বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিশেষ নজর দিতে হবে

মানুষ যখন আতঙ্ক ও সন্দেহকে মনের মধ্যে প্রশ্রয় দেয় মন তখন দুর্বল হয়ে পড়ে। নিজস্ব শক্তি ও আত্মবিশ্বাস তখন ধীরে ধীরে তার তেজ হারিয়ে ফেলে। করোনায় আক্রান্তের ভয় ও সন্দেহ নিঃসন্দেহে মানসিক শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে- যা পুরো দেহমনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
মাছুম বিলস্নাহ
  ২৮ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, দিনের পর দিন গৃহে আবদ্ধ থাকা, যার যে কাজ সেগুলো করতে না পারা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে না পারা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, উন্মুক্ত মাঠে প্রান্তরে ঘুরতে ও খেলতে না পারা, যে কোনো সময় মৃতু্য উপস্থিত হওয়ার আশঙ্কা ও চারদিক থেকে মুতু্যর খবর পাওয়া- মানসিক রোগ ঘটানোর এ ধরনের সব উপাদানই এই করোনাকালে উপস্থিত। চারদিক থেকে অবিরত আসতে থাকা দুঃসংবাদগুলো মানুষকে অস্থির করে তুলছে। এর ফলে যাদের এনজাইটি এবং অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডির মতো মানসিক সমস্যা রয়েছে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাই এই সময়ে শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও সবার নজর দিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তাই বলছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ প্রচেষ্টা, এর দ্রম্নত বিস্তার, লকডাউন, হোম কোয়ারেন্টিইন, মানুষের মৃতু্য সংবাদ টিভির পর্দায় দেখে এবং পত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পড়ে কোটি কোটি মানুষের মনে তৈরি হয়েছে তীব্র উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ভয়- যা তাদের মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করার পাঁয়তারা করছে। মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মাইন্ড-এর মুখপাত্র রোজী ওয়েদারলি বলেছেন, 'অজানা যে কোনো কিছুর ব্যাপারে দুর্ভাবনা এবং কিছু একটা ঘটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকা- এ দুটো এই সমস্যার মূলে। করোনভাইরাসের ক্ষেত্রে এটিই একটি বিরাট আকার নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ এখন গৃহবন্দি, তাদের মধ্যে গুরুতর মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকির এ দিকটি করোনাসৃষ্ট অর্থনীতির বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। বেলজিয়ামের মনোবিদ এলকে ভ্যান হুফ গৃহবন্দি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়াকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশ্বে লকডাউনে থাকা মানুষের সংখ্যা ২৬০ কোটি। ঘরবন্দি মানুষের সংখ্যার দিকে থেকে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট-এ ২৬ ফেব্রম্নয়ারি প্রকাশিত একটি নিবন্ধের বরাত দিয়ে ভ্যান হুফ লিখেছেন, গৃহবন্দি মানুষের নানা রকম মানসিক চাপ ও অসুস্থতার শিকার হয়ে থাকে। এর মধ্যে আছে মন খারাপ, অনিদ্রা, উদ্বেগ-উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, বিভ্রান্তি, বিষণ্ন্নতা, রাগ, খিটখিটে মেজাজ, অবসাদ আর বিপর্যয় বা ট্রমা- পরবর্তী মানসিক চাপের নানা লক্ষণ। ল্যানসেট-এর নিবন্ধটি বিভিন্ন কোয়ারেন্টিনকালীন ২৪টি গবেষণাপত্রের পর্যালোচনা। এগুলোর মধ্যে হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর একটি গবেষণার কথা আছে। তাতে দেখা যায় সঙ্গ-নিরোধের তিন বছর পরও প্রায় দশ শতাংশ কর্মীর উচ্চ বিষণ্নতার লক্ষণ ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোর জন্য মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্দেশনা তৈরি করেছে। উহানের হাসপাতালে আসা রোগীদের একটি গোষ্ঠীর মধ্যে পরিচালিত গবেষণার একটি অপ্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে ৩৪ শতাংশের বেশি রোগীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং ২৮ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা গিয়েছে। উহানের কেন্দ্রীয় বিবাহ নিবন্ধন বিভাগের হিসাবে প্রদেশটিতে বিবাহবিচ্ছেদের হার ২৫ শতাংশ বেড়েছে- যা তাদের বর্ধিত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠারই প্রমাণ বহন করে। ভ্যান হুফ বলছেন, কোভিড-১৯ রোগের শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি সামাল দিতে রাষ্ট্রগুলো যত ব্যবস্থা নিচ্ছে মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার বিষয়টি ততটা মনোযোগ পাচ্ছে না। লকডাউন উঠে যাওয়ার তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যখন সুস্থ-সমর্থ সব মানুষের সহায়তার প্রয়োজন হবে, এই অবহেলার মূল্য তখন দিতে হবে।

মানুষ যখন আতঙ্ক ও সন্দেহকে মনের মধ্যে প্রশ্রয় দেয় মন তখন দুর্বল হয়ে পড়ে। নিজস্ব শক্তি ও আত্মবিশ্বাস তখন ধীরে ধীরে তার তেজ হারিয়ে ফেলে। করোনায় আক্রান্তের ভয় ও সন্দেহ নিঃসন্দেহে মানসিক শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে- যা পুরো দেহমনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

অনেকেই আতঙ্কে নাকি ঘুমের ওষুধ খাচ্ছেন। কেউ কেউ কঠিন ডোজ খেয়েও ঘুমাতে পারছেন না; এ ধরনের খবর দিচ্ছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৯ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। তিনি খুব সাহসী ছিলেন কিন্তু ফাঁসির কথা শুনে তিনিও ভেতরে ভেতরে নাকি মারা যাচ্ছিলেন। যেদিন তার ফাঁসি হওয়ার কথা সেদিন নাকি তিনি কঠিন ঘুমের বড়ি খেয়ে ফাঁসির দুশ্চিন্তা এড়াতে চেয়েছিলেন। তাকে যখন সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তিনি তখনও ঘুমে, তাকে স্ট্রেচারে করে মঞ্চের কাছে নেয়া হয়। নিরাপত্তারক্ষী ও জলস্নাদরা তাকে বলছিলেন, 'আপনি উঠে বসুন, আপনি না বলতেন আমি মৃতু্যকে ভয় পাই না।' তখন তিনি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বলেছিলেন 'যা করার তাড়াতড়ি করে ফেলুন, আমার কষ্ট হচ্ছে।' কারো কারো ক্ষেত্রে শারীরিক অসুস্থতা মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়।

আমাদের কঠিন সময়ের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে করোনার এই মহামারির মধ্যেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নানা ধরনের দুর্ঘটনার খবর। স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, মানুষ খুব অস্থির হয়ে যাচ্ছে। সহনশীল আচরণ তার মধ্যে কমে যাচ্ছে। ক্রমে বাড়ছে হিংস্রতা। আমরা এখন একটা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি, এ এক অজানা যুদ্ধ, তাই বিষণ্ন হয়ে উঠছি। পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা আমাদের মানসিক অস্থিরতায় ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভালো থাকতে হবে, চারপাশের পরিবেশকে ভালো রাখতে হবে। যারা পরিবারের সঙ্গে আছেন তাদের সমস্যা একটু কম কিন্তু যারা একাকী জীবনযাপন করছেন তাদের সমস্যটা এই সময়ে আরও বেশি। তাই প্রতিদিনের লাইফস্টাইল পাল্টাতে হবে। মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার জন্য সকালে পনের থেকে বিশ মিনিট বিছানায় কিংবা মেঝেতে বসে ধ্যান করতে হবে। গল্পের বই পড়তে হবে, কিংবা মোবাইলে ই-বুক বা সিনেমা বা আনন্দদায়ক ও শিক্ষামূলক কিছু পড়তে হবে, মোট কথা নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে, মনের মধ্যে বিষণ্ন্নতাকে ঠাঁই দেয়া যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ব্যায়ামগুলোও করতে হবে। পছন্দের গানগুলো শুনতে হবে, গল্পের বই ও কবিতা পড়তে হবে। বাড়ির সঙ্গে গাছপালা বা বাগানে সম্ভব হলে সময় কাটাতে হবে। ফেলে আসা জীবনের কিছু ভালো স্মৃতি স্মরণ করতে হবে। নাটক ও সিনেমা দেখতে হবে, পছন্দের খাবার খেতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয় অনেকখানি। তাই যতটা সম্ভব সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। রাতে ঘুমানের সময় মোবাইল ফোন অফ করে রেখে দিতে হবে। রাতে ঘুম আসতে দেরি হলে বই পড়া শুরু করতে হবে- যাতে অটোমেটিক ঘুম এসে যায়। মনোবিজ্ঞানী স্টিভেন ডি. সাও নিজে যখন কোনো কারণে খুব বেশি দুশ্চিন্তার মাঝে থাকেন তখন তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করেন, 'আমি কি ভালোভাবে ঘুমাচ্ছি? আমি কি পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছি?' তা থেকে বুঝা যায় যে, ঘুম ও পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে মানসিক অস্থিরতা দূরীভূত হওয়ার একটি চমৎকার যোগসূত্র রয়েছে।

একমাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টারগুলোও। ঘরবন্দি দেশের প্রায় চার কোটি শিশু-কিশোর। এ সময় তাদের একাডেমিক পড়াশোনায় মন বসছে না কারণ বিদ্যালয়ে পড়া দিতে হচ্ছে না, বিদ্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত নেই- যা তাদের অভ্যাসের অংশ ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, খেলাধুলা, ঘোরাঘুরির আনন্দ থেকেও তারা বঞ্চিত। তাদের জীবনের হঠাৎ এই ছন্দপতন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে শরীর ও মনের ওপর। এ অবস্থায় তাদের প্রয়োজন আনন্দময় পরিবেশ। মানসিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সময় শৈশব-কৈশোর। এ সময়টিই সব কিছু নতুন আলোক নিয়ে উপস্থিত হয়। তাই, এ পর্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়টিতে বেশিরভাগ শিশু-কিশোর খুব যান্ত্রিক হয়ে উঠছে, হাঁপিয়ে উঠছে ঘরবন্দি থাকতে থাকতে। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'করোনার প্রভাবে সামাজিক বিপত্তি ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে গোটা সমাজেই। সমাজের সব শ্রেণিতেই পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। শিশু-কিশোররাও তার ব্যতিক্রম নয়। ঘরে থাকতে থাকতে তাদের অনেকেই বিরক্তি ও বিমর্ষ হয়ে উঠছে। এ জন্য তাদের আনন্দময় পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।' মনোবিদ মোহিত কামাল বলেছেন, 'শিশ-কিশোরদের সঙ্গে যত বেশি কোয়ালিটি টাইম কাটানো যাবে, তাদের উদ্বেগ তত বেশি কমবে। পাশাপাশি তাদের জন্য ইনডোর গেমের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের হাতে তুলে দিতে হবে শিশু-কিশোর সাহিত্যের বই।' আসুন আমরা সবাই কঠিন এ সময়ে শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিই এবং এ ব্যাপারে আমাদের নিজ নিজ পরিবারের শিশু-কিশোরদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করি।

মাছুম বিলস্নাহ: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<97647 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1