স্বাধীনতা দিবস ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিছু স্মৃতি

মহান স্বাধীনতার দিনে আমরা স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদ এবং পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা নিগৃহীত দুই লাখ মা-বোনকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু-সুহৃদ বিশাল হৃদয় বিদেশি বন্ধুদের।

প্রকাশ | ২৬ মার্চ ২০২০, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
২৬ মার্চ- বাঙালির মহান স্বাধীনতা দিবস। এদিন বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাদের ৯ মাস লড়াই করতে হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলাম। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পুনর্গঠনের কাজেও শরিক হতে পেরেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা ছিলাম। তখন বিভিন্ন প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর বাসায় যেতাম। সর্বশেষ ২৫ তারিখও আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, লিডার একটু ক্যান্টনম্যান্ট যাব। এখানে বলে রাখি ক্যান্টনম্যান্টের সঙ্গে আমার ফার্নিচারের ব্যবসা ছিল। ইস্টার্ন ফার্নিচার নামে আমার একটি ফার্নিচারের প্রতিষ্ঠান ছিল। আমি ক্যান্টনম্যান্ট গিয়েছিলাম ফার্নিচারের বিল আনতে। আমার কাছে ওই দিন ক্যান্টনম্যান্টের পরিস্থিতি একটু অন্যরকম মনে হলো। ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে সংবাদটি পৌঁছে দিলাম। তখন আমার আর্মির কাছে একটি ৯৪ হাজার অন্যটি ১৯ হাজার টাকার বিল বাকি ছিল। বিল রেডি ও চেক সই হওয়া সত্ত্বেও ওই দিন বিল আনতে পারেনি। ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর (অর্থাৎ, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন- যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন ই.পি.আরের ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়। \হঘোষণাটি ছিল এরকম: এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত রাখবেন। ২৬ মার্চ বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেমসহ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান প্রথম শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি রেডিওতে প্রচার করেন। পরে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়া চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী টালবাহানা শুরু করে। সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১ মার্চ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চের দিকনির্দেশনামূলক সেই ভাষণের পথ ধরেই ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল অস্থায়ী সরকার। এ সরকারের নেতৃত্বেই দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। অভু্যদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতীয় জীবনেই শুধু নয়, মুক্তিকামী সারা বিশ্বের শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের কাছে এক অনন্য সাধারণ ভাষণ হয়ে আছে। ৭ মার্চ সকালে আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি বাড়ির চারপাশে লোকে লোকারণ্য। আমরা নগর আওয়ামী লীগের নেতারাই বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় নিয়ে আসি। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার সঙ্গে আমি মঞ্চের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই ঐতিহাসিক দিনে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে সর্বদা ধন্য মনে করি। স্বাধীনতা যে কোনো জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও তা এক মহাসত্যি। এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করেছে রক্তস্নাত পথ ধরে। স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে জয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারা রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম গণহত্যা। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে ২৬ মার্চের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ডাক দেন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আর এর মাধ্যমেই অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মহিমান্বিত বিজয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায় এই বজ্রঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে মুক্তিযুদ্ধ। এই সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের অত্যাচার-নির্যাতন পৃথিবীর ইতিহাসের সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছিল। মহান স্বাধীনতার দিনে আমরা স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদ এবং পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা নিগৃহীত দুই লাখ মা-বোনকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু-সুহৃদ, বিশাল হৃদয় বিদেশি বন্ধুদের। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে- যার রাজনৈতিক দুরদর্শিতার কারণে সমগ্র বিশ্বের জনমত পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন করেছিল। দলমতনির্বিশেষে ভারতের প্রতিটি জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন ও সহায়তা করায় আমরা তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। আর কে চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সভাপতি বাংলাদেশ ম্যাচ ম্যানুফ্যাকচারার এসোসিয়েশন, সদস্য এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা