শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার বিস্তার রোধে জনসাধারণকে ঘরে থাকতে ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে বাধ্য করুন

দেশে সামনে কঠিন সময় আসছে। অঞ্চলভিত্তিক নয়, পুরো দেশ লকডাউন করা জরুরি। এখনই পুরো দেশ লকডাউন না করা হলে এ ভাইরাস আগামী ১৫ দিনে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, কেড়ে নিতে পারে অনেকের জীবন। নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনলে অন্যের কিছুই করার থাকে না। আমরা আগে থেকে সতর্ক হলে পরিস্থিতি হয়তোবা এমন নাও হতে পারত। এখনো সময় আছে জনগণকে ঘরে থাকতে ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে বাধ্য করুন।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০৮ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

বিশ্বব্যাপী এক মহাতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। পৃথিবীব্যাপী এক মহাবিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে এই ভাইরাস। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হলেও গত তিনদিনে এই অঞ্চলের অবস্থা ভালো নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থা খারাপের দিকে। বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মৃতু্যর হার সবচেয়ে বেশি। ভারতে আক্রান্ত প্রায় ৫ হাজার, মারা গেছে ১৩০ জন। পাকিস্তানে আক্রান্ত প্রায় ৪ হাজার, মারা গেছে, ৫২ জন। বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃতু্যর হার দ্রম্নত বাড়ছে, যার ফলে মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়ছে। কারণ দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪১ জন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এই সময়ে মারা গেছেন আরও ৫ জন। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬৪ জন এবং মৃতু্য হয়েছে ১৭ জনের। এই সংখ্যা দ্রম্নত বাড়ার সম্ভাবনা তীব্র। পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর পর দেশে তিন-চার দিন ধরে অনেকটা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। যা প্রকৃত অর্থেই উদ্বেগজনক। তবে মালদ্বীপ নেপাল ভুটানে আক্রান্ত সংখ্যা কম। এই তিন দেশে এখনো কারো মুতু্য হয়নি। বিশ্বের মধ্যে বেশি আক্রান্ত দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, চীন, ইরান, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক ও সুইজারল্যান্ড।

সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার যে সব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা দেশের জনগণ মানছে না। তারা তাদের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করছে। বলা হচ্ছে, ঘরে থাকতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। মানা হচ্ছে না তাও। দেশের সাধারণ মানুষের মনোভাব এমন যে, বিশ্বে বা দেশে কিছুই হয়নি। এই ধরনের মানসিকতায় ও খামখেয়ালিপনায় যে বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনছে সে দিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার মাইকিং করে বলা হচ্ছে- ঘরে থাকার জন্য, পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য। কে শোনে কার কথা। নির্দেশ অমান্য করে যারা বিনা কারণে ঘুরাঘুরি করছে, তাদের জরিমানাও করা হচ্ছে। তারপরেও মানুষ সচেতন কিংবা সাবধান হচ্ছে না। বিশেষ করে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ এবং এক শ্রেণির তরুণ। তারা এ ব্যাপারে গা করছে না। রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে তাদের অবাধে ঘুরতে দেখা যায়, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা না করেই। এমন কি কেনাকাটার সময়ও তারা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলে না। কেবল তাই নয়, বস্তিবাসীরা কোনো ধরনের সামাজিক দূরত্ব মানছে না। তারা আগের মতোই খোশ গল্পে মত্ত থাকছে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের ধারণাও কম। আবার কেউ কেউ এও বলছে, 'মউত আসলে মারা যামু'। গ্রামের নিরীহ মানুষের ধারণাও এমন। মরতে তো একদিন সবাইকেই হবে, এটা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত ও অবধারিত। করোনাভাইরাস সম্পর্কে অসাবধানতা বা অসতর্কতা আত্মহননের শামিল।

\হপ্রধানমন্ত্রী নিজেও এই নির্দেশনা দিয়েছেন। কাজ হচ্ছে না তাতেও। প্রধানমন্ত্রী যার যার ঘরে থেকে প্রার্থনার কথা বলেছেন। এটাও গা করছেন না ধর্মপ্রাণ মুসলিস্নরা। তারা মসজিদে গিয়ে গা ঘেঁষে জামাতে নামাজ পড়ছেন। নামাজ শেষে বাইরে আড্ডাও দিচ্ছেন। আমরা যদি ইসলামের কেন্দ্র ভূমি সৌদি আরবের দিকে তাকাই সেখানে মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। সেখানে কারফিউ জারি করা হয়েছে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। আর আমরা বাংলাদেশে আবেগ ঝরাচ্ছি। আবেগ ও অসাবধান যে বিপদ ডেকে আনবে সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। আশার কথা, এখন থেকে মুসলিস্নদের ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মসজিদে শুধু ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরা নামাজ আদায় করবেন। বাইরের মুসলিস্নরা কেউ মসজিদে জামাতে অংশ নিতে পারবেন না। কেউ এই নির্দেশ অমান্য করে মসজিদে ভিড় করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নেবে বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে দোকান ও কাঁচাবাজার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের হাটবাজারগুলোতে এখনো মানুষের ভিড়। প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষ করোনা সম্পর্কে জানে না, জানে না এর ভয়াবহতা সম্পর্কে। তারা অবাধে মেলামেশা করছে। ফলে বাংলাদেশ কমিউনিটি সংক্রমণের দিকে ঝুঁকছে। একদিনেই আক্রান্ত হয়েছে ৩৯ জন, মারা গেছে ৩ জন (৬ এপ্রিল ২০২০)। এতে বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৩টি দেশ ও অঞ্চল আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সাড়ে ১৩ লাখ, মৃতু্যর সংখ্যা ৭৫ হাজার। বিশ্বে একদিনেই আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার। ঘন্টায় আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি।

আমাদের জন্য নেতিবাচক দিক হচ্ছে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এখনো। চিকিৎসা সংকট রয়েছে, রয়েছে অন্যান্য সংকটও। আরো একটি খারাপ দিক হচ্ছে- ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা কাজ করছে।

নভেল করোনাভাইরাসের মহামারি নিয়ন্ত্রণে চলমান লকডাউনের মধ্যে জরুরি সেবার সঙ্গে নিয়োজিতরা ছাড়া রাজধানীকে কেন্দ্র করে মানুষের আগমন-বহির্গমন ঠেকাতে কঠোর হতে বলেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) জাবেদ পাটোয়ারী। বলতে গেলে ঢাকা কার্যত লকডাউন। দেশজুড়ে লকডাউনের সিদ্ধান্তের মধ্যে কারখানা খোলার সিদ্ধান্তের জন্য মালিকদের এবং হাজার হাজার মানুষকে দলে দলে এতটা পথ পাড়ি দিতে দেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন সমালোচনার মুখে পড়ে। পরে রাতে সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটি পর্যন্ত গার্মেন্টস কারখানাগুলো বন্ধ রাখতে পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ মালিকদের প্রতি আহ্বান জানায়।

মালিকপক্ষের লোভের কোনো অন্ত নেই। শ্রমিকদের নিয়ে খেলছেন গার্মেন্ট মালিকরা, আর দেশবাসীকে ফেলেছেন করোনার নতুন সংক্রমণের হুমকিতে। প্রত্যেক নাগরিকের সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিছু গার্মেন্ট খোলা রেখে বিপুল উৎপাদনশীল অংশকে মৃতু্যঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া হলো। যদিও শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে গার্মেন্ট বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। যে সব প্রতিষ্ঠান মাক্স ও পিপিই তৈরির কাজে নিয়োজিত, ওই সব প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হবে।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন- যা জিডিপির ২.৫২ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে এ সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবগুলো তুলে ধরে এ থেকে উত্তরণে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোসহ চারটি কার্যক্রম নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন তিনি। সরকারের এই প্রণোদনার স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে চাটার দল এখনো সক্রিয়। গরিবের ত্রাণ মেরে দেয়ার ক্ষেত্রে এরা সিদ্ধহস্ত।

দেশে কিছু এলাকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। সতর্ক না হলে এসব এলাকায় সামাজিক সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগ, বাসাবো, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও গাইবান্ধা। অনলাইন ব্রিফিংয়ে রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যাদের করোনা শনাক্ত করতে পেরেছি, তার মধ্যে ১২ জনই নারায়ণগঞ্জের। এর পরেই রয়েছে মাদারীপুর এলাকা। দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীতে ৬৪ জন, নারায়ণগঞ্জে ২৩ জন, মাদারীপুরে ১১ জন, চট্টগ্রাম দুইজন, গাইবান্ধায় পাঁচজন এবং চুয়াডাঙ্গা, কুমিলস্না ও কক্সবাজারে একজন করে আক্রান্ত রয়েছেন। এ ছাড়া জামালপুর তিনজন, গাজীপুর, মৌলভীবাজার, নরসিংদী, রংপুর, শরীয়তপুর ও সিলেটে একজন করে আক্রান্ত রয়েছেন ( ৬ এপ্রিল, ২০২০)। দেশের মোট ১৫ জেলায় এ কেস রয়েছে।

দেশের চেয়ে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিরা রয়েছে বেশি বিপদে। এ পর্যন্ত বিদেশে মারা গেছেন ৮০ জন বাঙালি। যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন কমপক্ষে ৬৩ জন, যুক্তরাজ্যে মারা গেছেন ১১ জন, সৌদি আরবে ৫ জন, কাতারে ২ জন, ইতালিতে ২ জন, স্পেনে ১ জন, গাম্বিয়ায় ১ জন। যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

দেশে সামনে কঠিন সময় আসছে। অঞ্চলভিত্তিক নয়, পুরো দেশ লকডাউন করা জরুরি। এখনই পুরো দেশ লকডাউন না করা হলে এ ভাইরাস আগামী ১৫ দিনে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, কেড়ে নিতে পারে অনেকের জীবন। নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনলে অন্যের কিছুই করার থাকে না। আমরা আগে থেকে সতর্ক হলে পরিস্থিতি হয়তোবা এমন নাও হতে পারত। এখনো সময় আছে জনগণকে ঘরে থাকতে ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে বাধ্য করুন।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<95577 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1