বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর স্থান ইতিহাসের অনন্য উঁচুতায় প্রতিষ্ঠিত। তাকে নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস ষড়যন্ত্রের অংশ। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ভাগ্যবিধাতা ও ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বে পালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। মুজিববর্ষের অঙ্গীকার হোক- বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ।
ডা. এস এ মালেক
  ২৮ মার্চ ২০২০, ০০:০০

বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় যে ১২টা মাসের উলেস্নখ আছে মার্চই তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য মাস। এ মাসের ১৭ তারিখে জন্ম হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। তিনি ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে আহ্বান জানান স্বাধীনতার। আর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। সুতরাং ৭, ১৭ এবং ২৬ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে ৭ মার্চ ও ২৬ মার্চ যা ঘটেছে, তা ঘটত না। ১৭ মার্চ শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন নয়, বাংলাদেশেরও জন্মদিন। কে জানত টুঙ্গিপাড়ার ওই নেতা একদিন বিশ্ব নেতায় রূপান্তরিত হবে। দখলদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে পূর্ব-বাংলাকে স্বাধীন করে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করবেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি, বাঙালির চেতনায় উৎসর্গকৃত একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তার আচরণে, কথা-বার্তায়, আবেগ-অনুভূতিতে, ভাষা প্রয়োগ, চিন্তা-চেতনায়, অবয়বে ও কণ্ঠে ছিল একজন বাঙালির পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। বাঙালিত্বই ছিল তার গর্ব। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ব-বাংলা, পূর্ব-পাকিস্তান হওয়াকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনার আগে যখন তিনি জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, আবার আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। কাদের জন্য যুদ্ধ করতে হবে তা আজ আর কারও বুঝতে বাকি নেই। ২৪ বছর আন্দোলন সংগ্রাম ও ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। যদি ভাষা আন্দোলনকে মূল পটভূমি হিসাবে ধরা হয়, তাহলে '৫৪, '৫৮, '৬২, '৬৪, '৬৬, '৬৯-এর ধারাবাহিক যে আন্দোলন হয়েছে, তা ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধু প্রথম বাঙালি নেতা; যিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, পাকিস্তান বাঙালির জন্য কোনো স্বাধীন দেশ নয়। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে বাঙালি ছিল ব্রিটেনের দাস। আর পাকিস্তানে বাঙালি বনে গিয়েছিল পাকিস্তানিদের দাসে। তাই অতি স্বাভাবিক কারণে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করার সংগ্রাম শুরু করেন।

পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সুদীর্ঘ দিন ধরে চলেছিল; তা সত্যিকার অর্থে ছিল স্বাধিকার আন্দোলন। ৬ দফার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে তিনি স্বাধিকার আন্দোলনের ঘোষণা দেন। ৬ দফার মাধ্যমেই তিনি পাকিস্তানিদের জানিয়ে দেন, বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করে পাকিস্তানে নেওয়া চলবে না। এ দেশের সম্পদ, এ দেশের মানুষের কল্যাণেই ব্যবহার করতে হবে আর কাউকে সে অধিকার দেওয়া যেতে পারে না। তার ধারণা ছিল বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই বাঙালি। ধর্মীয়ভাবে বিভিন্ন অবস্থান হলেও সামাজিকভাবে তারা সবাই বাঙালিত্বে বিশ্বাসী। পাকিস্তানিরা পূর্ব-বাংলার জনগণের পাকিস্তানিকরণ প্রক্রিয়ায় যে অপচেষ্টা সুদীর্ঘ ২৪ বছর অব্যাহত রেখেছিল। আহার-বিহারে, সাংস্কৃতিক চেতনাবোধে বাঙালি ও পাকিস্তানিদের মধ্যে কোনো মিল নেই। শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে এই দুই জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয় সম্ভব নয়। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার এটাই মূল কারণ। এই বৈসাদৃশ্য, বিভেদ ও ভিন্নতার প্রচন্ডভাবে সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে। এটা শুধু বঙ্গবন্ধুর নয়, বাংলাদেশের সব, সর্বস্তরের মানুষ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, '৬৯-এর শেষ দিকে এমন প্রচন্ড আকার ধারণ করেছিল যে, '৭০-এর নির্বাচনে ৬ দফাকে ম্যানডেট হিসেবে গণ্য করে যে ভোট দিয়েছিল, তা মূলত পাকিস্তান নামক মৌলবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় সংসদ গঠন করার জন্য- '৭০-এর নির্বাচন হলেও ওই নির্বাচন প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানিরা পাকিস্তান রক্ষার জন্য ভুট্টোকে ভোট দিয়েছিল। আর বাঙালিরা ভোট দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গঠন করার জন্য। '৭০-এর নির্বাচনের পর পহেলা মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকা হলে ৬ দফার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু আপস না করায় ওই অধিবেশন বন্ধ করা হয়। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন পাকিস্তানি শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি নয়। মার্চের ৩ তারিখ থেকে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং মাত্র ২২ দিনে গোটা বিশ্বকে বুঝিয়ে দেন যে, বাংলাদেশ শাসন করার কোনো নৈতিক অধিকার পাকিস্তানের নেই। তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছিল। বাংলাদেশের কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড্ডীয়মান ছিল না। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব কিছুই চলেছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে একজন রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রের জন্মের আগেই রাষ্ট্র শাসন করছেন; এরূপ ঘটনা বিশ্বের আর কোথাও ঘটেনি। মূলত তখনই বাঙালি স্বাধীনতার স্বাদ শুরু করেছেন। ২৫ মার্চের কালো রাতে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর পরই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ও স্বাধীন দেশের মাটি থেকে হানাদার বাহিনীকে উৎখাত করার নির্দেশ দেন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই বলেছিলেন, আর স্বায়ত্তশাসনের দাবি নয়, আন্দোলনের লক্ষ্য- 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। মূলত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর নামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার যে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, তা ছিল একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক। কেউ কেউ ওটাকে স্বাধীনতার ঘোষণা দাবি করলেও, এটা ইতিহাসের চরম বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। এদের কাছে প্রশ্ন কোনো আইনগত, রাজনৈতিক ও নৈতিক অধিকার বলে সেদিনের এক মেজর স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। তাও প্রথমে নিজের নামে ও পরে সংশোধিত আকারে বঙ্গবন্ধুর নামে। যারা জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে মনে করেন, ঘোষক হলে ঘোষণা দেওয়ার পর পরই তিনি আবার তা সংশোধন করতে গেলেন কেন?

প্রফেসর এমাজ উদ্দীন আহমদের মতো জ্ঞানপাপীরা প্রথমবার জিয়ার নামে স্বাধীনতার কথা বললেও সংশোধনের কথা উলেস্নখ করেন না কেন? স্বাধীনতা কীভাবে, কখন, বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছেন, তা সবাই অবগত। স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি কোন পরিপ্রেক্ষিতে দিলেন বাংলার জনগণ ও বিশ্ববাসীর নতুন করে তুলে ধরার প্রয়োজন নেই।

অথচ দশকের পর দশক ধরে যারা স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক করে চলেছেন, তাদের ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কি হতে পারে। কী নির্লজ্জভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধিরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। মিথ্যা ইতিহাসচর্চা করেছে। মার্চ আত্মোপলব্ধি মাস, সংগ্রাম ও স্বাধীনতা ঘোষণার মাস, বাংলাদেশের ওপর বাঙালির সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাস, বঙ্গবন্ধুর মাস, আলস্নাহ্‌র আশীর্বাদপৃষ্ঠ এই মাসের ৩টি দিন একেবারেই বাঙালির ৭, ১৭ এবং ২৬ মার্চ। তাই মার্চ মাস এলেই বাঙালি আবেগ ও উত্তেজনায় অভিভূত হয়ে পড়ে। স্মরণ করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর স্থান ইতিহাসের অনন্য উঁচুতায় প্রতিষ্ঠিত। তাকে নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস ষড়যন্ত্রের অংশ। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ভাগ্যবিধাতা ও ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বে পালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। মুজিববর্ষের অঙ্গীকার হোক- বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ।

ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<94318 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1