শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস : পরিবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বার্তা

স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সম্পর্কিত বিভিন্ন নির্দেশনা এবং বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য দৈনন্দিন ব্রিফিংয়ের দিকে দেশের মানুষ চেয়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতাদের করোনাভাইরাস সম্পর্কিত বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের বড় ধরনের ভূমিকার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
  ০৯ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

কোভিড-১৯ প্রতিটি মানুষের জীবনকেই পুরোপুরি ঝাঁকিয়ে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে। গত ৮ মার্চ ২০২০ প্রথম বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পায় দেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। দেশে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ২১৮ জন, সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছেন ৩৩ জন এবং মৃতু্যবরণ করেছেন ২০ জন। প্রায় প্রতিটি দেশেই করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং কমসংখ্যক মৃতু্যবরণ করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত যে রেকর্ড দেখা যাচ্ছে তাতে একমাত্র যুক্তরাজ্যে সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যার চেয়ে মৃতু্যবরণকারীদের সংখ্যা বেশি।

তবে অদূর ভবিষ্যতে এই দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেরিও গুতেরেস বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব এমন দুর্যোগের মুখোমুখি আর হয়নি। তবে এই মহামারির ফলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন এড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। করোনাভাইরাস মহামারির সংক্রমণ চলাকালেই একজন ধর্মীয় নেতা বলছেন, 'আমরা আলস্নাহর কাছে পরিবর্তন চাই। আমাদের মনের পরিবর্তন চাই। আমাদের চাহিদার পরিবর্তন চাই। আমাদের চিন্তার পরিবর্তন চাই ...।' করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যদি দীর্ঘকাল ধরে চলে, অথবা যখন এই সংক্রমণ বন্ধ হবে তারপর বাংলাদেশে কী ধরনের পরিবর্তন হবে তা পূর্বানুমান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই হয়তো এটি করবেন। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের পূর্বানুমান শুরু হয়ে গিয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে বাংলাদেশে কী ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে তার মধ্য থেকে শুধু সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, 'পরিবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ' সম্পর্কে আলোকপাত করা হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকান্ডের সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন, মূল্যবোধ, অভ্যাস, বিশ্বাস, সংস্কৃতি প্রভৃতির সামঞ্জস্য বিধানের তথা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করছে। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সম্পর্কনির্ভর করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা ঘোষিত নিয়ম-কানুন নাগরিক তথা রাষ্ট্রের অধিবাসী মানুষ কতটুকু অনুসরণ করছে তার ওপর।

আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয় আইন এবং আইনের দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং প্রযুক্ত নিয়ম-কানুন প্রভৃতির দ্বারা, অন্যদিকে সমাজ বা সমাজের মানুষ পরিচালিত হয় তাদের বিশ্বাস, অভ্যাস, প্রথা, প্রভৃতি দ্বারা প্রযুক্ত নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে। অন্যভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রের আছে আইন এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট কতিপয় প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে নাগরিক সমাজের আছে প্রথা, বিশ্বাস, অভ্যাস প্রভৃতি। নাগরিক সমাজের প্রথা, বিশ্বাস, অভ্যাস যদি রাষ্ট্রীয় আইন এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ম-কানুনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে ধরা নেয়া যেতে পারে। আর তা না হয়ে যদি নাগরিক সমাজের প্রথা, বিশ্বাস, অভ্যাস যদি রাষ্ট্রীয় আইন এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ম-কানুনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে বা বেশিরভাগে ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, প্রতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নিই অথবা আংশিক প্রতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।

সোজা কথায়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক ঘোষিত নিয়ম-কানুন যদি নাগরিকরা যথাযথভাবে অনুসরণ ও পালন করে তাহলে বুঝতে হবে 'প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ' হয়েছে বা হচ্ছে। আর ঘোষিত নিয়ম-কানুনগুলো যদি মানুষ পালন বা অনুসরণ না করেন তাহলে বুঝতে হবে 'প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ' হচ্ছে না। নিয়ম-কানুন পালন করাটা যেমন মানুষের 'অভ্যাসের' একটি অংশ, তেমনি এগুলো পালন না করাটাও 'অভ্যাসের' একটা অংশ। তবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব প্রকারান্তরে নাগরিক জীবনে রাষ্ট্রের গুরুত্বের স্বীকৃতি তথা প্রাধান্যের বহির্প্রকাশ। আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঘোষিত নিয়ম-কানুন পালন বা অনুসরণ করার তাগিদ আজ সর্বত্র। করোনাভাইরাস তা আরও প্রকটভাবে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে নাগরিকরা যাতে সরকারের নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঘোষিত নিয়ম-কানুন মেনে চলেন তার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, আইইডিসিআর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এজন্য প্রচারপত্র বিলি করছেন। সেদিন একজন আমাকে টেলিফোনে রসিকতা করে বলছিলেন, যে জনগোষ্ঠী নিজের পা পর্যন্ত ধুতে অভ্যস্ত নয়, তাদের এখন বলা হচ্ছে বারবার হাত এবং প্রয়োজনে পা ধুতে। জাপানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ব্যাপক না হওয়ার কারণ হিসেবে অন্যান্য কিছুর পাশাপাশি তাদের মাস্ক পরার অভ্যাসের কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণকে বারবার সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার করা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, অকারণে জনসমাগম এড়িয়ে চলা, জনসমাগম স্থলে গেলেও একজন থেকে আর একজন ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করা প্রভৃতি নিয়ম-কানুন অবশ্য পালনীয় হিসেবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি টানা বন্ধের কারণে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ যাতে খেতে পারে তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে। খাদ্য সহায়তা থেকে কোনো নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষ যাতে বাদ না যায় তার জন্য আলাদাভাবে প্রচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে এই মর্মে এসএমএস দেয়া হচ্ছে, 'প্রকৃত দুস্থ কেউ সরকারি সাহায্য না পেলে তার/তাদের নাম, ঠিকানা ও পরিবারের সদস্য সংখ্যা উলেস্নখ করে স্থানীয় ইউএনও/পুলিশ সুপার/পুলিশ কমিশনার/জেলা প্রশাসক/মেয়রকে অবহিত করার উদ্যোগ নিন। সম্ভব হলে নিজেরাও সংঘবদ্ধ হয়ে সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করুন। বার্তাটি তৃণমূলে ছড়িয়ে দিন।'

পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকু্যইপমেন্টের (পিপিই) কথা আমরা আমজনতা মাত্র কিছুদিন আগেও জানতাম না। আর এখন সচেতন মানুষ মাত্রই পিপিই সম্পর্কে জেনে গিয়েছে। পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকু্যইপমেন্ট (পিপিই) সরবরাহ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিদ্যমান হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং হচ্ছে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারি উদ্যোগে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। খেলোয়াড়দের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে অনুদান দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ডকে বেগবান করতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করছেন। খেলোয়াড়রা তাদের ব্যবহৃত স্টেডিয়াম হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলেছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গবেষকরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। এসবই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব ও প্রাধান্যের স্বীকৃতি।

জনপ্রিয় লোকসংগীতশিল্পী কুদ্দুছ বয়াতিকে দিয়ে বলা হচ্ছে 'মাইনা চলেন মাইনা চলেন মাইনা চলেন রে'...! অনেকে কবিতা লিখেছে! এরকমই একটি কবিতায়, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঘোষিত ঘরে থাকার সমর্থনে বলা হচ্ছে। ভিন দেশি এক বাঙালি কবি বলছেন, দেশ ডেকেছে আজকে তোমায় ঋণ চুকাও, বাইরে বিপদ সব নাগরিক ভেতর যাও।/বাঘ বেরোলে নিশিথ রাতে যেমন মানা, এই কটা দিন তেমন ভেবেই বেরিয়ো না।/ রাস্তা থেকে সব জমায়েত দূর হটাও, দেশকে যদি ভালোবাস ভেতর যাও।/তত্ত্ব কথার বকম বকম অনেক হলো, দোহাই এবার বাস্তবে কী চোখটা খোলো।/ভাবছো যদি থাকলে ঘরে চলবে কী আর, মরলে তুমি বিশ্ব ঠিকই চলবে ডিয়ার!/ঘরের বাকি লোকদেরও কী সেই দশা চাও, আগে বাঁচো পরে কাজ ভেতর যাও।/... নিজে কেন নিজের আয়ু কাটাও, আর ক'বছর থাকতে বেঁচে ভেতর যাও।/বাইরে ঘোরে মহামারি ওষুধ বিহীন, দোহাই তোমার ঘরে থাক এই কটা দিন।/ লাশের পরে লাশ হয়েছে কত দেশে, কেউ জানে না সংখ্যা কোথায় দাঁড়ায় শেষে। (সংগৃহীত। লেখক : আর্যতীর্থ)

এভাবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঘোষিত নিয়ম-কানুন মেনে চলার আহ্বান, কিংবা ঘরের ভেতরে থাকার আহ্বান, কিংবা হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দেয়া, খাদ্য সহায়তা থেকে কোনো দুস্থ পরিবার যাতে বাদ না যায় তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এসবই প্রকারান্তরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব ও প্রাধান্যের সার্বজনীন স্বীকৃতি। এভাবে সচরাচর আমরা বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুনের প্রতি উদাসীন বা অগ্রাহ্য করতে অভ্যস্ত সে সবের ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঘোষিত নিয়ম-কানুন মেনে চলা তথা প্রতিপালিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার এই মহাযজ্ঞ আগে কখনো দেখা যায়নি। সাংগঠনিক ও শৈল্পিক আহ্বানের পাশাপাশি প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের ব্যাপারটিও লক্ষণীয়। এ জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এমনকি দেশের সশস্ত্র বাহিনীও নিয়োজিত হয়েছে।

