করোনার প্রভাব মোকাবিলায় কৃষিই ভরসা

এ দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের কৃষিকে অব্যাহত রেখে দেশের অভ্যন্তরেই শুধু নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। সে জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের কৃষকের কৃষি কাজ অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চলেছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই হয়তো আমরা উৎপাদন বা তৈরি করতে পারি না। কিন্তু আমরা কৃষি পণ্য সহজেই উৎপাদন করতে পারি। এটিকে আমরা কৃষিযুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করতে পারি। আর এর সম্মুখযোদ্ধা হলেন আমাদের গর্বিত কৃষক।

প্রকাশ | ২৭ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

ড. মো. হুমায়ুন কবীর
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশে বর্তমানে সরাসরি কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত এমন লোকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৩ শতাংশ। তা ছাড়া দেশের অর্থনীতির মোট যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি রয়েছে তার মধ্যে কৃষি, শিল্প ও বিদেশি রেমিট্যান্সই প্রধান। শিল্পের মধ্যে যেমন ক্ষুদ্র, মাঝারি, ভারী প্রভৃতি বিভিন্ন ভাগ রয়েছে- তার মধ্যে তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে কৃষি খাতের পুরোটাই কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতিভিত্তিক। সেখানে কৃষকদের মধ্যে ভূমিহীন, মাঝারি, ক্ষুদ্র, বড় এমন অনেক ধরনের কৃষক রয়েছে। আবার কৃষির রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপখাত। মৎস্য, প্রাণিসম্পদ এবং এসব খাতের ছোট-বড় অনেক খামারি। কিছু কিছু বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বাদবাকি পুরোটা জুড়েই জড়িয়ে রয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকালে এর ক্ষয়ক্ষতির পুরোটাই সেসব গ্রামীণ জনপদকেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমরা জানি, করোনাকালে গোটা বিশ্বই লকডাউন নামক একটি সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা এও জানি, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষ জড়িত, যাদের আবার ৯০ শতাংশেরই বেশি নারী। গার্মেন্টস কোম্পানিগুলো লকডাউনে থাকার কারণে তারা যে শুধু কর্মহীন হয়ে পড়েছে তাই নয়, তারা এখন নূ্যনতম খাদ্য প্রাপ্তি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। রেমিট্যান্সের যে বিরাট অংশ প্রবাসে থাকা প্রায় ১ কোটি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের শ্রম থেকে আসত তা এখন পুরোপুরি বন্ধ। শুধু তাই নয়, বাড়তি তারা এখন রয়েছে করোনা আক্রমণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যেও। এর মধ্যে কৃষি খাতই একটু ব্যতিক্রম। কারণ শুধু এবারকার করোনাকালে নয়, যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কৃষক তার বাড়িতে বসে তার নিজের জমিতে কাজ করে চলে। এবারও তা চলেছে। সেখানে যেহেতু এতটা জনসমাগম নেই, বাহির থেকে খুব বেশি লোকজন যাতায়াত করতে হয় না। সে জন্য শহরের তুলনায় তাদের করোনা আক্রমণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেকটাই কম। তা ছাড়া খোলা আকাশ-বাতাস, রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, কাজেই কৃষকরা নূ্যনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই ঝুঁকি কমে যায়। শুধু সাময়িক পরিবহন অসুবিধার জন্য তাদের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু ফসল উৎপাদনে তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। তা ছাড়া কৃষিবান্ধব শেখ হাসিনার সরকার কৃষি উপকরণ তথা- সার, বীজ, সেচ, জ্বালানি, কীটনাশক, উৎপাদিত শাকসবজি, ধান-চাল, তেল, পিঁয়াজ-রসুন, গম-ভুট্টা ও আলু-পটোল ইত্যাদি বিশেষ ব্যবস্থায় অর্থাৎ জরুরি পণ্য হিসেবে মর্যাদা দিয়ে পরিবহণ করা হচ্ছে। এখন কৃষকের মাঠে কিছু শেষ সময়ের শীতকালীন শাকসবজি এবং আগাম গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি রয়েছে। অপরদিকে হাওড়সহ সারাদেশে বোরোধান একেবারে পাকা অবস্থায় সংগ্রহের পর্যায়ে রয়েছে। সারাদেশের তুলনায় হাওড়ের বোরো ফসল একটু আগে বিশেষভাবে সংগ্রহ করতে হয়। করোনার জন্য সেসব এলাকায় যদিও কৃষি শ্রমিকের ব্যাপক সংকট রয়েছে তথাপি সেটি সংশ্লিষ্ট এলাকার মাঠ পর্যায়ের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের পরামর্শ, সরকারের বিশেষ নির্দেশনায় জেলা প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় নিরাপদে তা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সারাদেশের বোরো ধানও একই পদ্ধতিতে সময় মতো সংগ্রহ করা হবে। যেহেতু আলস্নাহ্‌র রহমতে এবারে বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হয়েছে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতায় তা নিরাপদে মাড়াইয়ের আশা করা যাচ্ছে। \হখাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ (এফএও) বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধারণা করছে বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে যে সংকট সৃষ্টি হবে তার প্রাথমিক ধাক্কাটা আসবে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর। আর সেটির কারণে বিশ্বে বিরাট খাদ্য ঘাটতিই শুধু নয়, দেখা দিতে পারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বিশ্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন দুর্যোগের পরে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ নিত্য-নৈমিত্তিক হিসেবে দেখা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়েছিল- যা আমরা সবাই জানি। বস্তুত এ করোনার প্রাদুর্ভাবকে একটি যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করে এটিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে মনে করছেন অনেকে। আর এ যুদ্ধের ফলে খাদ্য সংকট সৃষ্টি এবং দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় কৃষিই একমাত্র ভরসা। বাংলাদেশে বর্তমানে কৃষির যে অবস্থা সেটিকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে পারলে তা দিয়ে আমাদের দেশের দুর্ভিক্ষ তো বটেই, উপরন্তু আরো পার্শ্ববর্তী অনেক দেশকে সহযোগিতা করা যাবে। \হআমাদের দেশটি সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা। কৃষির জন্য এর মাটি, জল, আবহাওয়া খুবই উপযোগী। সে জন্য দেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মনে করতেন এবং এখন তারই কন্যা কৃষকরত্ন শেখ হাসিনাও তাই মনে করেন। তিনি তার বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন সে কথা। বাংলাদেশের এমন উর্বর মাটিই হতে পারে এ সময়ে আমাদের জন্য আশীর্বাদ। এটি উপলব্ধি করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেশের চলমান বর্তমান কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে তাদের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন কৃষিবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। তারমধ্যে কৃষি প্রণোদনা অন্যতম। স্বল্পসুদে কৃষিঋণ, মৎস্য খামারি, হাঁস-মুরগি খামারি, গরু-ছাগল খামারি, দুগ্ধ খামারিসহ সবার জন্য সহজশর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার হাওড়াঞ্চলের কৃষকদের জন্য এ বোরো মৌসুমেই কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের ঘোষণা দিয়েছেন। চলমান সবজি ফসল নিরাপদে উত্তোলন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ, চলমান বোরো ধান নিরাপদে মাড়াই, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সঠিকভাবে করতে পারলে সামনের কমপক্ষে ছয়মাস আমাদের দেশে খাদ্য ঘাটতি কিংবা দুর্ভিক্ষ কোনোভাবেই স্পর্শ করতে পারবে না। এরপরে আসছে আউশ ধানের আবাদ, তার পরপরই আসবে আমন ধানের আবাদ। তা ছাড়া অন্যান্য মৌসুমি ফসল ও বারোমাসি শাকসবজি তো রয়েছেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাকালে যারা গ্রামেগঞ্জে চলে গিয়েছেন অথবা নিজের বাসাবাড়িতে আছেন তাদের যার যার সাধ্যমত চাষাবাদ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি কারো বাড়িতে যেন কোনো জায়গা যাতে খালি না থাকে সেদিকেও নজর রাখতে বলেছেন। কারণ তিনি এ দুর্যোগের সময়ে শুধু আমাদের দেশে নিয়েই ভাবছেন তাই নয়, তিনি বিশ্বের যেসব দেশে খাদ্য ঘটিতি দেখা দিতে পারে সে দিকেও নজর রাখছেন। সে জন্য তিনি যে কোনো মূল্যে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। করোনা প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় তিনি যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন সেগুলো যাতে সরাসরি কৃষকের কাছে পৌঁছে সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে। গত বছর যে পরিমাণ ধান উৎপাদিত হয়েছিল সেগুলো রাখার মতো জায়গাও সরকারি গুদামে তো ছিলই না, ছিল না কৃষকের গোলাতেও। তারপরও এবার গত বছরের তুলনায় দুই লাখ টন খাদ্যশস্য বেশি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকারিভাবে ক্রয় করবে সরকার। যাতে কৃষক বেশি উপকৃত হয়। এসব কারণেই আমাদের দেশ এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ থেকে এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে। এখন বিভিন্ন ফল ও সবজির পাশাপাশি চালও রপ্তানি হয়ে থাকে। এ করোনা দুর্যোগকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রীর পাশাপাশি মাস্ক, স্যানিটাইজার, পিপিই, গস্নাভস ইত্যাদি ত্রাণ হিসেবে চীন, মালদ্বীপসহ আরো কয়েকটি দেশে প্রেরণ করেছেন। এ দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের কৃষিকে অব্যাহত রেখে দেশের অভ্যন্তরেই শুধু নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। সে জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের কৃষকের কৃষি কাজ অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চলেছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই হয়তো আমরা উৎপাদন বা তৈরি করতে পারি না। কিন্তু আমরা কৃষি পণ্য সহজেই উৎপাদন করতে পারি। এটিকে আমরা কৃষিযুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করতে পারি। আর এর সম্মুখযোদ্ধা হলেন আমাদের গর্বিত কৃষক। অন্য সব যুদ্ধে যেভাবে আমরা বিজয় অর্জন করেছি এ করোনা যুদ্ধেও আমরাই জয়ী হবো- সেটিই প্রত্যাশা। কোনোটির গুরুত্বই একেবারে কম নয়। এ সময়ে আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে তাই দেশের কৃষিই একমাত্র ভরসা। আর কৃষিকে পুঁজি করেই আমাদের সামনের দিনগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। তাহলেই আমাদের দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। ড. মো. হুমায়ুন কবীর : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। শনফযঁসধুঁহ০৮@মসধরষ.পড়স