করোনায় গার্মেন্ট শ্রমিক অসন্তোষ

আমরা মনে করি, যেসব কারখানায় এখনো শ্রমিকদের বেতন হয়নি, তা দ্রম্নত দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। করোনাকালে শ্রমিক বিক্ষোভ সমর্থনযোগ্য নয়। পাশাপাশি এ দুঃসময়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে হবে। কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা যাবে না। দেশের শ্রমিকরাই অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি, তাদের নিরলস পরিশ্রমেই মালিকরা ফুলে-ফেপে উঠেছেন। সুতরাং শ্রমিকদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক আচরণ করাই শ্রেয়।

প্রকাশ | ২৪ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন যথাসময়ে পরিশোধের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েও তা মানেননি অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছে। লকডাউনের মধ্যেও তারা সড়ক অবরোধ ও মিছিল করছেন। লঙ্ঘিত হচ্ছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা। রাজধানীর উত্তরা, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গত দু'দিন গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। গাজীপুর ও সাভারে পাওনা টাকা আদায় এবং ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে লকডাউনের মধ্যেও গার্মেন্ট শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। টায়ারে আগুন ধরিয়ে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধসহ সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। সড়ক অবরোধের কারণে জরুরি পণ্যবাহী গাড়ি আটকা পড়ে মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বেতন-ভাতার দাবিতে কয়েকটি গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শিল্প পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন শ্রমিকরা। সোমবার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে গাজীপুরের দক্ষিণ সালনায় অক্সফোর্ড শার্টস লিমিটেড নামে একটি তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে। আলোচনায় মালিকপক্ষ কোনো শ্রমিক ছাঁটাই না করার প্রতিশ্রম্নতি দিলে শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে ফিরে যান। বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে সাভারে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভও করছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের অনেক পোশাক কারখানা এখনো মার্চ মাসের বেতন দিতে পারেনি। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। বেতন না পাওয়ায় নানামুখী চাপে পড়েছেন এই খাতে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক ও তাদের পরিবার। ইতোমধ্যে বেতনের দাবিতে ঢাকার সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যে কোনো সময়ে এ অসন্তোষ বড় আকার ধারণ করতে পারে। এতে এ খাতে অরাজকতা সৃষ্টির পাশাপাশি করোনা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে মোট পোশাক কারখানা রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ১০৭টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানার ২ হাজার ২৭৪টি ও বিকেএমইএর ৮৩৩টি। ধারণা করা হয়, এসব কারখানায় প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। যদি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে অধিকাংশ শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে বিকাশের মাধ্যমে। প্রশ্ন হচ্ছে তা হলে বিক্ষোভ হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, কারখানাগুলোকে মাসের প্রথম সাত কর্মদিবসের মধ্যে বেতন পরিশোধ করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে কারখানা বন্ধ থাকায় গত ৪ এপ্রিল আশুলিয়া অঞ্চলের মালিকদের এক বৈঠকে ১২ এপ্রিল বেতন পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওইদিন রাতেই তা বাড়িয়ে ১৬ এপ্রিলের মধ্যে বেতন পরিশোধের জন্য মালিকদের অনুরোধ জানান বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক। \হপোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, লকডাউন ও সাধারণ ছুটির কারণে কারখানাগুলো শ্রমিকদের হাতে হাতে বেতন দিতে পারছে না। এ ছাড়া সরকারঘোষিত শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার অর্থ সরাসরি শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় কারখানাগুলোকে শ্রমিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকদের নির্ভুল তথ্যের অভাব ও ব্যাংকিং সময়সীমা কমে যাওয়ায় এতেও ধীরগতি দেখা দিয়েছে। কয়েকজন কারখানা মালিক জানিয়েছেন, তারা বেতনের কাগজপত্র প্রস্তুত করেছেন। কিন্তু কীভাবে শ্রমিকদের বেতন দেবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক শ্রমিক নিয়োগপত্র নেওয়ার সময় ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর দেওয়ায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য ওইসব শ্রমিকের ব্যাংক হিসাব খোলা যাচ্ছে না। একত্রে সব কারখানার শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাব খোলায় ব্যাংকের ওপরও চাপ বেড়েছে। নারায়ণগঞ্জ এলাকা লকডাউন থাকায় ওই এলাকার শতাধিক কারখানা বেতনের কার্যক্রমই শুরু করতে পারেনি। আর্থিক সংকটে থাকায় অনেক কারাখানার বেতনের টাকা এখনো জোগাড় হয়নি। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, একটি কারখানায় দুই মাসের বেতন বাকি রয়েছে। ১৪ এপ্রিল শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার কথা বলে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ ১৮ এপ্রিলের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের ঘোষণা দিলে শ্রমিকরা আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা যাতে সময়মতো মজুরি দিতে পারেন তা নিশ্চিত করতে সরকার বড় ধরনের প্রণোদনাদানের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিল শ্রমিকরা সময়মতো বেতন পাবেন। কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখার নীতিতে তারা যে অবিচল থাকতে পারেননি, মজুরি পরিশোধ নিয়ে সৃষ্ট অসন্তোষ তারই উদাহরণ। নিজেদের স্বার্থেই মালিকপক্ষ সংঘাত সৃষ্টির পথ থেকে সরে আসবেন- এমনটিই প্রত্যাশিত। আমরা মনে করি, যেসব কারখানায় এখনো শ্রমিকদের বেতন হয়নি, তা দ্রম্নত দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। করোনাকালে শ্রমিক বিক্ষোভ সমর্থনযোগ্য নয়। পাশাপাশি এ দুঃসময়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে হবে। কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা যাবে না। দেশের শ্রমিকরাই অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি, তাদের নিরলস পরিশ্রমেই মালিকরা ফুলে-ফেপে উঠেছেন। সুতরাং শ্রমিকদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক আচরণ করাই শ্রেয়। আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সভাপতি বাংলাদেশ ম্যাচ ম্যানুফ্যাকচারার এসোসিয়েশন, সদস্য এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা