বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

করোনা : শিক্ষা ও করণীয়

নতুনধারা
  ০৫ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

কোনোরকম অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই করোনাভাইরাস নামের একটি অণুজীব ২০০-রও বেশি দেশে অথবা পুরো বিশ্বে একটি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। চিকিৎসালয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠান বাদে পুরো বিশ্বের সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ করে মানুষকে ঘরে বন্দি থাকতে বাধ্য করেছে এই অণুজীব। চীনের উহান প্রদেশে সৃষ্ট এ ভাইরাস যেন পৃথিবীতে এক ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে এ ভাইরাস সংক্রমণের কারণে পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম শক্তিধর দেশ চীনে ৩৩০৪ জন, মানবতার শহর ইতালিতে ১০৭৭৯ জন, ক্ষমতার শহর আমেরিকায় ৩১৬৫ জন ও যুক্তরাজ্যে ১৭৮৯ জন মৃতু্যবরণ করেছে। এ ছাড়া বর্তমানে ইরান, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেনসহ পুরো বিশ্বে এক টালমাটাল অবস্থা বিরাজমান। ইতালিসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশি প্রবাসী দেশে ফেরাতে ও অন্যান্য কিছু কারণে বাংলাদেশেও এ ভাইরাসজনিত রোগ ছড়ানোর মাধ্যমে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায়, বিশেষজ্ঞরা অনেকাংশে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কারণ করোনাভাইরাস খুব সহজেই একজন থেকে অন্যজনের কাছে পড়ার ক্ষমতা রাখে। ১৯১৪ সালে ইউরোপে শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যেটিতে ৭০ মিলিয়ন সামরিক সদস্যের অংশগ্রহণ ছিল, ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যক্ষ ও ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরোক্ষভাবে খরচ হয়েছিল, ৯০ লাখ যোদ্ধা ও ৫০ লাখ নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিল, ২ কোটি ১০ লাখ সাধারণ মানুষ আহত হয়েছিল। চারটি সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়েছিল। একইভাবে ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের থেকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এ পৃথিবী। এ দুটি যুদ্ধই ছিল বিরাট অঙ্কের অর্থ-সম্পদ খাটানোর, অনেক পরিকল্পনার, অনেক চেষ্টা, পরিশ্রম ও রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের ফসল। এর যুদ্ধগুলো ছাড়া কয়েকটি মহামারি পৃথিবীকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এর মধ্যে ১৩২০ সালের দ্য বস্ন্যাক ডেথ অফ বুবোনিক পেস্নগ, ১৪২০ সালের দ্য এওইডেনিক অব বস্ন্যাক ডেথ পেস্নগ, ১৫২০ সালের গুটিবসন্ত ও পেস্নগ মহামারির হানা, ১৬২০ সালের মে ফ্লাওয়ার,১৭২০ সালের দ্য গ্রেট পেস্নগ অব মার্শেই, ১৮২০ সালের কলেরা মহামারি ও ১৯২০ সালের দ্য স্প্যানিশ ফ্লু অন্যতম। শুধু এই দ্যা স্প্যানিশ ফ্লুতেই মারা গিয়েছিল ১০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ। আর ১৩২০ সালের পেস্নগে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৩০-৬০ ভাগ মানুষ, ১৪২০ সালের পেস্নগে গোটা পৃথিবীর ৪০ শতাংশ মানুষ, ১৫২০ সালের গুটিবসন্ত ও পেস্নগে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ৯০ ভাগ আদিবাসী ও ১৫১৯ সালে মেক্সিকোতে স্মলপক্সের জন্য ৮০ লাখ মানুষ, ১৬২০ সালে লন্ডনের ২০ শতাংশ মানুষ, ১৭২০ সালে দ্য গ্রেট পেস্নগ অব মার্শেইতে ২০ কোটি মানুষ, ১৮২০ সালে ভারতবর্ষে কলেরায় কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। এ মহামারিগুলোর কারণে পৃথিবী শুধু মানুষের অস্বাভাবিক মৃতু্যই দেখেনি বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগতসহ ওই বিশ্বযুদ্ধগুলোর থেকেও বহুগুণ পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ মহামারি ঘটানোর জন্য বিশ্বযুদ্ধের