বিশ্ব করোনা পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে যারা রাজনীতি করতে চায়, জল ঘোলা করে মাছ শিকার করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একদল মানুষ মহামারির অনুষঙ্গ হিসেবে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনাতে চাইছে। সেই চুয়াত্তর স্টাইলে বাসন্তী নাটকের মহড়া করতে চাইছে। এরা দেশের শত্রম্ন। বুঝতে হবে এই পরিস্থিতি কারুর একার সৃষ্ট নয়। এককভাবে কেউ দায়ীও নয়। মনে রাখতে হবে আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, চীনের মতো দেশও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

ড. রাশিদ আসকারী
বর্তমান বিশ্বের এক নম্বরের সমস্যা কী জানতে চাইলে মনে হয় একজনও হয়তো বলবে না যে করোনা সংক্রমণ ছাড়া অন্য কিছু। হঁ্যা উত্তর একটাই। করোনাভাইরাস ডিজিস-২০১৯, যার অ্যাক্রোমিন হলো ঈঙঠওউ-১৯ এ ঈঙ হলো করোনা, ঠও ভাইরাস এবং উ হলো ডিজিস। আর ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯-এ প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় বিধায় ১৯ সংখ্যাটি জুড়ে বসেছে ঈঙঠওউ-এর সঙ্গে। চীনের উহান প্রদেশে যাত্রারম্ভ করে এরই মধ্যে বিশ্ব ভ্রমণ শেষ করে ফেলেছে এই ভাইরাস। তান্ডব চালিয়েছে ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনের মতো দেশে; চলচ্ছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। \হএখন করোনা মানে এক মূর্তিমান বিভীষিকা। এর হাত থেকে নিস্তার মিলছে না রাজা-প্রজা, বাদশা-ফকির, ধনী-দরিদ্র কারুরই। মৃত এবং আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সর্বশেষ তথ্যমতে মৃতের সংখ্যা এক লাখ ৭৭ হাজার এবং আক্রান্ত পৃথিবীর দেশ এবং ভূখন্ড মিলে ২০১টি জনপদে প্রায় ২৬ লাখ। মহামারি পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম নয়। মধ্যযুগের শেষপাদে (১৩৪৬-১৩৫৩) বিউবোনিক পেস্নগের দ্বারা সংক্রমিত 'বস্নাক ডেথ' দীর্ঘ সাত বছর ধরে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়াকে লন্ডভন্ড করে ফেলেছিল। সর্বনিম্ন ৭৫ মিলিয়ন এবং সর্বোচ্চ ২০০ মিলিয়ন মানুষ সেই ভয়াল 'কৃষ্ণমৃতু্যর' শিকার হয়েছিল বলে জানা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মারণব্যাধি এইডসও বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ৩৬ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। এ ছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জা কেন্দ্রিক মহামারি যেমন ১৮৮৯ সালের 'রাশিয়ান ফ্লু', ১৯৫৬ সালের 'এশিয়ান ফ্লু' কিংবা ১৯৬৮ সালের 'হংকং ফ্লু'ও কম বিপজ্জনক ছিল না। অধিকন্তু নিপা ভাইরাস, সোয়াইন ফ্লু, ডেঙ্গু কিংবা চিকনগুনিয়াকেও খাটো করে দেখবার অবকাশ নেই। কিন্তু সব কিছুকেই যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাস এবং তজ্জনিত বিরাজমান আতঙ্ক। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অন্তহীন অনিশ্চয়তার হাত থেকে রেহাই পেতে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন জার্মান অর্থমন্ত্রী টমাস শেফার। ভয়াল করোনাকবলিত ইতালিকে রক্ষার সব পার্থিব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে আকাশের পানে হাত তোলেন এবং স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ কামনা করেন দেশটির অসহায় প্রধানমন্ত্রী জুসেপে কোনতে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা পৃথিবীর জন্য জরুরি অবস্থা জারি করে। লকডাউন হয়ে পড়েছে সমগ্র মানবজাতি। করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনমনে ভীতির প্রধান কারণ সম্ভবত এর অতি দ্রম্নত সংক্রমণ ক্ষমতা এবং এই সংক্রমণ হাঁচি-কাশির মধ্য দিয়ে তো বটেই, এমনকি কথা বলার মাধ্যমেও আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে সংক্রমণ হতে পারে। আতঙ্কের দ্বিতীয় কারণ হলো- কোভিড-১৯ এর কোনো প্রতিশেধক আবিষ্কৃৃত হয়নি। বাজারে ওষুধের বন্দোবস্ত থাকলে রোগীর মনোবল এমনিতেই চাঙ্গা থাকে। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব এতটাই আকস্মিক যে, প্রতিরোধ এবং প্রতিশেধকবিহীন মানুষের ওপর এই প্রাণঘাতী অণুবীক্ষণিক শত্রম্ন যথেষ্ট দাপট খাটাচ্ছে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি শিশু এবং যুবাদের ওপর করোনার প্রকোপ এতটা প্রবল নয় বলে যে আশ্বাসের বাণী ছড়ানো হয়েছিল - তাও সর্বৈব অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। গ্রীষ্ম প্রধান দেশগুলোর ক্ষেত্রে যে সুবিধার কথা বলা হয়েছিল- তাও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে থোড়াই কেয়ার না করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলোকে একের পর এক ধরাশায়ী করে ফেলেছে করোনাভাইরাস। বিশ্বের বড় বড় শহর একের পর এক লকডাউন করা হচ্ছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদ, কিংবা কলকাতা ও ঢাকাকেও ভরদুপুরে দেখলেও মৃতপুরি মনে হয়। মানুষ মাসের বাজার একবারে সেরে নিয়ে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে পড়েছে। এই কদিন আগে যে মানুষটি ঘড়ির উল্টোদিকে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল- তার আজ সময় কাটে না। দেহঘড়ি যেন ইউটার্ন নিয়েছে। ফেসবুকের ডান সাইড বারে সবুজ ফুটকি সারারাত সক্রিয় থাকে। ফলে মধ্যাহ্নে শয্যাত্যাগ। ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ যুক্ত হয়ে ব্রাঞ্চে পর্যবসিত হওয়া। মোটকথা করোনাকাল মানবজীবনকে একেবারে ওলটপালট করে দিয়েছে। ভীতি আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার জালে আবদ্ধ সময়ই করোনাকাল। \হকোভিড-১৯ যেহেতু কেবল মহামারিই নয়, বৈশ্বিক মহামারি (ঢ়ধহফবসরপ) তাই বাংলাদেশও এর আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ৮ মার্চ, ২০২০ এ দেশের রোগতত্ত্ব ইনস্টিটিউট ইতালিফেরত প্রথম এক জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সন্ধান পায়। মার্চের শেষ পর্যন্ত সংক্রমণের মাত্রা নিম্নপর্যায়ে থাকলেও এপ্রিল পড়লেই তা ঊর্ধ্বগামী হয়। মধ্য এপ্রিলের পর এই উলস্নম্ফনের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। তবে ১৬০ মিলিয়ন মানুষের এই দেশে যেখানে লকডাউন কিংবা সোশ্যাল ডিসট্যান্স পুরোমাত্রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। কিংবা যেখানে লক্ষণাক্রান্তের তুলনায় টেস্টিং কিটসের পরিমাণ একেবারেই অল্প, সেখানে আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা নিরুপণ একটু কষ্টকর। আর ঠিক সেখানেই সমস্যাটি জটিল হচ্ছে। করোনা মোকাবিলার প্রথম অনিবার্য শর্ত হলো আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতেই হবে। পরীক্ষা এড়ানো আক্রান্তেরা করোনাবাহক হিসেবে নির্বিঘ্নে করোনা সংক্রমণে বিস্ফোরণ ঘটাবে। যে বিস্ফোরণকে পরিভাষাগত ভাবে বলা হয় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। লক্ষণাক্রান্তদের যথাযথভাবে পরীক্ষা করে ফলাফলনুযায়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ না করতে পারলে পুরো করোনাবিরোধী অভিযান অর্থহীন হয়ে পড়বে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের সম্ভাবনার বিষয়টি সরকারও স্বীকার করে নিয়েছেন এবং ১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮ এর ১১(১) ধারা ক্ষমতা বলে সারা বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি সমস্যা সমাধানের প্রথম শর্ত। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার পথে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। সেগুলো উপলব্ধি করে অপসারণের ব্যবস্থা না করলে ইপ্সিত ফলাফল মিলবে না। বাঙালিরা অনেক বেশি সামাজিক, আড্ডাপ্রিয় এবং বহির্মুখী। চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে ঝড় তোলা একটি প্রিয় বাঙালি স্বভাব। তাই করোনা সংক্রমণ পরিহারের জন্য সঙ্গ নিরোধ ব্যবস্থা, আত্ম-অন্তরণ কিংবা গৃহ-অন্তরণ ব্যবস্থা খুব একটি কাজ করছেন না। কিন্তু এটিকে কাজ করাতেই হবে। সামাজিক মেলামেশা করোনা সংক্রমণের প্রধান হাতিয়ার। এ ব্যাপারে চার্চ এবং ক্যাসিনো উভয়ই ঐকমত্য পোষণ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী তা