পাঠক মত

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রভাব ও উত্তরণের উপায়

প্রকাশ | ০১ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

আলী আরমান শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
ইলেক্ট্রনিকস ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত হত্যা, গুম, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতার খবর প্রকাশ পায়। সামাজিক এসব অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলার মূলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলছে ভিনদেশীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কী? সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেছেন, 'আমরা যা তাই আমাদের সংস্কৃতি।' বিশদভাবে বলা যায়, কোনো অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের আচার-ব্যবহার, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, নাট্যশালা এ সবই তার সংস্কৃতি। কোনো জাতির পরিচয় তুলে ধরার জন্য সংস্কৃতি একটা বিরাট পন্থা হিসেবে কাজ করে। এটি একটি রাষ্ট্র বা জাতির মেরুদন্ড। সংস্কৃতি এমন এক শক্তিশালী নিয়ামক, যা কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের উন্নতির প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে। একটি দেশের একক সংস্কৃতি যখন অন্যান্য দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং অন্য সংস্কৃতির স্থান যখন সেই সংস্কৃতি নিয়ে নেয় তখন তাকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। অথচ আমাদের এই নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আজ ভিনদেশীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভেতর দিয়ে একটা দেশের নিজস্ব ইতিহাস, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ধরন উল্টাপাল্টা করে দেয়া হয়। অস্পষ্ট করে তোলা হয় তার আত্মপরিচয়কে। ভিনদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে, আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ভারতীয় ও পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের সংস্কৃতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্টার জলসা, স্টার পস্নাস, জি স্মাইল, জিটিভি, সনি, স্টার ওয়ানসহ তিন ডজন ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশে সম্প্রচার হচ্ছে। এসব চ্যানেল দেখে আমাদের শিশুরা মাতৃভাষা শেখার আগেই হিন্দি ভাষা রপ্ত করা শিখছে। মাতৃভাষা আজ হুমকির মুখে পড়েছে। এসব চ্যানেলের প্রভাবে তারা হিন্দি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। ভারতীয় চ্যানেলগুলোয় প্রচারিত কার্টুনগুলো আমাদের শিশুদের এতটাই প্রভাবিত করছে যে, বাসার টিভি অন করলেই তারা কার্টুন দেখতে চায়। বাসার বড় কেউ যদি খবর বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠান দেখতে চায় তাহলে তারা কান্নাকাটি শুরু করে। আর এসব কার্টুনগুলোতে এমন কিছু চরিত্র থাকে যার সংলাপ ও মুখভঙ্গি শিশুসুলভ নয়। এ ছাড়া কিছু কিছু টিভি সিরিয়ালে শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, অশালীন, ঝগড়া-বিবাদপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করানো হয় যা আমাদের শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের অন্তরায় ঘটে। এ ছাড়া বহু সিরিয়ালে এমন কিছু চরিত্র, সংলাপ, কাহিনী প্রচার করা হয় যার প্রভাবে সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এসব ভারতীয় সিরিয়ালে দেখানো পোশাক ও অলঙ্কারের অনুকরণে বাজারে পোশাক, অলঙ্কার তৈরি হয়। গ্রাম থেকে শহরে এসব ভিনদেশি পোশাক ও অলঙ্কারে ছেয়ে যায়। হুমড়ি খেয়ে জনগণ এসব কিনতে দোকানে দোকানে ভিড় জমায়। এসময় নানা অঘটন ঘটতে দেখা যায়। 'পাখি' ড্রেস কিনে না দেওয়ায় এক গৃহবধূর আত্মহত্যার ঘটনা আমরা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে না পারলে হারাতে হবে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। হারাতে হবে জাতি হিসেবে আমাদের স্বাতন্ত্র্যতা, হারাতে হবে আত্মপরিচয়। এসব সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের ভিনদেশি সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে দূরে থাকতে হবে। আমাদের দেশীও সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে। দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোকে মানসম্মত অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। সর্বোপরি দেশীয় সংস্কৃতি মনে-প্রাণে ধারণ করা চাই। এ ছাড়া আমাদের শিশুদের উত্তম শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে।