শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা ও আমাদের করণীয়

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়- করোনা সংক্রামিত হলেও মানুষ অত সহজে মরবে না। কারণ করোনা গ্রম্নপের এই ভাইরাসে মৃতু্যহার অনেক কম, শতকরা ৪ থেকে ৬ জন। আর গুরুতর অসুস্থ হতে পারেন শতকরা ১০ থেকে ১৪ জন। ১০০ জন সংক্রামিত হলে গড়ে ১২ জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন ও তার মধ্যে থেকে গড়ে ৫ জন মারা যেতে পারেন। অর্থাৎ গড়ে ৯৫ জন সুস্থ হবেন। আর ৮৬-৮৮ জন বিশেষ রোগভোগ ছাড়াই সুস্থ হবেন।
মোনায়েম সরকার
  ০২ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

পৃথিবীতে সবাই এখন কমবেশি আতঙ্কিত। এই আতঙ্কের কারণ কোভিড-১৯, যার পরিচিত নাম করোনাভাইরাস। এই ভাইরাসটি জনজীবন তছনছ করে দিচ্ছে। জনপদে হানা দিয়ে মানুষকে দিশেহারা করছে। বিজ্ঞানীরা দিনরাত চেষ্টা করছেন অভিনব এই ভাইরাসের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে। বিজ্ঞানীরা একদিন সফল হবেন আমরা সেই আশাই করি, কিন্তু তার আগে ঝরে যাবে অনেক মানুষের প্রাণ। যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। আমি চিকিৎসক নই, লেখক। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেটে করোনা নিয়ে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য পেয়েছি এই লেখা মূলত তারই সংক্ষিপ্ত সার।

নোবেল করোনার প্রকোপে মৃতু্যর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এতদিন যা ছিল চীনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ এখন তা ছড়িয়ে গেছে পাঁচটি মহাদেশের ১৯৪টি দেশে। অবশ্য ব্যাপক সতর্কতার সঙ্গে তা মোকাবিলারও চেষ্টা হচ্ছে। এই মোকাবিলা করতে গিয়ে সারা পৃথিবীই এখন হিমশিম খাচ্ছে। কয়েকটি দেশে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

জাতিসংঘ মনে করছে, এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ আগে কখনো হয়নি। এমনকি, দুটি মহাযুদ্ধের সময়ও শিক্ষাক্ষেত্রে এই সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেছিল চীন। সেখানেই প্রথম করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করে এবং ক্রমে তা মহামারির দিকে যেতে থাকে। বেজিং সরকার তখনই জানিয়েছিল, আপাতত স্কুল খোলার দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। নভেল করোনার প্রভাব যথেষ্ট কমেছে মনে করলে তবেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সমগ্র বিশ্ব এখন করোনা আতঙ্কে কাঁপছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদ দেখা দিয়েছে ইতালি, ইরান, আমেরিকা স্পেনএবং ফ্রান্সে। আমেরিকার কালিফোর্নিয়াসহ বেশ কয়েকটি প্রদেশে এর মধ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে আমেরিকায়।

ভাটিকান সিটি, মক্কা-মদিনা, কেরালা-তিরুপতির মন্দিরের দরজা বন্ধ। আইফেল টাওয়ার, স্পেনের রাজপ্রসাদ, ইতালির ভ্রমণপিপাসুদের দ্রষ্টব্যস্থানগুলোর জনশূন্য চিত্র বিশ্বের সব মিডিয়াতে ঘোরাফেরা করছে। ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে সাজো সাজো রব এবং যুদ্ধকালীন ব্যবস্থাপনা। আমেরিকাও পিছিয়ে নেই।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আগামী ৯ এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত বন্ধ রাখার নোটিশ জারি করা হয়েছে। এমনকি ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানও বাতিল করা হয়েছে। তার ওপর মিডিয়া জানান দিচ্ছে, মাস্ক-স্যানিটাইজার বাজার থেকে উধাও, চলছে কালোবাজারি। যেন বাঁচার শেষ অস্ত্রও হাতছাড়া। আর এই আবর্তে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতি যে গভীরতর মন্দায় নিমজ্জিত হবে- তাতে আশ্চর্যের কী?

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়- করোনা সংক্রামিত হলেও মানুষ অত সহজে মরবে না। কারণ করোনা গ্রম্নপের এই ভাইরাসে মৃতু্যহার অনেক কম, শতকরা ৪ থেকে ৬ জন। আর গুরুতর অসুস্থ হতে পারেন শতকরা ১০ থেকে ১৪ জন। ১০০ জন সংক্রামিত হলে গড়ে ১২ জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন ও তার মধ্যে থেকে গড়ে ৫ জন মারা যেতে পারেন। অর্থাৎ গড়ে ৯৫ জন সুস্থ হবেন। আর ৮৬-৮৮ জন বিশেষ রোগভোগ ছাড়াই সুস্থ হবেন।

এই করোনাভাইরাসকে 'নভেল' বলা হচ্ছে কেন? কারণ ডিসেম্বরের (২০১৯) আগে তার অস্তিত্ব জানা ছিল না। এই গোত্রের অন্য করোনাভাইরাস বিশ্ব আগে দেখেছে সার্স (২০০২) নামে। সার্স অর্থাৎ সিভিয়র অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম এবং মার্স মানে 'মিডিল ইস্ট অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম'। দুটির প্রকোপেই মৃতু্যহার ছিল অনেক বেশি।

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) রূপান্তর এত দ্রম্নত হয় যে, অবিশ্বাস্য গতিতে তা ছড়ায়, কিন্তু সুবিধা এই যে, যত বেশি রূপান্তর ঘটে বা চেহারা বদল করে, তত তার সংক্রমণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ক্রমশ নির্বিষ হয়। তাই চীন যেমন নিবিড় বৈজ্ঞানিক তৎপরতায় আর কঠোর শৃঙ্খলা প্রণয়ন করে এই ভয়ঙ্কর সংক্রমণকে বাগ মানিয়েছে, অন্য দেশকেও সেই পথ অবলম্বন করতে হবে। প্রথমে ভাবা হয়েছিল বাদুড় থেকে সাপে, পরে বলা হচ্ছে ম্যাঙ্গোলিন এবং কালাজ জাতীয় সাপের মাধ্যমে এই ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করে তান্ডব নৃত্য শুরু করেছে। কোভিড-১৯ এর রূপান্তর এত দ্রম্নত বলেই কোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। আজ পর্যন্ত হয়নি। সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে সংক্রমিত ব্যক্তিকে আটকে দেওয়া বা আইসোলেট করাই সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়।

এই মুকুটরূপী ভাইরাসের ওপর বর্মের মতো যে কাঁটাগুলো থাকে তা মানুষের কোষের এসিই-টু রিসেপ্টরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কোষে প্রবেশ করে, কোষকে পুরো দখল করে নিয়ে লাখ লাখ সংখ্যায় বংশ বিস্তার করে। ভাইরাস আক্রান্ত কোষগুলোকে দ্রম্নত মারতে থাকে। আর এই এসিই-টু রিসেপ্টর মানুষের ফুসফুসে, পৌষ্টিকতন্ত্র ও লিভারে বেশি সংখ্যায় থাকে বলে এই অঙ্গগুলো বেশি করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গুরুতর অসুখে নিউমোনিয়া হওয়ার এটাই কারণ। যাদের সিওপিডি, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, হৃদরোগ বা অন্যান্য ক্রনিক অসুখে ভোগার ফলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়- তাদের অসুখ গুরুতর হয়ে মৃতু্যর সম্ভাবনা বাড়তে পারে।

'ফেসাল মাস্ক'-সার্জিক্যাল বা 'এন-৯৫' সাধারণভাবে সবার ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। যারা ভিড় জায়গায় যাচ্ছেন বা অন্যান্য প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসকারী অসুখ-বিসুখে ভুগছেন তারা সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পরতে পারেন। জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে যারা সংক্রামিত হয়েছে, তার পারিপার্শ্বিক মানুষজন এবং চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা মাস্ক পরবেন। চিহ্নিত রোগীকে আইসোলেট করে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা এবং সন্দেহভাজনদের ২ সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখা (কোয়ারেন্টাইন) তাই রোগ প্রতিরোধের সেরা উপায়। এই রোগের এখনো কোনো প্রত্যক্ষ ওষুধ নেই। ৪ থেকে ১০ দিন রোগের ইনকিউরেশন পিরিয়ড (জীবাণুর শরীরে প্রবেশ থেকে রোগলক্ষণ প্রকাশের সময়)। তাই গড়ে ২ সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখা ও টেস্ট করা হচ্ছে। তবে বিপদ এই যে, রোগের লক্ষণ প্রকাশ হওয়ার আগেই ৫, ৬, ৭ দিনের মাথায় রোগজীবাণু ছড়ানোর ক্ষমতা সব থেকে বেশি। আরো সমস্যা ৬০ থেকে ৮০ ভাগ সংক্রামিত রোগীর কোনো রকম উপসর্গ দেখা নাও দিতে পারে। কিন্তু তারা রোগ ছড়াতে সক্ষম থাকবে। সার্স বা মার্সে এই সমস্যা ছিল না। রোগ-উপসর্গ ফুটে ওঠার পরই জীবাণুর অন্যকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা বাড়ত। তাই যাকে সন্দেহ করছি না বা নিজেও জানে না সে সংক্রমিত, সেও রোগ ছড়াতে সক্ষম। তাই আপাতত হ্যান্ডসেক, হাগিং, আলিঙ্গন, চুম্বন ইত্যাদি থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। অন্তত রোগমুক্তির প্রয়োজনে যদি চোখ-মুখ-নাকে হাত দেওয়া বন্ধ রাখি তাতে অন্যান্য বহু অসুখ-বিসুখ থেকেও মুক্ত থাকা যাবে। গোমূত্র, আয়ুর্বেদ, ইউনানি বা হোমিওপ্যাথিতে রোগ প্রতিরোধ করা যাবে বলে যে সব দাবি উঠেছে তা বিজ্ঞাসসম্মত নয়।

বিজ্ঞানসম্মতভাবে যা যা পদক্ষেপ সরকার-সমাজ ও ব্যক্তি মানুষের রোগ প্রতিরোধে নেওয়া দরকার তা নিতেই হবে। তবে অযথা 'প্যানিক' করার দরকার নেই। একটি মৃতু্যও এ দেশে বা বিদেশে কাম্য নয়। কিন্তু করোনা ছাড়াও অন্যান্য অসুখ-বিসুখে প্রতিদিন লাখ লাখ লোক মারা যাচ্ছে। শুধু ম্যালেরিয়াতে পৃথিবীতে প্রতি বছর ২ লাখের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এই জীবনগুলো নিশ্চয় মূল্যহীন নয়। তাই করোনাভাইরাস নিয়ে গেল গেল রব তোলার কোনো যুক্তি নেই। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে। চিকিৎসকদের পরামর্শ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। গুজবে কান না দিয়ে সবাই সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।

মোনায়েম সরকার: রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<94889 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1