কার্যকর করছে। আর পরস্পর বিরোধ এই দুই প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাপারে যখন একই মত পোষণ করে, তখন বুঝতে হবে যে, ব্যাপারটি সত্যিই গুরুতর। প্রার্থনালয়ে লোকসমাগম নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে, ক্যাসিনো বন্ধ করা হয়েছে- তারপরও যদি মানুষ যূথবদ্ধ হতে চায় তাহলে কঠোর আইন প্রযোগের বিকল্প নেই। করোনা নিয়ন্ত্রণে আরেকটি বড় সংকট মনে হচ্ছে করোনাক্রান্তদের সেবাদানকারী চিকিৎসক/নার্সদের প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষা সামগ্রীর অভাব। খোদ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ওঊউঈজ)-এর ছয়জন স্টাফ আক্রান্ত হয়েছেন। সিলেটের ওসমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার মঈন উদ্দিন করোনাক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করেছেন। এ ছাড়াও আরো অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্য সেবাকর্মী নার্স করোনাক্রান্ত হয়েছেন এবং অনেকে ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানা যায়। কার্যকর চচঊ (পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকু্যইপমেন্ট)-এর অপর্যাপ্ততা অন্যতম কারণ বলে ধরে নেয়া যায়। স্বয়ং চিকিৎসক নার্স যদি সংক্রমণ এড়ানোর সুব্যবস্থা না পায় তাহলে তারা করোনাক্রান্তদের সেবা কীভাবে দেবে? তবে বাংলাদেশের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক ব্যাপার হলো প্রধানমন্ত্রী নিজেই অহর্নিশ করোনা পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন। ঢাকায় বসে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন, দলীয় নেতাকর্মী সবার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্তি হয়ে প্রত্যক্ষভাবে তথ্যাদি সংগ্রহ করছেন। অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি মানুষের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। অযথা ভীত বা আতঙ্কিত না হয়ে সাহস-সচেতনতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশনা দিচ্ছেন। নিহত ডাক্তারের পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন- আবার দায়িত্ববিমুখ পলায়নপর চিকিৎসকদের সতর্ক করতেও ভুলছেন না। তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো- এই বৈরী করোনাকালে স্বল্পআয়ের খেটে খাওয়া দিনমজুর কিংবা দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দুশ্চিন্তা। ঘরে ঘরে ত্রাণ পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন- আবার ত্রাণ তছরুপকারীদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। ১০ টাকা কেজি দরের চাল পাওয়া রেশন কার্ডের আওতাভুক্ত মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখ থেকে দ্বিগুণ করেছেন। তবে করোনা সংকটের কারণে বিশ্বে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসবে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে ধরে নেয়া যায়। বিশ্বব্যাপী লকডাউন ব্যবস্থার কারণে উৎপাদন কার্যক্রম থেমে যাবে এবং সাপস্নাই চেইন ব্যবস্থা মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির ওপরে বিরাট হুমকি আসবে। বিশ্ব বাণিজ্য পদ্ধতি ভেঙে পড়বে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন এজেন্সির হিসাব মতে, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ২ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার লোকসানের শিকার হবে এবং করোনাকবলিত প্রায় সব দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার কবলে পতিত হবে। ১৯৩০-এর মহা অর্থনৈতিক মন্দা (এৎবধঃ উবঢ়ৎবংংরড়হ) এরপর ২০০৭-২০০৮ সালে মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল- চাহিদার পতন। কিন্তু করোনাজনিত কারণে সৃষ্ট মন্দা ঘটবে চাহিদা এবং জোগান উভয়ের পতনের কারণে- যা অনেক বেশি বিধ্বংসী। লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যা লাখ লাখ- সেখানে লকডাউন দশা দীর্ঘায়িত হলে এবং তৈরি পোশাক শিল্পে উৎপাদন থমকে গিয়ে সাপস্নাই চেইন ভেঙে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এই স্থবিরতার প্রভাব পড়বে চাকরির বাজারেও। আইএলওর হিসাব মতো করোনা পরিস্থিতির কারণে আগামী তিন মাসে বিশ্বে সাড়ে উনিশ কোটি মানুষ চাকরিচু্যত হবে। এর মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সাড়ে বারো কোটি এবং এর অভিঘাত বাংলাদেশেও পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর একজন চাকরি হারানো মানে একটি পরিবার সংকটাপন্ন হওয়া। ইতোমধ্যে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি হারিয়েছেন ১৭ মিলিয়ন মানুষ। