বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চাল আত্মসাৎ ও গরিবের বেঁচে থাকা

দিন যতই গড়াচ্ছে, ঘরে থাকার পরিবর্তে পথে নামতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ। বিশেষ করে কয়েকদিন ধরেই অসহায় মানুষের পথে পথে ঘুরতে দেখা যায়। ঘরে খাবার না থাকা, ঠিকমতো ত্রাণ না পাওয়া এবং কাজ না থাকায় উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়েই পথে নামতে হচ্ছে তাদের। মাদারীপুর ও বরিশালে ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে অসহায় কর্মহীন দিনমজুর নারী-পুরুষ। এ ছাড়াও গোপালগঞ্জ, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও ও রংপুরে গত সোমবার লকডাউন ভেঙে ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে হতদরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে দেশের একাধিক জায়গায় ত্রাণের ট্রাক লুট করেছে অনাহারী মানুষ। এই চিত্র কোনোভাবেই সুখকর নয়। এ সংকটের সময়ে ত্রাণের সুষ্ঠু এবং সমন্বিত বণ্টন জরুরি।
সালাম সালেহ উদদীন
  ২২ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশ এক সময় দুর্নীতির জন্য পর পর পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দুর্নীতির সেই কলঙ্কতিলক মোচন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি এটা যেমন সত্য, একইভাবে সত্য যে, আমরা সমাজ-রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে পারিনি। করোনাকালে গরিবের চাল আত্মসাৎ তার বড় প্রমাণ। আর এটা করছেন দেশের জনপ্রতিনিধিরা, যাদের জনগণ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে।

এখন বৈরি সময়, দুর্যোগকাল। বিশ্বব্যাপী মহাআতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস। পৃথিবীব্যাপী এক মহাবিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে এই ভাইরাস। দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হলেও গত ১০ দিনে এই অঞ্চলের অবস্থা ভালো নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থা খারাপের দিকে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এই তিন দেশে মৃতু্যর হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃতু্যর হার দ্রম্নত বাড়ছে, যার ফলে মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৩৮২ জন এবং মৃতু্য হয়েছে ১১০ জনের। সারাদেশে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে অন্তত ২০০ জন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মারা গেছে কমপক্ষে ২৫০ বাঙালি। এই সংখ্যা দ্রম্নত বাড়ার সম্ভাবনা তীব্র। ফলে মানুষের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। কে মরে কে বেঁচে থাকে এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এই ক্রান্তিকালেও দুর্নীতিবাজ চাল চোররা সক্রিয়। তারা গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত চাল চুরি করছে। করোনাকালে এর চেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা আর কী হতে পারে।

এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২৪ জনপ্রতিনিধিকে ত্রাণ আত্মসাতের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ত্রাণ বিতরণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অফিস আদেশও জারি করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হলো ত্রাণের সুষ্ঠু বণ্টন হয়নি। ত্রাণের চাল আত্মসাৎ করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি ও তাদের নিয়োগকৃত ডিলারদের কাছ থেকে হাজার হাজার বস্তা চাল এবং শত শত বোতল ভোজ্যতেল উদ্ধার করা হয়েছে। এটা আমাদের জাতীয় লজ্জা ও ব্যর্থতা। কারণ আমরা চোর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারিনি। তাদের কারণে দেশের গরিব অসহায় মানুষ যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, দেশেরও আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশকে বলা হয় উন্নয়নের রোল মডেল, এশিয়ার বাঘ।

বাংলাদেশে প্রতিবছর দুর্নীতির মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ আয়-রোজগার করা হয়, সেটার আসলে সঠিক কোনো তথ্য-উপাত্ত কারও কাছেই নেই। তবে দুর্নীতি নিয়ে যেসব সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কাজ করে, তাদের ধারণা এর সংখ্যা লাখো কোটি টাকার কম নয়। বাংলাদেশে দুর্নীতিকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়- একটি হচ্ছে সেবা খাতের দুর্নীতি আর একটি ঘুষ হিসেবে যেটি বর্ণনা করা যায়। এর ফলে যারা সেবা নিচ্ছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আর কর্মকর্তারা ঘুষ নিয়ে অর্থ সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন। এরকম দুর্নীতির তথ্য বিশ্বের কোনো দেশেই আর নেই। আরেকটি দুর্নীতি হলো রুই-কাতলা দুর্নীতি বা বড় ধরনের দুর্নীতি, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কেনাকাটা থেকে শুরু করে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, বাজেট বাস্তবায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়। সেখানে অনেক পক্ষ থাকে, যার মধ্যে রাজনৈতিক নেতারা, সরকারি আমলা, ব্যবসায়ীরাও জড়িত থাকে। আর এবার দুর্নীতির মাধ্যমে চুরি করা হলো গরিবের ত্রাণের চাল ও তেল। চুরি দুর্নীতি বাংলাদেশে আগেও ছিল এখনো আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কত টাকা প্রয়োজন। দেশের সবাই যদি অবৈধভাবে কোটিপতি হতে চায় তা হলে এটা একটা বিপজ্জনক বার্তা।

তবে ত্রাণ নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, আমাদের তালিকা নেওয়া হলেও আমরা কোনো ত্রাণ পাইনি। কমিশনারের লোকজন এসে আমাদের নামের তালিকা ও ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নিয়ে গেছেন। জানি না, আমরা কবে পাব ত্রাণ। এ ছাড়া কেউ আমাদের কোনো সহযোগিতা করছেন না কীভাবে বাঁচব জানি না। যারা গ্রামের ভোটার বসবাস করছে ঢাকায়, তাদের ত্রাণ দেয়া হচ্ছে না। এই অভিযোগ যদি সত্য হয়ে থাকে তবে দ্রম্নত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই ক্রান্তিকালে সবাই দেশের জনগণ এটাই চরম সত্য, কে কোথাকার ভোটার এটা দেখে ত্রাণ দিলে কীভাবে দেশের গরিব কর্মহীন মানুষ বাঁচবে?

এটা সত্য, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এ সময়ের মধ্যে জনগণকে ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে জীবনের তাগিদে রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় ত্রাণের অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে অসহায় মানুষকে। করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে ছুটির কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষ। বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের আয়ের পথ। এ অবস্থায় কর্মহীন অসহায় দরিদ্র মানুষ জীবনের তাগিদে বাধ্য হয়েই ত্রাণের আশায় সড়কে বের হবে এটাই স্বাভাবিক। দৈনিক রোজগার করতে না পেরে থমকে গেছে তাদের জীবনযাত্রা। কর্মহীন এসব মানুষ পেটের টানে সংক্রমণের ঝুঁকি সত্ত্বেও ত্রাণের খোঁজে ছুটছে পথে পথে। ত্রাণের চেয়ে মানুষের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। কেউ যদি ত্রাণ দিতে আসেন জমায়েতের কারণে ত্রাণ দিতেও পারছেন না। সারাদিন অপেক্ষা করেও দিন শেষে ত্রাণ না পেয়ে শূন্য হাতে অনেকে ফিরছেন বাড়ি। দিন যত গড়াচ্ছে, দুর্ভোগ আরও বেশি হচ্ছে অসহায় মানুষের। ফুটপাতে এখন সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক গুণ বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি সড়কেই একটু সাহায্যের আশায় বসে বসে ক্ষণ গুণছেন অসহায় এসব মানুষ; শুধু তাই নয়, গভীর রাত পর্যন্তও ত্রাণের জন্য রাস্তার দুই পাশে অপেক্ষা করতে দেখা যায় অনেক মানুষকে। তাদের চাহিদা বেশি নয় কোনোমতে দু'মুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই হয়। সমাজের অসহায় মানুষগুলোর পাশে বিত্তবানরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন এমনটা প্রত্যাশা করা অসঙ্গত নয়।

দরিদ্রদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের তালিকা প্রণয়নে দলীয়করণের অভিযোগ তোলা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এসব মানুষের মধ্যে ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করতে সরকার সারাদেশে যেসব চাল বরাদ্দ করেছে ইতোমধ্যে এসব চাল বিতরণের জন্য তৈরি করা তালিকা নিয়ে দলীয়করণের অভিযোগ উঠেছে বিএনপির পক্ষ থেকে। ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ গরিবের ত্রাণ মেরে খাওয়া বড় অপরাধ।

দিন যতই গড়াচ্ছে, ঘরে থাকার পরিবর্তে পথে নামতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ। বিশেষ করে কয়েকদিন ধরেই অসহায় মানুষের পথে পথে ঘুরতে দেখা যায়। ঘরে খাবার না থাকা, ঠিকমতো ত্রাণ না পাওয়া এবং কাজ না থাকায় উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়েই পথে নামতে হচ্ছে তাদের। মাদারীপুর ও বরিশালে ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে অসহায় কর্মহীন দিনমজুর নারী-পুরুষ। এ ছাড়াও গোপালগঞ্জ, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও ও রংপুরে গত সোমবার লকডাউন ভেঙে ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে হতদরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে দেশের একাধিক জায়গায় ত্রাণের ট্রাক লুট করেছে অনাহারী মানুষ। এই চিত্র কোনোভাবেই সুখকর নয়। এ সংকটের সময়ে ত্রাণের সুষ্ঠু এবং সমন্বিত বণ্টন জরুরি।

স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এলাকাভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। খেটে খাওয়া অভাবী মানুষ এলাকায় যারা রয়েছেন, পর্যায়ক্রমে সবাইকেই সাহায্য দেওয়া দরকার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি আমি পেয়েছি চোরের খনি। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতাব্দীতে কম্বল চোর, ত্রাণের টিন চোর, চাল-গম-তেল চোররা সক্রিয়। এদের মধ্যে মানবিকতা নেই। লোভ ও নিষ্ঠুরতাই এদের মধ্যে সবসময় কাজ করে। এরা আবার জনপ্রতিনিধি ভাবতেও অবাক লাগে। যারা গরিবের ত্রাণ আত্মসাৎ করে তারা কীভাবে জনসেবা করবে? তারা কীভাবে জনদরদী হয় এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

এই দুর্যোগকালে ত্রাণের সুষ্ঠু বণ্টন হওয়া জরুরি। এটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। ত্রাণ বিতরণের বিষয়টি সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেয়ার যে দাবি উঠেছে, সে বিষয়টিও সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে নিকট ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে। দুর্যোগকালে কর্মহীন গরিব মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অবশ্য কর্তব্য।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<96939 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1