অনুরূপ মানুষের অ্যাকটিভ কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। অদৃশ্য এক শক্তি দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল এগুলো। মোটামুটি সব ধর্মের মানুষই বিশ্বাস করেছে, এগুলো সৃষ্টিকর্তা-গড-ভগবান বা আলস্নাহর শক্তি অথবা ইচ্ছাতেই ঘটেছে। এর প্রমাণস্বরূপ কোরআনের আয়াত নেয়া যেতে পারে। সুরা আরাফে বলা হয়েছে, 'শেষ পর্যন্ত আমি এই জাতিকে পোকা-মাকড় বা পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত, পস্নাবন ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি দিয়ে ক্লিস্ট করি।' আরও বলা হয়েছে, 'ওর অধিবাসীদের আমি দুঃখ, দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি এবং অভাব-অনটন দ্বারা আক্রান্ত করে থাকি, উদ্দেশ্য হলো- তারা যেন নম্র এবং বিনয়ী হয়। 'উপরোক্ত মহামারিগুলোর মতো ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনে উৎপত্তি হওয়া করোনাভাইরাস (ঈঙঠওউ-১৯) পৃথিবীব্যাপী এক মহামারি রূপ ধারণ করেছে। পৃথিবীতে মোট ৭৮৫,৮০৭ জন আক্রান্ত হয়ে মোট ৩৭,৮২০ জন মৃতু্যবরণ করেছে। ছোট্ট একটি ভাইরাস হলো করোনা। যেটি একটি অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষকে লকডাউন ও আইসোলেশনের মতো ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেছে, শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা প্রচুর গবেষণা চালিয়েও ঈঙঠওউ-১৯ এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেননি। সারা পৃথিবীতে যখন লাশের মিছিল চলছে এবং ইতালিতে যখন প্রতিদিন শত শত লাশের স্তূপ দেখা যাচ্ছে ঠিক তখনই ইতালির মতো শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্টের মুখে শুনতে হয়, 'আমরা সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গিয়েছি। আর কি করতে হবে আমরা জানি না। পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন একমাত্র সমাধান আকাশের কাছে।' চীনের প্রেসিডেন্ট অন্য ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও মসজিদে গিয়ে তাকে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতে দেখেছি। আমরা নিউজে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের আক্রান্ত হওয়া, কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোর কোয়ারেন্টিনে থাকা ও তার স্ত্রী আক্রান্ত হওয়ার কথা, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের রাজার কোয়ারেন্টিনে থাকা, ইরানের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আক্রান্ত হওয়া এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর আইসোলেশনে থাকার কথা শুনেছি। আমরা জানি, এরকম নেতারা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোর নিরাপত্তা নিয়ে চলাফেরা করে থাকেন। এত ক্ষমতা, অর্থ-সম্পদ ও নিরাপত্তা কিন্তু অদৃশ্য ভাইরাস থেকে রক্ষা করতে পারেনি বরং এই ভাইরাসই তাদের মতো ক্ষমতাশীল এবং সবার মনে ভীতির সঞ্চার করেছে ও চিন্তিত করেছে। এই কথাগুলো বলে তাদের বা কাউকে কোনোভাবে খাটো করছি না বরং শিক্ষার উদ্দেশ্যেই এভাবে বলা। আমরা প্রযুক্তির যুগে সব কিছু করা সম্ভব বলে মনে করলেও, আমরা কিন্তু করোনার (ঈঙঠওঞ-১৯) প্রতিষেধক তৈরি করতে এখনো সক্ষম হইনি। এ থেকেই বোঝা যায়, আমরা মানুষ জাতি কতটা অসহায় ও দুর্বল। আমরা ক্ষমতার অহঙ্কার করে, অর্থের গরম দেখিয়ে, স্বার্থের জন্য একে অন্যের ক্ষতি করি, লড়াই করি। অথচ অদৃশ্য শক্তিচালিত একটা অণুজীবের সঙ্গেই পেরে উঠি না। আমরা অনেকেই আছি সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে গাদ্দারি করি অথচ তার সৃষ্টি ছোট্ট করোনার মতো অণুজীবই আমাদের শেষ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সুরা বাকারায় রয়েছে, 'নিশ্চয়ই আলস্নাহ মশা কিংবা এর চাইতেও তুচ্ছ বিষয় (ভাইরাস বা জীবাণু) দিয়ে উদাহরণ দিতে বা তার নিদর্শন প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। 