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম কমে যাওয়ায় সেখানেও চাকরিচু্যতি শুরু হয়েছে। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের চাকরিচু্যতির সম্ভাবনা রয়েছে এবং তাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। এই পরিস্থিতি হবে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতির সাময়িক এবং স্থায়ী উত্তোরণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। লকডাউনের কারণে কাজ হারানো দিনমজুর, রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক প্রভৃতি পেশার মানুষের জন্য ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তা ছাড়া তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমাজের বিত্তবান মানুষরাও এগিয়ে আসছে ত্রাণকার্যে যা হয়তো তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। করোনা পরিস্থিতির আর্থিক অভিঘাত থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ৭২,৭৫০ কোটি টাকার- যা দেশের জিডিপির প্রায় ২.৫২ শতাংশ, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থার উত্তরণে কেবল সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না। সব স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে যারা রাজনীতি করতে চায়, জল ঘোলা করে মাছ শিকার করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একদল মানুষ মহামারির অনুষঙ্গ হিসেবে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনাতে চাইছে। সেই চুয়াত্তর স্টাইলে বাসন্তী নাটকের মহড়া করতে চাইছে। এরা দেশের শত্রম্ন। বুঝতে হবে এই পরিস্থিতি কারুর একার সৃষ্ট নয়। এককভাবে কেউ দায়ীও নয়। মনে রাখতে হবে আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, চীনের মতো দেশও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। \হতবে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। এই মহাদুর্যোগের মোকাবিলায় অনেক কাজ আমাদের একসঙ্গে করতে হবে। যে কোনো মূল্যে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি সংক্রমণ রুখে দিতে হবে। দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি না করে সবাই মিলে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে। গজদন্ত মিনারে বসে রাজা-উজির না মেরে যুদ্ধক্ষেত্রে এসে শত্রম্ননিধন করতে হবে। সমালোচনা না করে দৃশ্যমান কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আর তাৎক্ষণিক বিপদের চেয়ে বড় বিপদ আসতে পারে ভেবে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা চলবে না। সামাজিক দূরত্বের শর্তাদি মেনেও খেতে-খামারে কাজ করা যায়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত 'একটি বাড়ি একটি খামার' প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে ক্ষমতায়িত করতে হবে। আতঙ্কিত হয়ে কিংবা আতঙ্ক সৃষ্টি করে করোনার হাত থেকে নিস্তার মিলবে না। সচেতনতা, সাবধানতা এবং বিচক্ষণতার মধ্যদিয়েই করোনা সংকটের মোকাবিলা করতে হবে। প্রচন্ড জীবনবোধ এবং প্রবল আশাবাদই পারবে করোনার অন্ধকার মেঘের কিনারে রূপালি রেখার ঝিলিক দেখাতে। রাত যতো গভীর ভোর ততোই আসন্ন। বাঙালি একাত্তরে একবার গর্জে উঠেছিল দেশের শত্রম্নর বিরুদ্ধে। এখন আরেকবার গর্জে উঠবে দেশ তথা মানবজাতির শত্রম্নর বিরুদ্ধে। করোনাকালের অবসানে সময়ের ব্যাপার মাত্র। ড. রাশিদ আসকারী: শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক