কেমন হবে করোনা-পরবর্তী বিশ্ব?

এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে প্রকৃতির ওপর বিজয় বলে মনে করা হতো, মানুষ তা আর করবে না। অন্যায়ের ষোলোকলা পূর্ণ করার চেষ্টা করবে না মানুষ। পূর্বের চেয়ে অনেকটাই মানবিক হবে আগামীর বিশ্ব।

প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

মাছুম বিলস্নাহ
বিশ্বের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ গৃহবন্দি, নিজেই নিজেকে বন্দি করে রেখেছে। অপেক্ষার পালা আর শেষ হচ্ছে না বরং প্রতিদিন নতুনভাবে মৃত ও নতুনভাবে আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। কী হবে এর পর? সন্দেহ নেই আমরা ধনী-গরির, উন্নত-অনুন্নত, শিল্পোন্নত আর শিল্পে পিছিয়ে পড়া সব দেশ ও জাতি এখন আর কলকারখানায় বর্জ্য উৎপাদন করছি না, রাস্তায় লাখ কোটি গাড়ি হর্ন বাজিয়ে পরিবেশ দূষিত করছে না, লাখ লাখ খাবারের দোকান ভেজাল মিশিয়ে আমাদের খাবার খাওয়াচ্ছে না, মানুষ অযথা আড্ডা মেরে পরিবেশ দূষিত করছে না। এগুলো আমরা অহরহ করতাম আমাদের বিরুদ্ধে; মানবজাতির বিরুদ্ধে। স্রষ্টার কোনো কথা আমরা কানে তুলতাম না। এখন আমরা সবাই গৃহবন্দি। গৃহবন্দি থাকার কারণে বিশ্বে কোটি কোটি ব্যারেল তেল, লাখ লাখ ঘনফুট গ্যাস আর অন্যান্য ধরনের জ্বালানি ও বিদু্যৎ বেঁচে যাচ্ছে। বড় বড় জাহাজ, স্টিমারসহ পানিতে চলা সব ধরনের পরিবহনগুলোও বন্ধ। আমারা নদীর পানি, সমুদ্রের পানিও দূষিত করে ফেলেছিলাম। আর এগুলো থেকে যে বর্জ্য বের হতো তা মানুষ তথা গোটা বিশ্বের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কিন্তু মানুষ এগুলো শুনতো না, নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে আনার মহা উলস্নাসে মেতে থাকত। তাই প্রকৃতি নিজের হাতে নিয়েই আবার প্রকৃতির দূষণ কমাচ্ছে। তাই, করোনা পরবর্তী বিশ্বে দূষণের মাত্রা কম হবে, পরিবেশ অনেকটাই নির্মল হবে, শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে আমাদের সুবিধা হবে। প্রাণিকুলও আমাদের অত্যাচার থেকে অনেকটাই রেহাই পাবে। গরিব ও অনুন্নত দেশ থেকে লাখ কোটি মানুষের স্রোত পশ্চিমা বিশ্বের দিকে আর আগের মতো থাকবে না কারণ মানুষ কোথাও নিরাপদ নয়। অনেকেই ধরে নিত যে, উন্নত বিশ্ব প্রকৃতিকে জয় করে ফেলেছে। অতএব, প্রাকৃতিক যত ঝামেলা তা গরিব ও অনুন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেই বইবে কিন্তু করোনা সেই ভুল ভেঙে দিয়েছে তাই মানুষ পাগলের মতো আর পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ছুটবে না। নিজের দেশ ও মাটি ছেড়ে মানুষ আগের মতো আর যাবে না, নিজের দেশেই নতুন কিছু করার চিন্তাভাবনা করবে- যা পৃথিবীর জ্ঞানভিত্তিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করবে। অনুন্নত দেশগুলোতে দক্ষ মানুষ নিজের দেশেই কিছু করার চেষ্টা করবে- যা ওই দেশগুলোর জন্য মঙ্গলজনক হবে। প্রতিটি দেশেই দুষ্ট রাজনীতির ওপর কিছুট ছেঁদ পড়বে, রাজনীতি সিকি পরিমাণ হলেও মানুষের কল্যাণের দিকে মোড় নেবে। 'দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যেমন ব্যাপকভাবে নারীমুক্তি ঘটেছিল, ব্যক্তিস্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, সামন্তবাদ ও উপনিবেশবাদের জন্য কবর রচিত হয়েছিল, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত নতুন মানবসমাজ গঠনের পথ তৈরি হয়েছিল, তেমনি এই ভাইরাস সংক্রমণের মহাধ্বংসযজ্ঞ থেকে যে বিশ্ব বেঁচে উঠবে তাতে ধনতন্ত্র থাকবে, কিন্তু তার বিষদাঁত ভেঙে যাবে। নতুনভাবে সাহসী সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটবে। নতুনভাবে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠবে। তার প্রকৃত চেহারাট আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না তবে শিগগিরই হয়তো দেখতে পাব।' -এ কথা বলেছেন, বিশিষ্ট কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী। আমি তার সঙ্গে একমত পোষণ করছি, কারণ আমরা জানি, 'মেঘের পর সূর্য্য আসে।' মানুষ তার চরম সীমাবদ্ধতার কথা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। সে তার দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করত। সর্বত্রই সে সীমা লঙ্ঘন করত। করোনা পরবর্তী বিশ্বে কিছুটা হলেও সে মাথা নত করে চলবে, কিছুদিন হলেও নিজের দম্ভ আর প্রকাশ করবে না। আর সীমা লঙ্ঘন করার চেষ্টা করবে না সহসা। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, ইরাক থেকে সেনা প্রত্যহার করা হয়েছে। সংঘাত বন্ধ করে আরব ইসরাইল সুপ্রতিবেশীর মতো বসবাস করছে। ইসরায়েলি দানবরা আর নিরীহ ফিলিস্তিনীদের ওপর চড়াও হচ্ছে না বরং ভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য মুসলিম, ইহুদি আর খ্রিষ্টান মিলে প্রার্থনা করছে স্রষ্টার কাছে। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের কান্না হয়তো কিছুদিনের জন্য হলেও থেমে থাকবে, বিশ্বের অসুর ও দস্যরা তাদের দসু্যবৃত্তি কিছুদিনের জন্য হলেও থামাবে। ভারতের রাস্তায় দাঙ্গাবাজরা মানুষকে উলস্নাস করে পিটিয়ে মারছে না, সবাই গৃহবন্দি। মিয়ানমারের নরপশুরা নিজেদের ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষার উপায় খুঁজছে, বাকি রোহিঙ্গাদের ওপর চড়াও হচ্ছে না। মানবজাতি এভাবেই মহামারির মতো মহাবিপর্যয়ে পড়লে কিছু সময়ের জন্য হলেও থমকে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে চরম ও নিষ্ঠুরভাবে পরাজয়ের পর জাপান সভ্য হয়েছে। পরিহার করেছে তার আগ্রাসী ভূমিকা, অবতীর্ণ হয়েছে গোটা বিশ্বে দ্বিতীয় উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে। করোনার পরে যুদ্ধবাজ জাতিগুলো তাদের সামরিক ব্যয় কমাবে, মানুষ ও মানবতা ধ্বংসের নেশা থেকে অনেকটা ফিরে আসবে। গোটা বিশ্বে কোনো মানুষ অসহায় থাকার কথা নয়, কিন্তু যুদ্ধবাজরা কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে তা হতে দেয় না। করোনা পরবর্তী বিশ্বে সামরিক ব্যয় কমিয়ে কিছুটা হলেও মানবকল্যাণে পূর্বের চেয়ে অর্থ বেশি ব্যয় করা হবে। চলমান করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে চরম অর্থনৈতিক মন্দায় ক্ষতির মুখে রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। যার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর ওপরও। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে তা এ অঞ্চলের অন্তত এক কোটি ১০ লাখ মানুষকে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর যে খারাপ প্রভাব পড়েছে তাতে সব দেশই তাৎপর্যপূর্ণভাবে আক্রান্ত হবে। এতে যেসব পরিবারের জীবিকা শিল্প-কারখানার ওপর নির্ভরশীল, তারা চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন। এটা তাদের জন্য অশনিসংকেত। কারণ অব্যাহত লোকসানের কারণে অনেক শিল্প-কারখানায় কর্মী ছাঁটাই হতে পারে, আবার অনেকগুলো বন্ধও হয়ে যেতে পারে। যাদের আয় সাড়ে পাঁচ মার্কিন ডলারের নিচে তারাই দরিদ্র। ২০২০ সালে তিন কোটি ৫০ লাখ মানুষের দারিদ্র্যমুক্তির পূর্বাভাস ছিল। কিন্তু করোনার কারণে ২ কোটি ৪০ লাখের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্তি থমকে যেতে পারে। ট্রাম্প বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা বা ইকোনমিক ডিপ্রেশন শুরু হতে যাচ্ছে তা হবে এই ভাইরাস মহামারির চেয়েও ভয়ঙ্কর। একই কথা বলেছেন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কিছু অর্থনীতিবিদও। করোনাভাইরাসের ওষুধ যেমন এখনো আবিষ্কৃৃত হয়নি, তেমনি আসন্ন ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা প্রতিরোধেরও কোনো উপায় ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতিবিদরা খুঁজে বের করতে পারেননি। মানবজাতি অসহায় অবস্থায় এক কাতারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিশাল নেতিবাচক ধস নামার হিসাব প্রকাশ করছে। জাতিসংঘর মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতরেসের মতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে বড় সংকট ও মন্দার মুখোমুখি আমরা। এ পর্যন্ত ১৯০টি দেশে ১০ লাখের বেশি লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে আর প্রাণ হারিয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি। তবে, পৃথিবী এ থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে প্রচন্ড শক্তিমত্তা যুক্ত হবে। এই সংকটের মধ্যেই অপেক্ষা করছে অনেক বড় বড় সুযোগ- যে সুযোগগুলো মানুষ হয়তো সৎভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করবে। ২০২০ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে ২.১ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এমনকি তা মাইনাস ০.৫ শতাংশও হতে পারে। অথচ ২০১৯ সালে এ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৮ শতাংশ। অন্যেিদক করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনে প্রবৃদ্ধির গতি কমে নামতে পারে ২.৩ শতাংশে। এমনকি তা সবনিম্ন ০.১ শতাংশ হতে পারে। আমাদের অর্থনীতিতে সবচেয়ে সুবিধাজনক খাত ছিল রেমিট্যান্স। এবার জানুয়ারিতে তা ৫ কোটি ডলার কমেছে, ফেব্রম্নয়ারিতে কমেছে ১৯ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স উৎস দেশ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় কোভিড-১৯ এর বিস্তার ব্যাপকতর। যেহেতু ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া আছে, তিন হাজার ৬০ কোটি টাকা সেটি আর হয়তো সম্ভব হবে না। দেশের বিশালসংখ্যক ফ্রিল্যান্সার এবং সফটওয়্যার খাত সংকটে পড়েছে এবং এটি অব্যাহত থাকবে অনেক দিন। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা সরকারকে জরুরিভাবে মোকাবিলা করতে হবে, মানে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আর তা না হলে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংকট প্রলম্বিত হয়ে অনুৎপাদনশীলতার জন্ম হবে, যার আর্থিক দায় ব্যাপক। দ্বিতীয় সংকট হতে পারে খাদ্য ও মানবিক সংকট। এগুলো অনুন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ঘটবে। এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে ডাবিস্নউএইচও'র কর্মকর্তা কাসাই বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এ মহামারি দ্রম্নত শেষ হবে না। এ পরিস্থিতি দীর্ঘ সময়ের এক লড়াই। আমরা কিছুতেই অসতর্ক হতে পারব না। ডবিস্নউএইচও'র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ম্যাথিউ গ্রিফিথ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো দেশই নিরাপদ থাকবে বলে মনে করে না। কারণ, করোনাভাইরাস সবখানেই পৌঁছে যাবে। মহামারির কেন্দ্র এখন ইউরোপ হলেও এক সময় অন্য অঞ্চলগুলোরও এর কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন। তার মানে কি, গোটা বিশ্বেই দাপিয়ে বেড়াবে এই ভাইরাস, সবাই থাকবে আতঙ্কে আর তাই এতদিন উলস্নাসের মধ্যে যত খারাপ কাজ করত তা থেকে বিরত থাকবে। বিশ্বে করোনাভাইরাসে যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে প্রথম ৬৭ দিনে, পরবর্তী এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন পরবর্তী ১৪ দিনে, তার পরের এক লাখ আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র চারদিনে। এ অবস্থা মানুষের অসহায়ত্বকে ভালোভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এবং এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে প্রকৃতির ওপর বিজয় বলে মনে করা হতো, মানুষ তা আর করবে না। অন্যায়ের ষোলোকলা পূর্ণ করার চেষ্টা করবে না মানুষ। পূর্বের চেয়ে অনেকটাই মানবিক হবে আগামীর বিশ্ব। মাছুম বিলস্নাহ: কলাম লেখক