ক্ষমতা ও শিষ্টাচার

গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি নাগরিকের প্রত্যাশা ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে শিষ্ট আচরণ পাওয়ার। কারণ ৩০ লাখ শহিদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে ক্ষমতাধররা নিজেদের শাসক ভেবে মানুষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন না, কারণ বাংলাদেশের মানুষ বারবার প্রমাণ করেছে, তারা কারও কাছে নত স্বীকারে বাধ্য নয়। সুতরাং সে বিষয়গুলো মাথায় রেখে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অর্পিত ক্ষমতার স্টিয়ারিংটা পরিচালনা করবেন।

প্রকাশ | ২৮ মার্চ ২০২০, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
ক্ষমতার সঙ্গে মানুষের আচরণ সম্পর্কিত। ক্ষমতার অর্জনের সঙ্গে মানুষের আচরণ পাল্টায়। কারণ ক্ষমতাধররাই রাষ্ট্র্র ও সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং যারা ক্ষমতাসীন হন তাদের আচরণের পরির্বতন হওয়াটাই স্বাভাবকি। তবে এই পরিবর্তনটা হওয়া উচিত ইতিবাচক। ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক আচরণে রাষ্ট্র ও সমাজে যে প্রভাব পড়ে তাতে সাধারণ মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে না। বরং সমাজে অস্থিতিকর পরিবেশই সৃষ্টি হয়। সুতরাং যারা ক্ষমতাসীন হন তাদের সেই বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার। একবিংশ শতাব্দির ক্ষমতাধররা কিন্তু সামন্ত প্রভু নন। তাই তাদের আচরণটা মানুষ মার্জিত আশা করে। কিন্তু কিছু ক্ষমতাবানদের আচরণের মধ্যযুগীয় শাসনের গন্ধ পাওয়া যায়। ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে সমাজ অনেক কিছু শিখে। একজন সমাজিক শিক্ষক হিসেবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সুতরাং সেই নিরিখে তাদের ক্ষমতার অনুশীলন করা প্রয়োজন। ক্ষমতাধরদের কথা আচরণ সংযত হওয়া উচিত, তাদের ধৈর্যশীলতা সমাজের মানুষের কাছে অনুকরণীয় বিষয় হয়ে যায়। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি আছেন যাদের আচরণ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তা ব্যক্তিদের আচরণকেও হার মানায়। বাংলাদেশে স্যার এবং সাহেব শব্দ দুইটির উৎপত্তি ঘটায় ঔপনিবেশিক শাসকরা। কর্তা ব্যক্তিদের ব্রিটিশ আমলে তার অধীনস্থ কর্মীরা স্যার সম্বোধন করত। এটা ছিল প্রভুত্ব প্রদর্শনের একটি নজির। ব্রিটিশ শাসনের পর আরেক শাসকের হাত পাল্টিয়ে স্বাধীনতা এলেও সেই রেওয়াজটি এখনো চলে আসছে। ব্রিটিশ শাসন আমলে সাধারণ মানুষরা ছিল ব্রিটিশদের প্রজা, তাই ব্রিটিশদের এই বাংলার মানুষেরও স্যার সম্বোধন করতে হতো এবং সরকারি অফিস আদালতে চাকরি করা ব্যক্তিদেরও স্যার বলতো সাধারণ মানুষ; যেহেতু সরকারি কর্মচারীরা ছিল রাজকর্মচারী। দেশ স্বাধীন হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে দেশটির জন্ম। দেশটির মালিক জনগণ। সুতরাং এখন যারা সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারী তারা জনগণের কর্মচারী। তবে পরিতাপের বিষয় এই যে, স্বাধীন দেশে সরকারি কর্মচারীরা যে জনগণের কর্মচারী তা তারা ভুলে যান। এখনো ঔপনিবেশিক আমলের ধ্যান ধারণা রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণে। তারা ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে আচরণ করেন। নিজেরা নিয়ন্ত্রক হওয়ার মানসে তারা অশিষ্ট আচরণ করে মানুষকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। তারা নিজেরাই ভুলে যান ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়ে এই দেশকে স্বাধীন করেছে এ দেশের জনগণ, কারো নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্য নয়। তবে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কিছু কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদের ক্ষমতাকে এমনভাবে প্রয়োগ করেন সাধারণ মানুষের মাঝে যাতে সাধারণ মানুষ তাদের অধীনস্থ থাকে। কর্তা ব্যক্তিদের ক্ষমতার এই প্রয়োগিক বিষয়টি এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। সম্প্রতি একটি ঘটনাকে এখানে উদাহরণ হিসেবে দিতে চাই, ঢাকার একটি দাতা সংস্থার কর্তা ব্যক্তি রাজশাহী আসেন। তিনি রাজশাহী এসে জনৈক ব্যক্তিকে মোবাইলে ফোন দেন এবং সাহেব সম্বোধন করেন। তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ওই ব্যক্তিটি তার ব্যক্তিগত কাজে এতই ব্যস্ত যে, তিনি ঢাকা থেকে আগত কর্তাদের সঙ্গে দেখা করার সময় তার ছিল না। ঢাকা থেকে আগত কর্তা ব্যক্তিটি যাকে ডাকছেন ওই ব্যক্তিটি তার অধীনস্থ কোনো কর্মচারীও নন বা ওই সংস্থায় কর্মরত কোনো কর্মী না বা তাদের প্রদত্ত তহবিলে পরিচালিত সংস্থায়ও চাকরি করেন না। তারপরও তিনি সময় চান এবং মিনতি করে বলেন, পরে দেখা করবেন, যদি তাদের প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি ঢাকায় তাদের অফিসে গিয়ে দেখা