শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধান কাটা ও মাড়াইয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি

নতুনধারা
  ০৩ মে ২০২০, ০০:০০

দেশে চলেছে চরম সংকট। প্রতিদিন মৃতু্যর খাতায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। আর সেটা রুখতে করোনাভাইরাস নামে এক অদৃশ্যের বিরুদ্ধে চলছে যুদ্ধ। এ যুদ্ধের প্রধান কৌশলই হচ্ছে ঘরে থাকা। এতে সারা দেশে কর্মহীন হয়ে পড়ছে কোটি কোটি মানুষ। ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। তবে ঘটনা যেটাই ঘটুক মানুষের পেট কিন্তু সে সব কথা মানবে না। সে জন্য সব কিছু উপেক্ষা করে রাস্তায় কর্মহীন অনেক শ্রমজীবী মানুষকে দেখা যাচ্ছে সামান্য ত্রাণের আসায় ছোটাছুটি করতে। আর এ ত্রাণের মূল উপাদানই হচ্ছে চাল। যা এ দেশের কৃষকরা রোদ, বৃষ্টি ও ঘামে ভিজে উৎপাদন করে থাকে। দেশের এই সংকট মুহূর্তে যখন প্রতিটি জেলা থেকে জেলা, উপজেলা থেকে উপজেলা নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিচ্ছিন্ন করেছে স্থানীয় প্রশাসন ঠিক সেই সময়েই শুরু হয়েছে ইরি- বোরো কাটা মাড়াই। এই বোরো ধান থেকেই দেশের চাহিদার সিংহভাগ চাল উৎপাদন হয়ে থাকে। আর প্রতিবছরই এ সময় দেখা দেয় শ্রমিকের চরম সংকট। আর সুযোগ বুঝে স্থানীয় শ্রমিকরা তৈরি করে শ্রমিক সিন্ডিকেট। শুধু ধান কাটা মাড়াইয়ের জন্য সুযোগ বুঝে দাবি করে ক্ষেতের অর্ধেক ধান বা সমপরিমাণ অর্থ। এতে কঠোর পরিশ্রম করেও কৃষকদের গুনতে হয় লোকসান। গত বছর শ্রমিকের অভাবে ধান কাটতে না পেরে অনেক কৃষককে ক্ষেতে আগুন দিতে দেখা গেছে। আবার অনেকে নায্যমূল্য না পেয়ে রাস্তায় ধান ছিটিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। যার ফলস্বরূপ কৃষকরা বেছে নিচ্ছে অন্য ফসল উৎপাদনের পথ। অনেকে ধানের জমি মাৎস্য চাষিদের কাছে চুক্তিভিত্তিতে পুকুর খননের জন্য ইজারা দিচ্ছে। অনেকে আম বাগান, নিচু বাগান, পেয়ারা বাগান অথবা স্বল্প শ্রমের অন্য কোনো ফসলচাষে ঝুঁক পড়ছে। এতে দিন দিন কমে যাচ্ছে ধান উৎপাদন। ফলে ভবিষ্যতে খাদ্যসংকটের দিকে চলছে দেশ। আর বর্তমান পরিস্থিতে খাদ্যসংকট তৈরি হলে দেশে নেমে আসবে চরম হাহাকার। করোনার চেয়েও তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। সেজন্য চলতি ইরি-বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ে কৃষকরা যেন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে অতি দ্রম্নত কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ে জরুরি পদক্ষেপসহ সরকারের সুপরিকল্পনার অতীব প্রয়োজন। সে কারণে কৃষকদের লোকসান মুক্তভাবে ধান ঘরে তুলতে কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। তার আগে একটু বলে নিই- দেশের এ পরিস্থিতিতে যেহেতু এক এলাকা থেকে শ্রমিক অন্য এলাকায় ঢুকতে পারছে না। বিশেষ করে এক জেলা থেকে অন্য জেলা। সে ক্ষেত্রে আমাদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। নিজ নিজ এলাকার ফসল যেন মাঠে নষ্ট না হয় সেজন্য কৃষকের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। কৃষকদের ধান কাটতে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে। যে সব ভাইয়েরা রিকশা, ভ্যান, সিএনজি, স্থানীয় মোটরশ্রমিক বা অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অথচ করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে আছেন তারা নিজেদের আত্ম-মর্যাদা নিয়ে ভেবে ঘরে বসে না থেকে কৃষক ভাইদের ধান কাটা ও মাড়াইয়ে এগিয়ে এসে সহযোগিতা করা অতি প্রয়োজন। আত্ম-মর্যাদা এ জন্য বললাম, একজন বাসের টিকেট মাস্টার ভাবতে পারেন আমি বসে থেকে সারাজীবন টিকেট বিক্রি করলাম আর আজ মাঠে ধান কাটবো এটা লোকে কী ভাববে। সিএনজিচালক ভাবতে পারে আমি সিএনজি চালাই আমার একটি সম্মান আছে আমি কেন মাঠে ধান কাটতে যাবো এতে লোকে কী বলবে। আমাদের এ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কর্মহীন এ সময়ে প্রত্যেকেরই উচিত নিজ নিজ খেতেই হোক বা চুক্তি ভিত্তিতে অন্যের খেতেই হোক বসে না থেকে ধান কাটার মানসিকতা করতে হবে। এতে নিজেদের একটা কর্মেরও ব্যবস্থা হবে আবার খাদ্যসংকট থেকে দেশকে বাঁচাতে সহযোগিতা করা হবে। ছাত্র ভাইদেরও উচিত আত্ম-সম্মানের কথা না ভেবে দেশের কল্যাণে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করা। কারণ এসময় আপনাদেরও পড়াশোনা নেই, যারা টিউশনি করে পড়াশোনা করতেন তাদের টিউশনিও বন্ধ। কৃষকদের এ সংকটে পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করলে উভয়েরই লাভ। কৃষকের ফসল ঘরে উঠল আর আপনিও কিছু টাকা পেলেন যা দিয়ে পড়াশোনার খরচ চালানো যাবে। আর এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের উচিত উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণা চালানো। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় প্রশাসনের আরও কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি বলে আমার অভিমত।

\হইরি-বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের সময় প্রতি বছর লক্ষ্য করা যায় শ্রমিক সংকটের অজুহাতে শ্রমিকরা ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য অযাচিত অর্থ দাবি করে। এই টাকা না দিলে তারা ধান কাটবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়। যেহেতু এই সময়টায় ঝড়- বৃষ্টি হয়ে থাকে। সে জন্য ধান মাঠে থাকলে যে কোনো সময় ঝড়- বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই কৃষক অনেকটা বাধ্য হয়েই শ্রমিকদের সেই অযাচিত শর্ত মেনে নিয়ে ধান কাটা ও মাড়াই করতে হয়। এটিই মূলত কৃষকদের ইরি-বোরো চাষে লোকসানের প্রধান কারণ। এটিকে বলা হয় শ্রমিক সিন্ডিকেট। এই শ্রমিক সিন্ডিকেট বন্ধ করতে হবে। সে জন্য এই ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য কৃষক ও শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ বজায় রেখে প্রশাসনকে একটি নায্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। আর সেই নির্ধারিত মূল্যের বেশি যেন কোনো শ্রমিক সিন্ডিকেট করে নিতে না পারে সে বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি রাখতে হবে। প্রয়োজন দু-একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় যেতে পারে। এক কথায় ধান কাটার শ্রমিকমূল্য প্রশাসক কর্তৃক নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

এ ছাড়া বর্তমানে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এসেছে ধান কাটার ও মাড়াইয়ের আধুনিক মেশিন কম্বাইন হারভেস্টার। এ মেশিনে অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ ধান কাটা ও মাড়াই করা যায়। যা শতাধিক শ্রমিকেরও অধিক। সরকার ইতোমধ্য তা ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকের মধ্যে বিতরণ শুরু করেছে। কিন্তু এর মূল্য এতটাই বেশি যে ভর্তুকির পরও তা কৃষকদের পক্ষে কেনা সম্ভব হচ্ছে না। সে জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে কৃষক বাঁচানোর স্বার্থে এ ভর্তুকির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করতে হবে এবং দ্রম্নত সময়ে যেন কৃষকরা এ বছরই তা ক্রয় করতে পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি এটি ক্রয়ে কিস্তিভিত্তিক ঋণ সুবিধা প্রদান করতে হবে। যাতে কৃষকরা তা সহজে সামান্য পুঁজিতে কিনতে পারে। আর একটি বিষয় এই মেশিনটি নষ্ট হলে তা মেরামত করতে টেকনিশিয়ান সংকটে কৃষকদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। সে জন্য উপজেলাভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান নিয়োগ করতে হবে। যারা এ সব মেশিন দেখাশোনা ও মেরামতের কাজ করবে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রম্নততম প্রতিটি উপজেলায় ৫ থেকে ৬টি সম্ভব হলে ইউনিয়নভিত্তিক ১টি করে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন স্থানীয় উপ-সহকরী কৃষি কর্মকর্তাদের অধিনে কৃষকদের মধ্যে ভাড়া ভিত্তিতে সরবরাহ করতে হবে। যেটি ভাড়া নিয়ে কৃষকরা সহজে তাদের ধান কেটে ঘরে তুলতে পারে। এ ছাড়া অনেক এলাকায় ধান অগ্রিম পাকে তাই যে সব এলাকায় ধান কাটা এখনো শুরু হয়নি সে সব এলাকার মেশিন ভাড়া করে এনে এই ধানগুলো কাটা ও মাড়াই করা যেতে পারে। আবার অগ্রিম ধান কাটা শেষে সেই সব এলাকার মেশিন অন্য এলাকায় নিয়ে গিয়ে ধান কাটা যেতে পারে।

\হএ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় কৃষি অফিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। সর্বশেষ একটি কথাই বলব, দেশের এই সংকট মুহূর্তসহ ভবিষ্যতেও দেশের খাদ্যসংকট নির্মূলে ইরি-বেরো ধান শ্রমিক সংকট নিরসন করে সঠিক সময়ে কৃষকদের লোকসান মুক্তভাবে ঘরে তুলতে সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই।

আশরাফুল নয়ন

কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<98115 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1