শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া

যে কোনো দেশের অর্থনীতির মূল সম্পদ হলো জনশক্তি। তাই মানুষকে বাঁচাতে না পারলে এ দেশের অর্থনীতিও টিকে থাকতে পারবে না। মানুষের জন্য অর্থ সুতরাং অর্থের জন্য মানুষকে প্রাণঘাতী করোনার প্রাদুর্ভাবে ঠেলে দেয়া যাবে না। মানুষ রক্ষাই হোক এখন মূল স্স্নোগান আর তার জন্য যা করণীয় সব কিছু করা দরকার রাষ্ট্রের।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ২২ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

ইউরোপ মহাদেশে করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছে। স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি এই তিনটি দেশেই প্রায় লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। করোনার মৃতু্যর মিছিলে লাগাম টানতে পারেনি বিশ্বের এই মহাদেশটি। শিক্ষা ও চিকিৎসা সব কিছুতেই তারা বিশ্বের যে কোনো দেশের চাইতে অগ্রগামী, তারপর করোনাভাইরাসটি প্রতিরোধে এই মহাদেশের দেশগুলো অসহায়। ২০ ফেব্রম্নয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ল্যা লিগে ফুটবল কাপ ফাইনাল। এই খেলাটি উপভোগ করতে সেদিন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে উপস্থিত হয়েছিল প্রায় ৪৫ হাজার দর্শক। ওই সময়টায় পৃথিবীতে করোনার মহামারি আকারে ছড়িয়ে ছিল শুধু এশিয়ার চীনে- তবে ইউরোপের দেশগুলোতে একটু একটু করে এই ভাইরাসটি ঢুকছে। ইউরোপে করোনার অঙ্কুরোদগমের সময় এ ধরনের ফুটবলে বড় আসরের আয়োজন করায় ভাইরাসটি ইউরোপে আজ মহিরুহের রূপ নিয়েছে। এ ধরনের আসরের আয়োজন করাটা যে ভুল ছিল তা আজ ইউরোপের বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কারণ এই জমকালো ফুটবল আসরটির মধ্য দিয়েই ইউরোপে নিজস্ব ঘাঁটিটি পাকাপোক্ত করে নিয়েছে করোনাভাইরাস। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে পরিচিত। যার অর্থ ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। এতে করে বুঝায় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা অবস্থান তৃতীয় সারিতে। তাই করোনা সংক্রমণে ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশকে বেশি সর্তক হতে হবে। করোনার প্রতিষেধক নেই, তাই প্রতিরোধই উত্তম পন্থা। বাংলাদেশ সরকার করোনা প্রতিরোধে কঠোর অবস্থা অবলম্বন করেছেন। জেলায় জেলায় লকডাউন, রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান। দেশের অনেক জায়গায় মাস্ক না পরার দায়ে, শারীরিক দূরত্ব না মেনে চলাফেরা করা এবং অহেতুক ঘর থেকে বের হওয়া- এ ধরনের অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত জেল জরিমানা পর্যন্ত করেছেন। তারপরও যখন শারীরিক দূরত্ব মানাসহ অকারণে ঘর থেকে বের হওয়া রোধ করা যাচ্ছে না- সেই সময় ঘটে গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক পীরের জানাজায় বিশাল জনসমাগম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের এই পীরের জানাজায়। ইলেক্ট্রনিকস গণমাধ্যমে এই জানাজার দৃশ্যটি দেখে মনে হলো, করোনা প্রতিরোধে আমরা যা কিছু করছি তা অনেকটা বজ্র আঁটুনি ফসকা গিরার মতো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলাটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। বর্তমানে