নববর্ষে আমরা আরও মানবিক হই

বাংলা নববর্ষ মানে হাসি আর আনন্দের দিন। এ বছর আমরা না হয় একটু মানবিক হই। মানবিকতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করার চেষ্টা করি। এবারের নববর্ষ হোক একটু মানবিক নতুন বছরের শুরু।

প্রকাশ | ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

অলোক আচার্য
মানুষ মানুষের জন্য। পৃথিবীতে এ এক মহাসত্য বাণী যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে মানুষের পাশে এনে দাঁড় করিয়েছে। আর আজ যখন মানুষ করোনার মহামারিতে মারা যাচ্ছে তখনও মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে মহামারি চলছে। এই মহামারির নাম কোভিড-১৯। যা নভেল করোনা নামেই বেশি পরিচিত। চীনের উহান থেকে শুরু। তারপর একে একে করোনাভাইরাস এখন ২০০ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকটি দেশ হয়তো আর বাকি আছে এই ভাইরাসের কবল থেকে। তাও হয়তো আর থাকবে না। হাজার হাজার প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে এই তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংখ্যা। কোথায় গিয়ে এর তান্ডব থামবে তা হয়তো কারোরই জানা নয়। তবে একসময় তা শান্ত হবে। এর আগের মহামারিগুলোতে তাই হয়েছে। পেস্নগ বা সার্স বা এরকম যত মহামারি এসেছে সবই একসময় চলে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- যখন করোনাভাইরাসের প্রকোপ বন্ধ হবে তখন আমরা যে বিশ্ব পাবো সেই বিশ্ব কেমন হবে? উত্তর হলো সেই বিশ্বও মানবিক হবে। করোনাভাইরাসের মহামারি থেকে রক্ষা পেতে দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। বলা যায় পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশও এখন থমকে আছে। কারণ ঘরে থাকাই যে এই ভাইরাস থেকে বাঁচার একমাত্র ভালো উপায়। তাই মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। কিন্তু ঘরে থাকার সময়ে দেশে অসহায় মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে? আমরা আমাদের সবটুকু নিয়ে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো। ওরা যে এই বিপদে একলা নয় তা বোঝাতে হবে। বিশ্বের জন্য নভেল করোনাভাইরাস এক বিরাট ধাক্কা। এই ধাক্কা যে কেবল এই কয়েকদিনেই শেষ হবে তা বলা যায় না। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি দরিদ্র, অসহায় আর খেটে খাওয়া দিনমজুর যারা আজ উপাজর্নহীন জীবনযাপন করেছে তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে সবাই। বাংলাদেশ, ভারত সব দেশেই দেশের সরকার, প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যক্তি উদ্যোগ সবাই আজ এসব মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সবার তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে- এ কথারই সত্যতা জানান দিচ্ছে। কিন্তু তাতেই সমস্যার শেষ হচ্ছে না। আপাতত সমস্যা থেকে মুক্তি মিলছে মাত্র। করোনাভাইরাসের প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি। যার প্রধান শিকার হবে এসব দরিদ্র মানুষই। এসব দরিদ্র মানুষের সঙ্গে আরও দরিদ্র মানুষ যোগ হবে। অর্থাৎ আরও মানুষ দরিদ্র হবে। করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরে বিশ্ব ব্যাংকের আশঙ্কা বিশ্বের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ দরিদ্রতায় পতিত হবে। এর মধ্যে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ রয়েছে। খাদ্যে উৎপাদনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে বিধায় বিশ্বে বাড়বে খাদ্যের জন্য হাহাকার। এদিকে বিবিএসের পরিসংখ্যান (২০১৯) অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৬ লাখ মানুষের মধ্যে সোয়া তিন কোটি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে। আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে শুরু হয়েছে মন্দা। এ মুহূর্তে উদীয়মান দেশগুলোর প্রয়োজন আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার। তিনি এই মন্দা ২০২১ সালে সামলে উঠতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন। বিশ্ব অর্থনীতির মূল ধাক্কাটা যাবে কর্মী ছাঁটাইয়ের মধ্যদিয়ে মনে করা হচ্ছে। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক চীন, আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস অর্থনীতিতে ধস নামিয়েছে। দোকানপাঠ, বিমান চলাচল সব বন্ধ থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে নিরাপত্তাই মুখ্য সেখানে এর থেকে ভালো উপায় হয় না। এর ফলে আর্থিক বিশ্বমন্দার বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বোঝাই যাচ্ছে করোনার প্রভাব যখন স্থিমিত হওয়া শুরু করবে তখন দেশ এক নতুন চ্যালেঞ্জে পড়বে। সেই চ্যালেঞ্জ দরিদ্র মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ। আপাতত চ্যালেঞ্জ হলো নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রেখে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করা। এজন্য ঘরে থাকতেই হবে। কিন্তু ঘরে থাকার দিনগুলোতে দিনমজুর, মুটে, ক্ষুদ্র পেশাজীবী যারা দিন আনে দিন খায় তাদের সংসার চালানোর পথ তৈরি করতে হবে। এর প্রধান পথই হলো সহায়তা করা। সরকার তাই করছে। বিত্তবানরা এগিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব মানুষের সংখ্যা নেহায়েত অল্প নয় যে তা রাতারাতি সবাইকে করা সম্ভব হবে। এজন্য প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সহায়তা। যার যার অবস্থানে থেকে নিজের সামথ্য্য দিয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সামনেই বাংলা নববর্ষ। করোনাভাইরাসের কারণে এবছর সেই আগের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকবে না। না থাকুক। সবার মধ্যে যেন বেঁচে থাকার, তিনবেলা খাওয়ার আনন্দটুকু থাকে। আগে তো বাঁচতে হবে, তারপর আনন্দ। আমরা একটি কাজ করতে পারি। বছরের প্রথম দিন উপলক্ষে প্রতি বছরই আমরা পোশাকসহ নানা জিনিস কেনার পেছনে অর্থ খরচ করি। এবছর সেই জায়গা থেকে একটু সরে এসে তার কিছু অংশ অসহায় মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের মুখে অন্ন তুলে দিতে খরচ করি। তাতে হয়তো আমরা নতুন পোশাক পরতে পারব না কিন্তু মানুষ তো ভালো থাকবে। সেটুকুই না হয় এবছর থাক। প্রতি বছরই আমরা কত বাহ্য-আড়ম্বরে কত টাকা খরচ করি। তার সবটা না দিলেও চলবে। কিছুটা অংশ কেবল আমরা সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিই। তাহলেই তা বড় অংশ হয়ে দরিদ্রের মধ্যে ফিরে আসবে। বাংলা নববর্ষ মানে হাসি আর আনন্দের দিন। এ বছর আমরা না হয় একটু মানবিক হই। মানবিকতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করার চেষ্টা করি। এবারের নববর্ষ হোক একটু মানবিক নতুন বছরের শুরু। অলোক আচার্য : শিক্ষক ও কলাম লেখক