আমলাতন্ত্র ও অসৎ আমলা

প্রকাশ | ২৯ মার্চ ২০২০, ০০:০০

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল কালীবাড়ী সড়ক হবিগঞ্জ
আমাদের সমাজটা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় অভ্যস্ত। দেশের মানুষ মনে করে আমলারা যা বলবেন দেশের মন্ত্রীরাও অনেক ক্ষেত্রে মেনে নেবেন। কেন মেনে নেন, আমাদের মতো সাধারণ মানুষ তা জানি না। যারা আমলাদের কথায় চলেন তারাই বলতে পারবেন। আমলাদের মধ্যে এমন ব্যাক্তিরাও আছেন, যারা মনে করেন এ দেশের মানুষ তাদের জমিদারির প্রজা। তবে অনেক ক্ষেত্রে এমন আমলারাও আছেন তারা লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কেউ কেউ বলবেন সবাই তো আর এক রকম হয় না। আমাদের মধ্যে যেমন ভালো মানুষ আছেন, ঠিক তেমনি আমলাদের মধ্যে যারা ভালো মানুষ আছেন, তাদের অবস্থাও দেশের অসহায় মানুষের মতো। খারাপের ঠেলায় পড়ে মানুষকে ভালোবাসেন এমন আমলারা মানুষের পক্ষে মুখে কিছু বলতে পারেন না। অন্যায়কে হজম করতে গিয়ে নিজেরাও অন্তর জ্বালায় কিংবা বিবেকের আগুনে পুড়তে থাকেন। তারা অবৈধ ক্ষমতা দেখাতে চান না। নিয়মের মধ্যেই থাকতে চান। আবার এমন আমলারাও আছেন তারা দেশের কোনো এলাকায় গিয়ে নিজেদের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে এমন সব কর্মকান্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যাদের কর্মকান্ডে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের একশ্রেণির আমলারা কখনো চান না তাদের কাছে দেশের মানুষ মন খুলে কথা বলুক। একটা দূরত্ব নিয়েই চলতে চান। নিন্দুকেরা বলে এমন আমলাও আছেন তারা পুলিশের কাজও করেন। রাত্রি বেলা দলবল নিয়ে নিরীহ জনগণের বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। চোখ বেঁধে গৃহস্থকে ঘর থেকে তুলে আনেন, উলঙ্গ করে মারতে থাকেন। তখন আমলারা বোঝাতে চান ক্ষমতার বহর। অসহায় মানুষকে অসৎ আমলারা তাদের ক্ষমতার বহর দেখিয়ে দরিদ্র জনগণকে বোঝাতে চান তারাই দেশের রাজা মহারাজা। অসৎ আমলাদের কাছে আইন কোনো ব্যাপার নয়। তারা যে কারও শরীরে হাত তুলতে পারে। তাদের কাছে রাত-দিনের কোনো তফাৎ নেই। এসব অসৎ আমলারা কোনো বৃদ্ধকে কানে ও শার্টের কলারে ধরে টেনে আনতে পারে। যারা নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ করেন তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, কুড়িগ্রামের বাংলা ট্রিউবিউনের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে মধ্যরাতে তার বাড়ি থেকে তুলে এনে মাদক ও গাঁজা রাখার অপরাধে জেলা প্রশাসকের কর্মকর্তারা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের বিনাশ্রম সাজা দিয়েছেন। এই ঘটনা সাংবাদিকসহ সারা দেশের মানুষ জানার পর দেশের মধ্যে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এই ঘটনায় সরকারের মন্ত্রীপর্যায়ের ব্যক্তিরা সমালোচেনার মুখে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। শুধু যে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে এক বছরের বিনাশ্রম সাজা দেওয়া হয় তা নয়- অভিযোগ আছে মোবাইল কোর্টের সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং তার সঙ্গের লোকজন কর্তৃক মধ্যরাতে সাংবাদিক রিগ্যানের ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তাকে মারতে মারতে গাড়িতে তোলা হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এনে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে বাংলা ট্রিউবিউনের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে এক বছরের বিনাশ্রম সাজা দেওয়া হয়। পরে দেশের মানুষের সমালোচনার মুখে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করেন এবং জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হবে বলে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়। জানা যায়, বাংলা ট্রিউবিউনের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের কাছ থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় দোষ স্বীকারের চারটি কাগজে দস্তখত নেওয়া হয়। সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে এই ঘটনার তদন্ত করে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ঘটনার সত্যতা পেয়ে তাকে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসন থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এমনও বলা হয়েছে ডিসি সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে এবং তার কর্ম অনুযায়ী তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। সবাই একটা কথা স্বীকার করবেন আমাদের মধ্যে এমন সব মানুষ আছেন, যারা ক্ষমতা পেলে চোখের সামনের মানুষকে আর মানুষ মনে করেন না। মনে করেন তাদের ক্রয় করা ক্রীতদাস। মনে করেন সবাই তার কথামতো চলবে। কথার বাইরে গেলেই এই শ্রেণির ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা রেগে আগুন হয়ে যায়। তখন তাদের রাগের আগুনে অসহায় মানুষ জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। অসৎ আমলারা ভাবে আমার জমিদারিতে থেকে আমার প্রজারা আমার কথা শুনবে না, তা কি হয়। আরিফুল ইসলাম রিগ্যান শুধু একজন সাংবাদিকই নন, তিনি একজন মানুষ গড়ার কারিগর অর্থাৎ তিনি একটি বিদ্যানিকেতনের শিক্ষক। এসব শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েই বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা বড় বড় জায়গায় পৌঁছেন। শেষে তারা ভুলেই যান এসব শিক্ষকই তাদের শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে যথাযথ জায়গায় পৌঁছানোর পথকে সুগম করে দিয়েছেন। সবাই জানে যে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যান ধূমপান পর্যন্ত করেন না। যে ব্যক্তি ধূমপান পর্যন্ত করেন না সেই ব্যক্তি মদ আর গাঁজা সেবন করবে, তা কি বিশ্বাসযোগ্য। অনেকেই বলেন তা কেবল বিশ্বাস করতে পারে লেখা-পড়া জানা মাথা মোটা ব্যক্তিরা। সাংবাদিক রিগ্যানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কুড়িগ্রামের মানুষ বিশ্বাস করেননি। তাই কুড়িগ্রামের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সচেতন মানুষও সাংবাদিক রিগ্যানের বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। এমনকি তার শত্রম্নরা পর্যন্ত কষ্ট পেয়েছে তার বিরুদ্ধে এমন মিথ্যা অভিযোগ তোলায়। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসন কেন সাংবাদিক রিগ্যানের প্রতি ক্ষেপেছেন? প্রশ্নটা আসতেই পারে। বাংলা ট্রিউবিউনের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের অপরাধ, সে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন খবরাখবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করত। জেলা প্রশাসক একটি পুকুরের নাম নিজের নামে অন্যায়ভাবে করতে চেয়েছিলেন, যা তিনি করতে পারেন না। পুকুরের নামকরণের খবরাখবর সাংবাদিক রিগ্যান সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করায় ডিসির রোষানলে পড়েন। যদিও বলা হচ্ছে, এ ঘটনা এক বছর আগের। সাংবাদিক রিগ্যানকে যখন মধ্যরাতে ঘরের দরজা ভেঙে মারতে মারতে গাড়িতে তোলা হয়, তখন তাকে বলা হয়, তুই আমাদের অনেক জ্বালিয়েছিস। এ ছাড়া তাকে অশ্লীল ভাষায় অর্থাৎ অকথ্যভাবে তার পরিবারের লোকজনের সামনে গালাগাল করা হয়। সাংবাদিক রিগ্যানকে বলা হয় তাকে এনকাউন্টার করা হবে। চোখ বাঁধা অবস্থায় চারটি কাগজে তার দস্তখত নেওয়া হয়। একটি প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক ও শিক্ষকের সঙ্গে যদি আমাদের একশ্রেণির মাথা মোটা দুর্নীতিবাজ আমলারা এমন আচরণ করতে পারেন তাহলে দেশের সাধারণ মানুষ যদি তাদের কাছে যায়, তা হলে তাদের সঙ্গে অর্থাৎ দেশের মানুষের সঙ্গে এসব আমলারা, কেমন আচরণ করবেন তা বোঝার জন্য লেখাপড়া করে পন্ডিত হওয়ার কি প্রয়োজন আছে। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসনের কিছু সংখ্যক ব্যক্তির জন্য আমাদের দেশের প্রশাসন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে না। কেননা আমাদের প্রশাসনে এমন সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিরাও আছেন, যারা দেশের উন্নয়নের জন্য সব-সময় চিন্তা-ভাবনা করে থাকেন। কেন জানি মনে হয় আমাদের সর্বত্র কিছু সংখ্যক মানুষ বসে আছে, যারা মনে করে দেশটা তাদের বাপ-দাদার তালুক। আর দেশের মানুষ হলো সেই তালুকের প্রজা। একশ্রেণির আমলারা ভুলে যান তারা একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার আমলা। তারা সামন্ত প্রভু নন। তাদের মনে রাখতে হবে জনগণের অর্থেই তাদের বেতন হয়। এমনিতেই নির্বাহী বিভাগ থেকে পরিচালিত মোবাইল কোর্ট নিয়ে লোকমুখে অনেক কথাই শোনা যায়। মানুষ তো আর এমনিতেই কথা বলে না। আগুন ছাড়া কি কখনো ধোঁয়া ওঠে? একজন জেলা প্রশাসক যদি না বোঝেন তার পদের মর্যাদা কিংবা তাদের আচরণ যদি একশ্রেণির গোয়ার প্রকৃতির মানুষের মতো হয়, তাহলে তো মানুষ কোনো কিছুর হিসাব মেলাতে পারবে না। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসনের ডিসি ছাড়া যে সব ম্যাজিস্ট্রেট সাংবাদিক রিগ্যানকে মধ্যরাতে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে সাজা দেওয়ার ব্যাপারে জড়িত আছেন তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকে কি রোল পেস্ন করেছেন, সেই রোলটি যদি আইন বহির্ভূত হয়, তাহলে অবশ্যই দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং বিধি অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডিসির অধীনরা যদি কাজে কোনো গাফিলতি করেছে কিনা তাও দেখা হবে। আমরা জনগণও তাই চাই। জনগণ চায় প্রতিমন্ত্রীর মুখের কথা যেন বাস্তবে প্রতিফলিত হয়। তা যেন কথার কথা না হয়। কুড়িগ্রামের মোবাইল কোর্ট কর্তৃক সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে সাজা দেয়ার ঘটনার বিস্ময় প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট এ সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন একজন সাংবাদিককে ধরতে মধ্যরাতে তার বাসায় চলিস্নশজনের বাহিনী গেল। এ তো দেখছি বিশাল ব্যাপার। তিনি কি দেশের সেরা সন্ত্রাসী? বাংলা ট্রিউবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন-উর-রশিদের দায়েরি রিটে ফৌজদারি কার্যবিধি, ভ্রাম্যমাণ আদালত, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন এবং সংবিধানের ৩১, ৩২, ৩৫ এবং ৩৬ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্গনের বিষয় তুলে ধরা হয়। কুড়িগ্রাম ডিসি অফিসের কার্যকলাপে আমাদের দেশের একশ্রেণির আমলাদের উলঙ্গ চেহারা ফুটে উঠেছে। এই ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হয়েছে, আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক আমলারা ধরা কে সরা জ্ঞান করেন। এখানে সরকারকে একটা কথা মনে রাখতে হবে, সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখে এক শ্রেণির বিরুদ্ধবাদীরা অসন্তুষ্ট। তারা পদ্মা সেতুসহ অনেক ব্যাপারে ষড়যন্ত্র করেছে। এমনকি অনেক গুজব পর্যন্ত ছড়িয়েছে। ওই বিরুদ্ধবাদীদের চেলা-চামুন্ডরা প্রশাসনে লুকিয়ে থেকে সরকারকে দেশের মানুষের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায় কিনা, তা সরকারের লোকজনকেই খোঁজ-খবর নিয়ে দেখতে হবে। তাই বলছিলাম আমাদের সাবধান হতে হবে, সেই সব বিরুদ্ধবাদীদের ব্যাপারে, যারা চায় না আমার এই দেশমাতৃকা উন্নয়নের উচ্চস্তরে পৌঁছে যাক।