'যাই হোক শেষ কথা হলো করোনা থেকে সবার শেখার বেশ কিছু আছে বলে মনে করি। করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচতে হলে, কি করা করণীয় এ প্রসঙ্গেও কথা বলা উচিত। বিশেষজ্ঞরা, ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, অকারণে ঘরের বাইরে বের না হওয়া, মাস্ক ব্যবহার করা, হাত ধুয়ে, চোখ, কান ও মুখ স্পর্শ করা, আবাসস্থল পরিষ্কার রাখা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ বেশকিছু নিয়ম-নীতির কথা বলেছেন। এগুলো মানতে হবে। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকাটাও খুবই জরুরি। হাদিসেও মহামারি আক্রান্ত এলাকা থেকে প্রস্থান করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং বাড়িতে বা আলাদাভাবে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। বর্তমানে ঈঙঠওউ-১৯ থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেটি খুবই প্রয়োজনীয়। আর যারা শ্রমিকশ্রেণির মানুষ বা ঘরহীন, সবার উচিত হবে তাদের সহযোগিতা করে নিরাপদ রাখা। আমাদের বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও বসুন্ধরা গ্রম্নপ, আকিজ গ্রম্নপ এবং বেক্সিমকোর মতো অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান করোনা মোকাবিলায় কাজ করার কথা বলেছে এবং বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটি নিশ্চয়ই প্রশংসার যোগ্য। আরেকটি বিষয় খুবই জরুরি বলে মনে করি, সেটি হলো- চিকিৎসক ও সেবাপ্রদানকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে টেস্ট করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই মুহূর্তে সবাইকে সেক্রিফাইস করেই চলতে হবে। বিশেষ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব থেকে বেশি নমনীয় হতে হবে। সবাইকে সবার দুঃখে দুঃখিত হতে হবে। আর ভাবতে অবাক লাগে সারাবিশ্বে যখন বর্তমানে লাশের স্তূপ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং বিবিসির খবরে প্রকাশিত, জাতিসংঘ যখন বাংলাদেশে ২ মিলিয়ন মানুষের মৃতু্যর আশঙ্কা করছে, তখন আমরা বাংলাদেশিরা সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ট্রল করে বেড়াচ্ছি। এই ক্রান্তিলগ্নে এগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে। এত মজা পাওয়ার কিছু নেই। এত সহজ ভাবারও কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেনও ইরানের মতো সমৃদ্ধ অর্থনীতির ও শক্তিশালী দেশগুলো যেখানে করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পারচ্ছে না সেখানে বাংলাদেশের উদাসীন হওয়া উচিত নয়। আসলে যারা আক্রান্ত হন, তারাই বোঝেন কত যন্ত্রণা। এখনই মানুষ মানুষের জন্য সাধ্যমতো কাজ করার সময়। বাংলাদেশে সম্প্রতি এই সংকটে ত্রাণ বিতরণে, দুর্নীতির কথা নিউজ করলে, এক সাংবাদিককে ইউপি চেয়ারম্যানের ছেলের মারধরের খবর শুনতে পেয়েছি আমরা। যা হতাশাজনক। আবার জামালপুরে পাঁচ বখাটে রাত তিনটায় এক কিশোরীকে করোনা টেস্ট করানোর কথা বলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। যা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। এখন আমাদের সংশোধিত হওয়ার সময়, অন্যের ক্ষতি করার নয় বরং নমনীয় হওয়ার। সৃষ্টিকর্তাকে চেনার সময় এটা। এ জন্য বলছি আসুন আমরা যার যার ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, কোন ধর্মের বা কোন বর্ণের মানুষ বেশি বিপদগ্রস্ত হলো, গজবপ্রাপ্ত হলো এগুলো না ভেবে সবাই সবার জায়গা থেকে সবার জন্য দোয়া-আশীর্বাদ করে, একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়ে, একযোগে সতর্ক বা সচেতন হয়ে সুন্দরভাবে পৃথিবীতে বাস করার চেষ্টা করি।

মো. জাফর আলী

শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<95252 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1