করোনা মোকাবিলা ও মানবতার রাজনীতি

বাংলাদেশ সাধারণ মানুষের অবন্ধু মুনাফাকারী ব্যবসায়ীরা। যারা সুযোগ পেয়ে এক কেজি চালের দাম সাত টাকা বাড়িয়ে দেয়। সাধারণ পণ্য পেঁয়াজের দাম নিয়ে মানুষের সঙ্গে খেলা করে। তারা মানুষ হলেও প্রকৃত বাংলাদেশি নয়। তারা নিজের দেশকে ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিলেও মনে কোনো দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই। অথচ এ দেশেরই কিছুসংখ্যক ছাত্র হ্যান্ড স্যানিটাইজার শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে, কিছু মানুষ নিজেরা মাস্ক তৈরি করে বিতরণ করতে ভোলেনি। এই দৃষ্টান্তও মানুষের প্রতি কল্যাণবোধ, সৃষ্টি হয়েছে হৃদয়ের ভেতর থেকে।

প্রকাশ | ৩০ মার্চ ২০২০, ০০:০০

আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
সারা পৃথিবীতে এখন আলোচনার একটাই বিষয়- করোনাভাইরাস। কীভাবে এই মারাত্মক ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং আক্রান্ত মানুষকে সেবাদান করে সুস্থজীবনে ফিরিয়ে আনা। এর মধ্যে একটা ছোট সুসংবাদও আছে। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর উৎপত্তিস্থল চীনের উহান অঞ্চল। এখান থেকেই ঝড়ের মতো এই ভাইরাস দ্রম্নত উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্প উন্নত দেশে ছড়িয়ে যায়। মানুষের জীবন ও চিন্তা যখন জরাগ্রস্ত ও বিপন্ন, সেই সময় উহান থেকে একটা ভালো সংবাদ এসেছে। এখানে পর পর সাত দিন কোনো মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। এই কারণে শহর থেকে উঠে গেছে লকডাউন। আড়াই মাস হাসপাতালে ক্লান্তিহীন সেবার বিন্দুমাত্র ত্রম্নটি করেননি চিকিৎসক আর নার্সরা। সুস্থ মানুষ এখন প্রত্যাবর্তন করতে শুরু করেছেন নিজেদের প্রিয় আবাসগৃহে। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে এক সময়ের আধুনিক সংগীতের খ্যাতিমান গায়ক টম জোনসের একটা বিখ্যাত গানের কথা। এক তরুণ অনেক দিন পর শহর থেকে তার প্রিয় গ্রামে ফিরে আসার সময় চারদিকে বিমুক্ত দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে ছোট গাছ হাত দিয়ে আদর করে গ্রামের চারপাশের সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গান গাইতে গাইতে হাঁটছে, গ্রিন গ্রিন গ্রাস অব হোম। আজ উহানেও মনে হয় সেই পরিবেশ। শহরবাসীরা আনন্দে বাজি পুড়িয়ে আকাশ করে তুলেছিল উজ্জ্বল আলোকময়। আকাশের উজ্জ্বলতা ঘোষণা করছিল উহানবাসীর আনন্দময় মনোভাব, আমরা কোভিড-১৯ কে জয় করেছি। আমরা আজ মুক্ত। এই কারণে এখন আর উহান থেকে বাইরে ভাইরাস বিস্তৃতির পরিস্থিতি অনুপস্থিত বলে সেখান থেকে লকডাউন বা তলস্নাশিচৌকি পর্যন্ত উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। চীনা চিকিৎসক ও নার্সরা যেভাবে মারাত্মক ভাইরাস থেকে মানুষকে বাঁচিয়েছে তা বোধহয় চীনাদের পক্ষেই সম্ভব। অথচ এর বিপরীত দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে। এখানে নিজেরা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে বিরত রেখেছে আত্মস্বার্থ। ব্রিটিশরা অবিভক্ত ভারত শাসনের সময় সাধারণ মানুষের সুবিধে ও আর্থিক নিরাপত্তা রেশনকার্ডের মাধ্যমে রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই ব্যবস্থা সুরক্ষিত ছিল কিন্তু এরশাদ সাহেবের সময়ে এই প্রাচীন ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসংখ্য রেশনের দোকানে বাজারের চেয়ে কম দামে ভোজ্যদ্রব্য বিক্রি হওয়ায় সর্বশ্রেণির মানুষ উপকৃত হন। বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে অসহায় করে তুলেছে। এর ঠিক বিপরীত অবস্থা ভারতের পশ্চিম বাংলায়। এখানে রেশনিং প্রক্রিয়া না উঠিয়ে সাধারণ মানুষকে আগের উপকারই দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কিছু কিছু প্রয়োজনীয় অভাব মেটানোর জন্য টিসিবি খোলা হয়। কিন্তু সীমিত আকারের এই প্রতিষ্ঠান সবসময় মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পারেনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রেশনিং প্রথা এখনো প্রচলিত আছে এবং অভাবের সময় শুধু নয়, অন্যসময়ও সাধারণ মানুষের উপকার করে চলেছে হ্রাসকৃত মূল্যে ভোজ্যদ্রব্য সরবরাহ করে। ভারত বৃহত্তর দেশ হওয়ায় সেখানে সমস্যাও অনেক। এখানেও মানুষ করোনাভাইরাসে বিব্রত এবং ভারতীয় অর্থনীতিতেও আঘাত করেছে। এই আঘাত সামলাতে শুধু নয়, মানবিক দিক সামনে রেখে এগিয়ে এসেছেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এখানে রেশনে এক কেজি চাল দেওয়া হতো দু-রুটিতে (বাংলাদেশের টাকায় দু-টাকা কুড়ি পয়সার মতো)। সাধারণ মানুষ স্বল্পমূল্যে চাল পেয়ে সংসার চালাতেন একটা স্বস্তির