অতএব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন পালনের গুরুত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রাধান্য বিষয় দুটি একে অন্যের পরিপূরক ও সহগামী। যেমন- আমি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সার্ভিস আশা করছি কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো যে সব নিয়ম-কানুন ঘোষণা করছে সেগুলো মানছি না! তা হলে কিন্তু হচ্ছে না। পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সর্বাত্মকবাদী কমিউনিস্ট চীন এবং নির্দিষ্ট আদর্শ দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। আমেরিকা এবং চীন উভয় দেশেই নাগরিকরা রাষ্ট্রের তথা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আদেশ-নির্দেশ মেনে চলতে অভ্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বলা যাবে না, রাষ্ট্রের তথা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আদেশ-নির্দেশ নাগরিকরা মেনে চলে! এখানে অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ কম-বেশি নিজের প্রয়োজনকেই প্রাধান্য দিতে অভ্যস্ত। নিজের প্রয়োজনেই তারা সুবিধামতো সময়ে রাষ্ট্রের আইন অনুসরণের ভান করতে অভ্যস্ত। বিশেষত শক্তিশালী ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের আইন-কানুন বা প্রতিষ্ঠান কতৃ্যক ঘোষিত নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। উদাহরণ প্রচুর। তবে ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে দু-একটির কথা বলা যেতে পারে। যেমন- দেখা গিয়েছে নিয়োগ বিজ্ঞাপনে দেয়া হয়েছে কিছু শর্ত; কিন্তু শক্তিশালী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে অযোগ্য একজনকে নিয়োগ দিতে হবে। তা হলে, কি করতে হবে? সেখানে দেখা গিয়েছে প্রতিষ্ঠান প্রধান ঘোষিত নিয়ম-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার নিজস্ব যে এখতিয়ার আছে সেটি প্রয়োগ করেছেন সংশ্লিষ্ট অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ার জন্য। আর ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করে রাস্তা পারাপার হওয়ার ব্যাপারটি তো খুবই সুবিদিত। পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার আইন জারি করেছে কিন্তু তা কোথাও পালিত হচ্ছে না। বিল্ডিং কোড ভঙ্গ করে বাড়ি নির্মাণ করা একটি জনপ্রিয় প্রথা। সরকারি জায়গা দখল করে শপিং মল তৈরি করা, দুর্বল ব্যক্তির সম্পত্তি শক্তিশালী ব্যক্তি কর্তৃক দখল করা এগুলো বাংলাদেশের এমন এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যা প্রকাশ্যে বা ছদ্মবেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করা ব্যক্তিরা করে থাকেন। তারা মুখে আদর্শের কথা বললেও বাস্তবে নিজেদের প্রয়োজনটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আদর্শ অনুযায়ী দু'একটি লোক দেখানো কাজ তারা করে থাকেন বটে। যেমন- জিন্নাহ্‌ ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' প্রমাণের জন্য যোগেন মন্ডলকে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অথচ ৭০ বছর পর সেই পাকিস্তানই এখন করোনা সংক্রমণের সময় ঘোষণা দিয়ে অমুসলিমদের সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত করছে। এসবই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে গৌণ করার প্রচেষ্টার উদাহরণ।

করোনাভাইরাসের মহামারির সংক্রমণ যখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তখনও এ দেশের মানুষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঘোষিত নিয়ম-কানুনগুলো স্বেচ্ছায় মানছে না। তারা তখনই নিয়ম-কানুনগুলো মানছে যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে। আবার সেখানেও মাত্রাতিরিক্ততার প্রশ্ন উঠছে! কিন্তু এত সবকিছুর পরেও মানুষ যখন কোভিড বা অন্য যে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে অসহায় হয়ে পড়ে তখন কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দিকেই তাকাতে হচ্ছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সরকারি হাসপাতাল, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সেনাবাহিনী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানই অসহায় জনগণের একমাত্র ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি, এসব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার জন্য স্থানীয় তথা মাইক্রোপর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্র ও শাখাগুলো, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো (সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ) স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্থাসমূহ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এগিয়ে আসছে। এসবই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতার অর্থাৎ একটি জনকল্যাণকামী শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার বহিপ্রকাশ।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সম্পর্কিত বিভিন্ন নির্দেশনা এবং বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য দৈনন্দিন ব্রিফিংয়ের দিকে দেশের মানুষ চেয়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতাদের করোনাভাইরাস সম্পর্কিত বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের বড় ধরনের ভূমিকার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

\হএছাড়া করোনাভাইরাসজনিত বন্ধের ফলে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, সড়ক, নৌ ও বিমান পরিবহন সেক্টর, গার্মেন্ট, বড় বড় বিপণি বিতান প্রভৃতি যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যও সরকারের প্রতি পক্ষ-বিপক্ষের সবাই তাকিয়ে আছে।

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: 'ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ' গ্রন্থের প্রণেতা এবং পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<95703 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1