এই মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। তাই সারাদেশ থেকে এখানে আসাটা সহজ। প্রশ্ন হলো, বাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে জেলা প্রশাসন লকডাউন ঘোষণা করেছেন। ১৮-৪-২০২০ তারিখ পর্যন্ত এই জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুজনের প্রাণহানি ঘটেছে আর আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় বিশের কাছাকাছি। এ রকম মারাত্মক অবস্থায় যারা লকডাউন বহাল রাখার দায়িত্ব পালন করছিলেন। তারা কি ধরনের দায়িত্ব পালন করলেন? কেন তাদের দায়িত্ব পালনে এরকম ঘটনাটি ঘটলো, তার একটি ব্যাখ্যা আসা উচিত। সরাইলের একটি মাদ্রাসার হুজুর বলেছেন, তারা কোনো মানুষকে জানাজায় অংশগ্রহণ করার জন্য ডাক দেননি, তবে ফেস বুকের মাধ্যমে খবরটি প্রচারিত হয়ে যাওয়ার ফলে মানুষ নিজ আবেগের টানে পীরের প্রতি নিজের ভালোবালবাসায় জানাজায় অংশ নিয়েছে। মৃত পীর সাহেবের প্রতি তার ভক্তদের ভালোবাসা অগাধ এবং অকৃত্রিম টানটি তিনি বুঝাতে চেয়েছেন। ভালোবাসার টান ছিল বলেই ভক্তরা মৃতু্য ভয়কে উপেক্ষা করে পীরের জানাজায় অংশ নেয়। সরাইল উপজেলায় লকডাউন বহাল রাখার দায়িত্বে নিয়োজত সরকারি কর্মী বাহিনীরও যদি সেই সময় এরূপ ভালোবাসার টানের উদ্রেক হয়ে থাকে তাহলে তো বলার কিছুই নেই। ভালোবাসার জন্য মানুষ সব ত্যাগ করতে পারে আর লকডাউনের জন্য দায়িত্ব উপেক্ষা করাটা তো তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু এ ধরনের ভালোবাসার টান যাদের তারা তো নিশ্চয়ই জানেন করোনা শুধু একজনকে আক্রমণ করবে না, সে আক্রান্তদের পরিবার ও সমাজকে গ্রাস করবে। তাই স্ব স্ব ভালোবাসার টান এই করোনা মহামারিকালে দেখানোর কোনো অবকাশ নেই। কারণ, করোনা একটি সামষ্টিক বিষয়। যা প্রতিরোধে প্রতিটি ব্যক্তি সজাগ হলে সমাজ রক্ষা পাবে, তাই এখানে আবেগের স্থান দেয়াটা কতটা ঠিক হয়েছে তা ইসলামিক চিন্তাবিদরা একটু ভেবে দেখবেন। প্রশাসনেও যদি এ ধরনের আবেগী কর্মী থাকেন তাদের দিয়ে লকডাউন বহাল রাখাটি যে অসম্ভব তারই প্রমাণ হয়ে গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে। বাহ্মণবাড়িয়ার জেলা পুলিশের নেতৃত্বে সরাইলের আটটি গ্রাম ১৮ তারিখ বিকাল থেকে ঘিরে রাখা হয়েছে। এমন নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যে, এই আট গ্রাম থেকে কোন লোক যেন বের হতে না পারে। জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে সকালে আর বিকালে পুলিশ লকডাউন করে আটটি গ্রাম। জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর কোনো মানুষ কি জানাজার স্থলে অবস্থান করে? এখন যদি বলেন, ওই আট গ্রামের মানুষের জন্য এই ব্যবস্থা তাও সঠিক হবে না, কারণ লক্ষাধিক মানুষের জমায়েতটি যখন মিডিয়ায় সংবাদ হিসেবে প্রচারিত হয়ে গেছে তখন ওই আট গ্রামের মানুষও ( যারা জানাজায় অংশ নিয়েছে) সরে পড়েছে। চোর পালিয়ে গেলে বুদ্ধি বাড়লে লাভ কি? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পর অনেকেই বলছেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন ঘটে যাওয়া বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে লাভ কি? কথা সত্য, লাভ নেই, পর পর এরূপ ঘটনা ঘটবে আর আমরা বলব যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, এখন কিভাবে এর প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে চলুন না ভাবি? এরকম ভাবতে ভাবতে আমাদের হয়তো ভাববার সময় টুকু শেষবধি থাকবে না। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ৪০তম দিনে যে আক্রান্ত এবং মৃতু্যর হার ছিল তার তুলনায় বাংলাদেশের হার অনেক বেশি। তাই এ ধরনের ঘটনাগুলো বেশি করে ভাবায়।