ভাব নিয়ে। সম্প্রতি ভাইরাস বিস্তৃতি ও অন্যান্য আর্থিক অসুবিধের কথা চিন্তা করে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন এখন থেকে রেশনে বিনামূল্যে চাল দেওয়া হবে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের আট কোটি মানুষ উপকৃত হবেন বিপদের সময় খানিকটা আশার আলো দেখে। এখানে মমতা ব্যানার্জি রাজনীতিতেও জিতেছেন আর মানবিক মুল্যবোধেও জয়লাভ করেছেন। এখানে বিজেপি নিজেদের সমর্থন যেমন হারাবেন, তেমনি পশ্চিম বাংলার সাধারণ মানুষও উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে তাদের মুখ্যমন্ত্রী শুধু রাজনীতি করেন না অভাবের সময় সবার পাশে এসে দাঁড়াতেও কার্পণ্যবোধ করেন না। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার দেশে ভাইরাস বিস্তৃতি ও আক্রান্তের ব্যাপারে যে ভাবেন না, তা নয়- দেশের কথা চিন্তা করেই বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ পালনের অধিকাংশ অনুষ্ঠানই করেননি এবং এর পাশাপাশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, করোনা যাতে বিস্তার লাভ করতে না পারে তার জন্য লকডাউনের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। কিন্তু এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার দিকও আছে। বিমান, অটো-রিকশা, রিকশা, বাস চলাচল বন্ধ হওয়ার কারণে অনেক কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের আর্থিক দিকের ওপর আঘাত পড়বে। এ দেশ দ্রম্নত প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও তা সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করেনি। এ দেশে অনেক দিনমজুর, কুলি দিনে যা উপার্জন করে তা দিয়ে পরিবার-পরিজন প্রতিপালন করে থাকে। তারা এই অবস্থায় বেকার হয়ে পড়বে। পশ্চিম বাংলা যদি আট কোটি মানুষকে বিনামূল্যে চাল দিতে পারে, বাংলাদেশেরও সেই সামর্থ্য যে নেই তা নয়- এদিক সরকার মানবিকভাবে চিন্তা করলে অনেক দরিদ্র মানুষ স্বাভাবিক সময়ের মতো দাঁড়ানোর ক্ষমতা ও সাহস পাবে। বাংলাদেশ সাধারণ মানুষের অবন্ধু মুনাফাকারী ব্যবসায়ীরা। যারা সুযোগ পেয়ে এক কেজি চালের দাম সাত টাকা বাড়িয়ে দেয়। সাধারণ পণ্য পেঁয়াজের দাম নিয়ে মানুষের সঙ্গে খেলা করে। তারা মানুষ হলেও প্রকৃত বাংলাদেশি নয়। তারা নিজের দেশকে ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিলেও মনে কোনো দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই। অথচ এ দেশেরই কিছুসংখ্যক ছাত্র হ্যান্ড স্যানিটাইজার শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে, কিছু মানুষ নিজেরা মাস্ক তৈরি করে বিতরণ করতে ভোলেনি। এই দৃষ্টান্তও মানুষের প্রতি কল্যাণবোধ, সৃষ্টি হয়েছে হৃদয়ের ভেতর থেকে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অর্ডার বাতিল করে দেওয়া হয়েছে যার মূল্য দেড়শ কোটি ডলার। ইউরোপ ও আমেরিকায় পোশাকের আউটলেটগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার আঘাত পড়েছে এ দেশের পোশাকশিল্পের ওপর। তার ওপর পৃথিবীর অনেক দেশেই শপিং সেন্টার বন্ধ করে দেওয়ায় পোশাকের চাহিদা অনেক হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে চিকিৎসা-সেক্টর ও খানিকটা বিপন্ন। ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে চিকিৎসকরা সাধারণ রোগীকে চিকিৎসা দিতে ভয় পাচ্ছেন। অনেকে ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ করে দিয়ে অনলাইনে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এখানে চিকিৎসকদের পক্ষে ও বিপক্ষে দুদিকেই যুক্তি আছে। যে কোনো ব্যাধির চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকদের ভিড় হওয়ার কারণ থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসক ও নার্সদের ভাইরাস-প্রতিরোধক কোনো পোশাক নেই। অথচ চীনের উহানে চিকিৎসক ও নার্সরা নিজেদের প্রাণের কথা না ভেবে নিয়মিত চিকিৎসা দিয়ে দেশ থেকে করোনা নির্মূল করেছেন। বাংলাদেশ যদি কোনোভাবে উহানের চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে নিজেদের দেশে ব্যবহারের সুযোগ পান তাহলে বোধহয় এ দেশ থেকেও এই ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আরও একটি প্রধান সমস্যা দেশের একশ্রেণির জনসাধারণ। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত করোনা প্রতিরোধে যা করণীয় তা তারা যেমন মানেন না, ঠিক একইভাবে সবার সঙ্গে মেলামেশা, বাইরে ঘোরা বা নিজেদের বাড়িতে আবদ্ধ থাকার নিয়মও মানেন না। দেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা না থাকলে এবং নিয়ম না মানলে কোনো রোগই সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক