পরিচালনা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়বে। শুধু তাই নয়- শিপমেন্টের অভাবে ও একই সঙ্গে বাজারের চাহিদা মেটাতে অক্ষম হলে গার্মেন্টশিল্পও বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্পে যেভাবে বিশ্ববাজারে সুনাম ও অধিকার অর্জন করেছিল তা ভিয়েতনামের হাতে চলে যাবে। কারণ, ইতিমধ্যেই ভিয়েতনাম পোশাকশিল্প রপ্তানিতে বাংলাদেশকে অনেকটা পেছনে ফেলে এক নম্বরে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ যদিও পর্যটনশিল্পে অন্য দেশের মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু দেশি মানুষের কাছে কক্সবাজার থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ অঞ্চল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। করোনাভাইরাসের কারণে ভ্রমণশিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত এখন প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। এই কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের হোটেলগুলোকে ক্ষতির পরিমাণ গুনতে হচ্ছে।

আগে চীন থেকে বিভিন্ন পণ্য ও কাঁচামাল বাংলাদেশ আমদানি করত। বর্তমানে চীন থেকে পণ্য, ফল ও অন্যান্য কাঁচামাল আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর যদি অন্যদেশ থেকে কাঁচামাল না আসে তাহলে ওষুধশিল্পের ওপর তার প্রভাব পড়লে ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে অথবা অনেক ওষুধ তৈরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকে।

বাংলাদেশ থাইল্যান্ড থেকে দ্রব্যসামগ্রী আনার কথা চিন্তা করছে অভাব মেটানোর জন্য। থাইল্যান্ডের দ্রব্যের গুণগতমানের সঙ্গে মূল্যও অনেকটা সহনীয়। তা ছাড়া অনেক আগে থেকেই থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান বলে দেশের অভাব সেখান থেকে জিনিস আমদানি করে প্রয়োজন মেটানো কঠিন হবে না।

করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে বলে বেশি জনসমাবেশ হলে অন্যের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বিশাল ধর্মীয় সমাবেশের পর কয়েকজন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এই কারণে বিভিন্ন দেশে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইটালির একটা পোস্ট অফিসে যাওয়ার সময় বাইরে সাত হাত দূরে এক একজন দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা গেছে।

শিক্ষাঙ্গনে যাতে করোনা ছড়াতে না পারে সেজন্য পৃথিবীর সব দেশে কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাধারণভাবে মানুষকে বাড়ির ভেতরে থাকতে বলা হয়েছে নিজেদের ব্যাধিমুক্ত থাকার উপায় হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশের একটা প্রধান সমস্যা হলো রোহিঙ্গাদের নিয়ে। রোহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হলেও তাদের ক্যাম্পের বাইরে যাওয়া নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে তাদের বাইরে আসা বন্ধ করার উপায় নেই। তাদের মধ্যে করোনাভাইরাস দেখা দিলে বিস্তৃত আকারে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এদিকে কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা মুনাফা অর্জনের দিকে অতিরিক্ত আসক্ত বলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ একটি প্রয়োজনীয় দিক। করোনাভাইরাসের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাস্কের দাম রাতারাতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যেই ঢাকার ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে ফেলেছেন। এরপর ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি করলে সর্বশ্রেণির মানুষ একদিকে করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধরত অন্যদিকে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করতে বাধ্য হবেন অসহায়ভাবে।

চীনে করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হলেও বর্তমানে সরকারি প্রচেষ্টার কারণে অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। অল্পদিনের মধ্যেই হয়তো তারা এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন। ব্রিটিশরা চীনাদের আফিম খাইয়ে নিস্তেজ করে দেয়ার পর কমিউনিস্ট সরকার নিজের বিশাল জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবীতে তাদের উৎপন্ন পণ্য বাজার দখল করতে সম্ভব হলে করোনাভাইরাসও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার অধিকারী। আর পৃথিবীর বাকি দেশও সচেতনতার মধ্যদিয়ে করোনাভাইরাসকে বিদায় দিয়ে নিজেদের জনসধারণকে রক্ষা করতে পারবেন না কেন?

ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<93230 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1