এ দেশে অনেক কিছুর প্রচলন ঘটেছে বিদেশ থেকে- যা বাংলা সংস্কৃতির পরিপন্থি তাই কেন ঘটেছে এ ধরনের প্রচলন তা নিয়ে প্রশ্ন করলে তখন কিছু মানুষ উত্তর দেন, এটা গেস্নস্নাবালাইজেশনের যুগ, সুতরাং বিদেশ থেকে এ দেশকে কিছু শিখতে হবে। তাই প্রশ্ন হলো বিদেশ থেকে কি শিখলো বাংলাদেশ। চীন এশিয়ার একটি দেশ, যা বাংলাদেশের নিকটতম, সেখানে যখন করোনার মহামারি আকারে প্রার্দুভাব ঘটেছিল, তা থেকে প্রতিকারটা সেই সময় বাংলাদেশ কি শিখেছিল এটা জানতে ইচ্ছা করে। ইউরোপে ২০ জানুয়ারির ফুটবল আসরটি যে ইউরোপের করোনার মহামারির প্রদুর্ভাবের জন্য দায়ী এটাও তো বিশ্বের গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। গেস্নাবালাইজেশনের নামে বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা কতটা মানুষের জন্য উপকারী তা ভাববার সময় এসেছে। চীনের মহামারির সময় সারাদেশ নিশ্চুপ ছিল, কোনো কার্যকরি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি ওই সময়। বৃহৎ পরিসরের গণসমাবেশের মাধ্যমে যে করোনা মহামারি আকারে ছড়ায় তা বিশ্বের অন্য দেশ থেকেও বাংলাদেশের শিখা হয়নি। যদি হতো, লক্ষ্ণীপুরে আওয়ামী লীগ নেতার আত্মীয়ের জানাজা, সরাইলে পীরের জনাজায় এত বড় জনসমাগম ঘটতো না। এই জানাজার সমাবেশের পর ভাবতে হবে, এর কুফলটা কীভাবে রোধ করা যায়। কারণ জানাজায় যারা অংশ নিয়েছেন সবাই কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিবাসী নন। তাই বিষয়টি ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। এর প্রতিকারে জেলায় জেলায় লকডাইন ব্যবস্থাটায় আরো কঠোর হতে হবে। প্রতিটি জেলায় লকডাউনের মেয়াদও বাড়াতে হবে। সারাদেশে সরকার ঘোষিত ছুটি আরো বাড়ানো দরকার। শারিরিক দূরত্ব বজায় না রাখলে বড় অংকের জরিমানা ধার্য করার ব্যবস্থাটি কার্যকর করতে হবে। যেহেতু গার্মেন্টস শ্রমিক, সরাইলে ঘটনার ফলে করোনা প্রতিকার ব্যবস্থাটি আবার প্রাথমিক পর্যায়ে চলে এসেছে, সুতরাং আবার নতুন করেই কার্যক্রম শুরু করতে হবে এই ভাইরাসটি প্রতিরোধে। ছুটি বাড়ানোর ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই কথা ভেবে ছুটি বাড়ানোর বিষয়টি থেকে সরে আসাটা ঠিক হবে না। আর ছুটি বাড়িয়ে লকডাউন এবং স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

যে কোনো দেশের অর্থনীতির মূল সম্পদ হলো জনশক্তি। তাই মানুষকে বাঁচাতে না পারলে এ দেশের অর্থনীতিও টিকে থাকতে পারবে না। মানুষের জন্য অর্থ সুতরাং অর্থের জন্য মানুষকে প্রাণঘাতী করোনার প্রাদুর্ভাবে ঠেলে দেয়া যাবে না। মানুষ রক্ষাই হোক এখন মূল স্স্নোগান আর তার জন্য যা করণীয় সব কিছু করা দরকার রাষ্ট্রের।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<96941 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1