পাঠক মত

অবিশ্বাসের ইরাস ও সংক্রামক রোগ

প্রকাশ | ০৫ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
'ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নাই।'- নবীজীর (সা.) এই হাদিসটি নিয়ে কিছু ধর্মীয় প্রবক্তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তিমূলক কথা ছড়াচ্ছেন। কিছু লোক তার অন্য কিছু হাদিসের সঙ্গে এ হাদিসটিকে সাংঘর্ষিক বা স্ববিরোধীও ভাবছেন। বর্তমানে অত্যন্ত জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এসব নিয়ে আমার কিছু ভাবনা শেয়ার করতে চাই। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। যে লোকের নদী বা জলাশয়ের পানিতে নামা বা ডুব দিয়ে গোসল করার অভ্যাস নেই, নদীতে নেমে অল্প কয়েকটি ডুব দিলেই তার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। কারণ তার শরীরে ঠান্ডা প্রতিরোধক শক্তি কম। কিন্তু ডুবুরি সারাদিন নদীতে ডুবালেও, তার ঠান্ডা লাগে না। কারণ তার শরীরে ঠান্ডা প্রতিরোধক ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণে তৈরি হয়ে আছে। তেমনি যে কোনো ভাইরাসের আক্রমণ মানুষের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার কমবেশির ওপর নির্ভর করে। যার দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তার শরীরে সহজে ভাইরাস বা রোগ আক্রমণ করতে পারে না। যার শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তার শরীরে সহজেই যে কোনো রোগ বাসা বেঁধে বসে। তাই দেখা যায়, মহামারি আক্রান্ত এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকের কাজে থেকে ও রোগীর পরিচর্যা করেও কেউ কেউ সুস্থ দেহে বেঁচে থাকছেন। পক্ষান্তরে বহু সতর্কতার পরেও আবার কেউ কেউ সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন। এতেই বোঝা যাচ্ছে, মূল ক্ষমতা আসলে রোগের নয়, ক্ষমতা মানুষের প্রতিরোধ শক্তির। তাই নবী (সা.) এই হাদিসের অর্থ হলো মানুষের প্রতিরোধ শক্তিকে অতিক্রম করে রোগের কোনো ক্ষমতা নেই কারও দেহে সংক্রমণের। নবীজী যখন এ হাদিসটি বললেন, তখন এক বেদুইন বলল, হে আলস্নাহর রাসূল, আমার উটগুলো হরিণীর মতো সুস্থ থাকে। এরপর একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এগুলোর মধ্যে প্রবেশ করার পরে অন্যান্য উটও আক্রান্ত হয়ে যায়। তখন রাসূল (সা.) বলেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে সংক্রমিত করল? তার মানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কমতির কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক, প্রথম রোগটি যেমন আলস্নাহ দিয়েছেন, তেমনি সব রোগ-বালাই আলস্নাহর ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। তিনি আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, তার সব কিছু আলস্নাহর ইচ্ছাতেই হয়। জান-মালের ক্ষতির কারণে আমরা যদি ইমান-আমল ঠিক রাখার কথা ভুলে যাই, তাহলে আমাদের অন্তর প্রভুর প্রতি অবিশ্বাসের ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে। তাই মানুষের ইমানে অবিশ্বাসের ভাইরাস প্রবেশের প্রতিষেধক হিসেবে তিনি মহামূল্যবান এ হাদিসটি বলেছেন। তারপরেও এটুকু বলেই তিনি থেমে থাকেননি। পাশাপাশি সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক হতেও তিনি (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। 'রুগ্ন উট সুস্থ উটের কাছে নেবে না।' 'তোমরা কুষ্ঠ রোগী থেকে এভাবে পালাও, যেভাবে সিংহ দেখলে পালাও।' যার অন্তরে আলস্নাহর প্রতি ইমান মজবুত, নাস্তিক বা মুশরিকের সংস্পর্শে গেলেও, অবিশ্বাসের ভাইরাস তার অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু দুর্বল ইমানদারের ইমান তাতে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ইমান আকিদাগত এই ব্যাপারটি বস্তুগত বিষয়ের সঙ্গেও সম্পর্কিত। তাই প্রথমে কী করতে হবে? প্রভুর প্রেমভক্তি দিয়ে অন্তরের ইমানী শক্তি বাড়িয়ে নিতে হবে। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে কাম-ক্রোধ-লোভ-লালসার ফাঁদে পড়া যাবে না। তবেই সর্বশক্তিমানকে ভুলে থাকার ভাইরাস থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারব। মোহাম্মদ (সা.) মহামারি আক্রান্ত এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে নিষেধ করেছেন। কারণ পালিয়ে কখনো অবধারিত মৃতু্য থেকে বাঁচা যায় না। তিনি আরও বলেছেন, মহামারিতে নিহত হওয়া বিশ্বাসী ব্যক্তি আলস্নাহর কাছে শহিদের মর্যাদা পাবেন। কারণ মোমিন ব্যক্তি 'মুউতু কাবলান্তা মউত' অর্থাৎ মরার আগেই এক প্রকার মরে থাকেন। ভাগ্যকে মেনে মৃতু্যর জন্য তৈরি হয়ে থাকেন। নিজে বেঁচে থাকার আশায় দূষণমুক্ত স্থানে পালিয়ে গিয়ে সে এলাকার মানুষকে বিপদে ফেলেন না। জীবন-মৃতু্যর মালিকের কাছে মানুষের এমন কাজ খুবই পছন্দনীয়। মহানবী (সা.) মহামারি দুর্গত এলাকায় কাউকে প্রবেশ করতেও নিষেধ করেছেন। নিঃসন্দেহে তার এ সিদ্ধান্তগুলো জীবনবাদী ও মানবিক। পাপ-পুণ্যের এ জগতে মানুষ যুগে যুগে প্রাণিজগৎ, ভূমন্ডল, বায়ুমন্ডল, জলমন্ডল এসবকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তাদের স্বাভাবিক গতিপথ ও সৌন্দর্য নষ্ট করেছে। মানুষ নিজেরাও নিজেদের প্রতি জুলুম-অত্যাচার করে। এসব করে মানবজাতি যখনই পাপে ডুবে যায়, তখনই সৃষ্টিকর্তা তার বাণী দিয়ে পথপ্রদর্শক পাঠান। তারপরেও মানুষ তার বাণী অনুসরণ না করলে প্রকৃতির মাধ্যমে নেয়া হয় প্রতিশোধ। স্রষ্টার বিরুদ্ধে বা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায় না। এমন অসম যুদ্ধের কারণেই আজ পৃথিবীর এ পরিণতি। পৃথিবীর অনেক শহর আজ মানুষের বাস-অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। জলবায়ু বিষাক্ত বায়ুতে ভরে গেছে। সৃষ্টিজগৎ মানুষের সেবার জন্য তৈরি। তবে তার স্বাভাবিক ব্যবহার বা প্রোপার ইউজ করতে হয়। একদিন করোনাভাইরাস পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। আশার কথা হলো- আজ ২০২০ সালে ভূ-প্রকৃতি আবার তার স্বাভাবিক পথ কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছে। এদিকে পৃথিবীও দূষণমুক্ত হতে শুরু করেছে। নিউইয়র্ক শহরের দূষণ ইতোমধ্যেই ৫০% কমে গেছে। ডলফিন, তিমি এসব প্রাণী সমুদ্র সৈকতগুলোতে এসে ভিড় করছে। করোনার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হওয়ার পর অনেকটাই দূষণমুক্ত একটা নতুন পৃথিবী আমরা ফিরে পাব, যে পৃথিবীতে আবার আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারব- চলুন এই আশায় কিছু দিন বুক থাকি। প্রকৃতির বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ নয়। কারণ এ যুদ্ধ আমাদের ক্ষতি ছাড়া কল্যাণ বয়ে আনবে না। এ অল্প কদিনেই মানুষে-মানুষে স্নায়বিক ও সশস্ত্র প্রায় সব যুদ্ধই আজ থেমে গেছে। আমাদের এখন প্রতিজ্ঞা করার সময় এসেছে, বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার, প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার এবং ধর্মের নামে কোনো যুদ্ধে আমরা আর জড়িয়ে পড়ব না। এসব যুদ্ধ মানবতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। সব সময় আমাদের একটি যুদ্ধ করতে হয়। যে যুদ্ধকে ইসলামের নবী (সা.) বলেছেন 'জেহাদে আকবর' বা বড় যুদ্ধ। এ যুদ্ধ নিজের নফস বা আমিত্বের বিরুদ্ধে নিজের জ্ঞান-বিবেকের যুদ্ধ। আত্মসমালোচনা ও আত্মসংশোধনের জন্য এ যুদ্ধ। নিজে ভালো থাকতে ও অন্যদের ভালো রাখতে চিরকালই আমাদের এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে এ যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু নিয়ম-কানুন। তাই এ জন্য মনকে থিতু করে ঘরে বসে থেকে প্রভুর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে, মানুষের কাছেও ক্ষমা চাইব। শারীরিক সুস্থতার জন্য যা করতে হবে, তা কোনোভাবেই অবহেলার বিষয় নয়। পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য দিয়ে দেহে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে নিতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি নিয়ম মেনে সাবধানে ও নিরাপদে থাকতে হবে। সুস্থ থাকার জন্য এসব তো চিরকালের ব্যবস্থাই। রোগটির বিস্তার ঠেকাতে সাবান বা জীবানুনাশক তরল দিয়ে বারবার ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র থাকতে হবে। পারস্পরিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নিজেকে ও সবাইকে ভালো রেখে ভালোবাসতে হবে। এ যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতে হবে। ইনশালস্নাহ আমরা জয়ী হবো। জহির আহমেদ ঢাকা