প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে বিশ্বময়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নভেল করোনাভাইরাসকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে আগেই। এ ভাইরাস রোধে প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। করোনাভাইরাস মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ধরনকেও পাল্টে দিতে শুরু করেছে। বিশ্বের নানান দেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ও হয়ে মৃতু্যর ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিন। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বুধবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বাংলাদেশে প্রথম একজনের মৃতু্যর খবর নিশ্চিত করেছেন। আর আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ জনে। স্বাভাবিকভাবেই করোনা পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে নিহত ওই ব্যক্তি বয়স্ক। সত্তরের ওপরে তার বয়স। বিদেশফেরত এক ব্যক্তির সংস্পর্শে আসায় তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। এ ছাড়া আগে থেকেই ওই ব্যক্তির ফুসফুসে সমস্যা ছিল; ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি জটিলতা ছিল। এ ছাড়া হৃদযন্ত্রে একবার স্টেন্টিংও হয়েছিল। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল জানিয়েছেন আইইডিসিআর পরিচালক। অন্যদিকে ২৪ ঘণ্টায় আরও চারজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ায় বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ জনে। তাদের মধ্যে প্রথম দফায় আক্রান্ত তিনজন ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন; হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১০ জন। তিনি আরও জানিয়েছেন, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ১৬ জনকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। আর ৪২ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে। এ পর্যন্ত মোট ৩৪১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলেও তিনি ব্রিফিংয়ে উলেস্নখ করেন।
উলেস্নখ করা প্রয়োজন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের উদ্যোগ-সক্ষমতাকে দেশবাসী সন্দেহের চোখে দেখছেন। আর এ সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে, সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ভেতর কিছু ত্রম্নটির কারণে। এছাড়া ৮ মার্চের পর বিদেশ থেকে আসা ২ লাখের বেশি মানুষের মধ্যে অল্প কয়েকজনকে কোয়ারেন্টিন করা; ঘোষণার পরও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা দেশে ফিরে আসার ঘটনাও অন্যতম। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদেশফেরতরা এখনো যত্রতত্র মানুষের সংস্পর্শে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ বিয়ে করছেন, কেউ পর্যটনে সময় কাটাচ্ছেন। এ ছাড়া কোয়ারেন্টিন থেকে পালানোর তথ্যও সামনে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, আক্রান্ত বা বহনকারী ব্যক্তির সংস্পর্শে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে, ফলে এভাবে জনবহুল স্থানে অবাধে ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টি নিঃসন্দেহে আতঙ্কের। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে জরিমানা করা এবং বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানোর ঘটনাগুলো ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আশার কথা যে, সম্প্রতি গণস্বাস্থ্যের ভাইরাস শনাক্তকরণ কিট আবিষ্কারের ঘোষণার পর তা অনুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এটা ঠিক যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আইসোলেশন অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন রেখে ভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছে। এখন এ পরিস্থিতিতে সরকার তথা স্বাস্থ্য বিভাগের কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে যথাযথ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি চিকিৎসকদের সেলফ সেফটির বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। দেশব্যাপী প্রতিরোধ সেন্টার খোলার ঘোষণা দিয়ে কাজ শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগ। চিকিৎসক-নার্সদের জন্য ভাইরাস প্রোটেকটিভ বিশেষ গাউনের ব্যবস্থারও ঘোষণা এসেছে। চীনও ভাইরাস প্রতিরোধে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কোয়ারেন্টিন না মানলে ব্যবস্থা। আমরা মনে করি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জারি থাকলে নভেল করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ-প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ।
সর্বোপরি বলতে চাই, এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে বরং জনগণকে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে। মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। নিজে যেমন সংক্রমণ এড়াতে হবে, তেমনি অন্য কাউকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে 'একলা চলো নীতি' মেনে চলতে হবে। ভয়াবহ এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সরকারকেই নিতে হবে যথাযথ উদ্যোগ। সব দিকেই রাখতে হবে কড়া নজর। সরকারের যথাযথ নজরদারি এবং সবার সতর্ক সহযোগিতায় দেশবাসী অচিরেই এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আমরা আশাবাদী।