২৫ মার্চ কালরাত

গণহত্যার ভয়াবহ নজির

প্রকাশ | ২৫ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ) স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। রাজারবাগ, পিলখানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অগণিত লাশ পড়ে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সংঘটিত হিটলারের গেস্টোপো বাহিনীর নিধনযজ্ঞের চেয়েও ছিল ভয়ঙ্কর। ভিয়েতনামে মার্কিন সেনাদের দ্বারা সংঘটিত মাইলাই হত্যাকান্ডের চেয়েও ছিল বড় নির্মম ও পাশবিক। তাই বাঙালির জীবনে ২৫ মার্চ কালরাত নিষ্ঠুরতম ভয়াবহ রাত। মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। এই গণহত্যা চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করার আগ পর্যন্ত। আশার কথা, জাতীয় সংসদে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই জাতীয় গণহত্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ঘটনাবহুল মাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর এর আগে জনসাধারণের ওপর পাকিস্তানি হামলার কথা চিন্তা করে শেখ মুজিব ৭ মার্চের বিশাল জনসভায় সমবেত জনতাকে 'প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে' ও 'স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম' করতে বলেন। ভাষণ সমাপ্তির প্রাক্কালে তার আহ্বান 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' পূর্ব বাংলার জনসাধারণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করল। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মূলত মার্চের প্রথম দিনগুলো ছিল খুবই উত্তাল। তখন দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন চলছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। গোটা বিশ্বকে তিনি জানিয়ে দিলেন '৭০-এর নির্বাচনে ম্যানডেটের পর ৬ দফা মেনে না নিয়ে পূর্ব বাংলাকে শাসন করার কোনো অধিকার পাকিস্তানের নেই। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে, যদিও তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় সাংবিধানিক যোগ্যতা অর্জন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার লক্ষ্য নয়, তিনি বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। তার এই অনমনীয় মনোভাবের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার যুদ্ধ করে বাংলাদেশ পুনঃদখল করতে চায়। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ভবনসমূহে, বাড়িতে, গাড়িতে কালো পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৪ মার্চ, ১৯৭১ শেখ মুজিবের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতবৃন্দের বৈঠক হয়। কোনো প্রকার নতিস্বীকার না করার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে। ওই রাতেই ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাড়ি থেকে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। গ্রেপ্তারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, পাকিস্তানের জন্মের শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে বশীভূত করা হয়। যদিও পূর্ব পাকিস্তান পাট রপ্তানির মাধ্যমে সমগ্র পাকিস্তানের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত, পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে তার অধিকাংশই বিনিয়োগ করা হতো। পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৫০-১৯৭০ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সামগ্রিক বাজেটের শতকরা ২৮.৭ ভাগ ব্যয় করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ অনুভব করেছিল যে, তাদের পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এই বৈষম্য দূর করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফার একটি পরিকল্পনা রচনা করেন। ছয় দফা এক দফায় পরিণত হয়। একদিকে দীর্ঘ ৯ মাস ধরে বাঙালিদের ওপর চলল পাকিস্তানি আগ্রাসন, বাঙালিদের রক্তাক্ত প্রতিরোধ আর অন্যদিকে পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে প্রতিমুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর মৃতু্যর হাতছানি। ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ আর কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। অবশেষে ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৪৯ বছর অতিক্রম করছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে ওই গভীর ক্ষত বাঙালি কোনো দিনও ভুলতে পারবে না।