করে আসবেন। এসব শুনে ঢাকা থেকে আসা কর্তা ব্যক্তিটি ক্ষিপ্ত হয়ে যান। তখন ঢাকার কর্তা ব্যক্তিটি জানান, আমি আপনাকে ফোনে বারবার দেখা করতে বলছি, আপনি দেখা করছেন না, এটা আপনার অপরাধ। আপনার এই কথাগুলো আমরা রেকর্ড করে নিয়ে যাচ্ছি। ঢাকায় গিয়ে আমরা আপনার নামে রিপোর্ট করব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে, এর ফলে আপনারই ক্ষতি হবে। এখানে প্রশ্ন হলো- কর্তা ব্যক্তিটি ঢাকার কোন দাতা সংস্থা থেকে এসেছেন তা ওই ব্যক্তিটি বুঝবেন কি করে? তিনি ফোনে বললেই কি বিশ্বাস করতে হবে- তিনি যে সংস্থার পরিচয় দিচ্ছেন সেই সংস্থার বড় কর্তা তিনি। দেশে এরকম ফোনে ডেকে নিয়ে অনেকেই বস্নাক মেইল করা হয়। তার দেয়া পরিচয় সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ লাগবে, তারপর তিনি বিশ্বাস হলে দেখা করতে যাবেন? তা ছাড়া কোনো ব্যক্তি তার ক্ষমতা পরিমন্ডলের বাইরে কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা বা শাসানোটা কি ক্ষমতার অপব্যবহারে মধ্যে পড়ে না? এখন যদি কেউ ঢাকা গিয়ে রাজশাহী থেকে আসা কর্তা ব্যক্তিটিকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন, কোনো হোটেলে বা বিশেষ কোনো স্থানে, তাহলে তিনি কি দেখা করবেন ব্যক্তিটির সঙ্গে? ফোনের মাধ্যমে কি বোঝা যাবে বা যায় কে কোন পদধারী বা সংস্থায় কর্মরত? কর্মস্থল বা পদের পরিচয় বহন করে এমন যোগ্যস্থান না বলে, যদি কেউ নিজেকে কোনো সংস্থার কর্তা ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দিয়ে, কোনো ব্যক্তিকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করেন এটাও এক ধরনের বস্নাক মেইল পর্যায়ভুক্ত। সুতরাং যারা এ ধরনের বস্নাক মেইল করেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করার একটি নীতি নির্ধারণ করা উচিত সরকারে। ক্ষমতাসীনরা নিজের থেকে চায় শক্তিটা প্রদর্শন করতে। কুড়ি গ্রামের জেলা প্রশাসক তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তিনি একজন সাংবাদিককে নিজ ক্ষমতা বলে যা করলেন তা কোনো শিষ্টাচারের মধ্যেই পড়ে না। অনেকেই বলবেন, সাংবাদিক কি দোষের ঊর্ধ্বে? এটা ঠিক, কোনো মানুষই দোষ ত্রম্নটির ঊর্ধ্বে নয়। তাই বলে কি রাত দুপুরে দরজা ভেঙে সাংবাদিককে পেটানো যায়? ধরা যাক, সাংবাদিক ব্যক্তিটাই দোষী? দিনে জেলা প্রশাসকের কাছে অন্যায় করেছেন তাহলে দিনের বেলায় তার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে জেলা শাসক বিচার করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। তা না তিনি গভীর রাতে নিজ ক্ষমতা জাহির করলেন। বাংলাদেশে অনেকেই সাংবিধানিকভাবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জন প্রত্যাশাকে আমলে নেয় না। নিজের দায়িত্ব পালনের নামে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষায় ছাই দিয়ে দেন। ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচন তারই একটি প্রমাণ। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক বাধ্যকতার অজুহাত দেখিয়ে ৫.২৮% ভোটারের উপস্থিতিতে নির্বাচন সম্পন্ন করলেন। দেশসহ সারা বিশ্বে করোনা আতঙ্কে মানুষ। পৃথিবীর অনেক দেশেই লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। করোনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জনসমাগম না ঘটানোর অনুরোধ করা হচ্ছে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে। এমতবস্থায় নির্বাচন কমিশন সব বিষয় উপেক্ষা করে নির্বাচনটি সম্পন্ন করলেন। এটা কি জনমতের প্রতিফলন ঘটলো, না জনমতকে আইনের অজুহাতে উপেক্ষা করা হলো? দেশের বিভিন্ন সংস্থায় যারা ক্ষমতার স্টিয়ারিংটা পরিচালনা করেন মানুষ তাদের কাছ থেকে শুভ আচরণ প্রত্যাশা করে। কিন্তু বর্তমানে এমন একপর্যায়ে এ দেশের ক্ষমতাধররা অবস্থান করছেন, তাদের যা মনে আসছে তাই তারা করতে কুণ্ঠাবোধ করছেন না। ক্ষমতাধরদের মনে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছেন, নিজেদের মন্তব্য বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তাও আমলে নিচ্ছেন না। সম্প্রতি করোনা ভাইরাস নিয়ে দেশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মন্তব্য জাতি হতাশ হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি নাগরিকের প্রত্যাশা ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে শিষ্ট আচরণ পাওয়ার। কারণ ৩০ লাখ শহিদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে ক্ষমতাধররা নিজেদের শাসক ভেবে মানুষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন না, কারণ বাংলাদেশের মানুষ বারবার প্রমাণ করেছে, তারা কারও কাছে নত স্বীকারে বাধ্য নয়। সুতরাং সে বিষয়গুলো মাথায় রেখে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অর্পিত ক্ষমতার স্টিয়ারিংটা পরিচালনা করবেন। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক