দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানো এ দেশে কতটা সম্ভব?

বলা প্রয়োজন পড়ে না, দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিমানসম্পন্ন-নির্ভেজাল খাবার, দূষণমুক্ত বায়ু-পরিবেশ অপরিহার্য। দেহ সুস্থ রাখার সহায়ক নয় এমন খাবার- পরিবেশ দেশের মানুষের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা কমাচ্ছে- এটা বাস্তবতা। এ অবস্থায় দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে দেশের মানুষের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানো যাবে না। দেশের মানুষের দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়াতে হলে, পুষ্টিমানসম্পন্ন-নির্ভেজাল খাবার, সুস্বাস্থ্যের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।

প্রকাশ | ০৪ মে ২০২০, ০০:০০

জহির চৌধুরী
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এখন গোটা দুনিয়ায় তান্ডব চালাচ্ছে। জানা গেছে, বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ ও অঞ্চলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের চোখের সামনে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের মৃতু্য হচ্ছে। এ অবস্থায় বিশ্বের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর বা এ ভাইরাসে আক্রান্তদের সারিয়ে তোলার কার্যকর কোনো দাওয়াই খুঁজে পাচ্ছে না। প্রচলিত কিছু ওষুধ ব্যবহার করে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এতে সীমিত সংখ্যক ক্ষেত্রে কিছু সাফল্যের খবর পাওয়া গেলেও এ সাফল্যকে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের জন্য সু বা স্বস্তিদায়ক খবর বলার অবকাশ নেই। বর্তমানে করোনা আক্রান্তদের যে সব ওষুধ প্রয়োগ করে চিকিৎসা চলছে তাকে সান্ত্বনার চিকিৎসা বলা যেতে পারে। কবে নাগাদ এ ভাইরাস প্রতিরোধের প্রতিষেধক পাওয়া যাবে বা আবিষ্কার করা সম্ভব হবে তার সুনির্দিষ্ট সময়ও বলতে পারছেন না বিশ্বের খ্যাতিমান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকদের কেউই। তাই বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকরা হাত গুটিয়ে বসে নেই। করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দিন-রাত অবিরাম-অবিরত কাজ করছেন। কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক (টিকা) হাতে আসার আগে কীভাবে করোনার আক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায় তা নিয়েও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ভাবছেন। প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতাকেই করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষার উপায় মনে করছেন চিকিৎসা ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাবিস্নউএইচও), বিশ্বের খ্যাতিমান চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শরীর তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিদদের কাছ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ এবং রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ে এমন খাবারগুলো বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ এসেছে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিকিৎসকরাসহ সরকারও একই পরামর্শ দিচ্ছে দেশের মানুষকে। দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা শক্তিশালী হলে দেহে রোগের বা জীবাণুর অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব- এটা বৈজ্ঞানিকভাবেও স্বীকৃত। বিজ্ঞানীরা দেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছেন, দেহের স্রষ্টা প্রতিটি দেহকে রোগ-বালাই প্রতিরোধের শক্তি-সক্ষমতা দিয়েই তৈরি করেছে। এ কারণে প্রতিটি প্রাণীর দেহই রোগ-বালাইর আক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম। \হচিকিৎসা শাস্ত্রমতে, মানবদেহের একটি অত্যন্ত জটিল জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া রয়েছে যা দেহের ভেতরে-বাইরে সক্রিয় থেকে দেহকে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এ ব্যবস্থাকে বলা হয় মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি। যে দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা যত বেশি সে দেহে জীবাণুর আক্রমণ থেকে তত বেশি সুরক্ষিত। দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা শক্তিশালী হলে করোনাভাইরাসও দেহে বাসা বাঁধার ক্ষমতা রাখে না তা সম্প্রতি এক গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে। আমেরিকার ম্যাসাচুস্টেসের চেলসিতে ২০০ মানুষের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে গবেষকরা দেখেছেন- এ ২০০ মানুষের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) সম্পর্কিত অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। অ্যান্টিবডি হচ্ছে এক ধরনের প্রোটিন যা রক্তে তৈরি হয় এবং রোগ ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। গবেষকরা বলছেন, এই এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা থাকার কারণে নিজে নিজেই সুস্থ হয়েছেন। গবেষকদের একজন বলেছেন, তাদের জরিপ থেকে এটাই প্রমাণ হয়েছে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির উপায় হতে পারে হার্ড ইমিউনিটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বলেছেন, ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্লারায় ৪৮ হাজার থেকে ৮১ হাজার মানুষের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে, যা শনাক্ত সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ বেশি। উলেস্নখ্য, স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সান্তা ক্লারায় করোনাভাইরাস আক্রান্তের যে সময়ের সংখ্যা (৪৮ হাজার থেকে ৮১ হাজার) উলেস্নখ করেছেন সে সময় সরকারি হিসাবে ১ হাজার ৮৭০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের কথা বলা হয়েছে। এত বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেও তারা অসুস্থ নন কেন এমন প্রশ্ন গবেষকদের করা হয়েছিল। উত্তরে গবেষকরা বলেছেন, মানবদেহের প্রাকৃতিক সুরক্ষাব্যবস্থা অ্যান্টিবডির কারণেই ওই মানুষ অসুস্থ হননি। দেহের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই দেহকে সুরক্ষিত রাখতে অধিকতর কার্যকর তা নিয়ে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শক্তি ক্ষেত্র বিশেষে কমবেশি হয় বা হতে পারে নানা কারণে। জেনেটিক, অবস্থানের পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা, গ্রহণ করা খাদ্যের মান-গুণাগুণ ও ধরন দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতার হেরফের করে বা করতে পারে। দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা শক্তিশালী হলে করোনাভাইরাসের আক্রমণও প্রতিহত করা সম্ভব। দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেহকে রোগ-ব্যাধি, জীবাণুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য গ্রহণযোগ্য। তবে এ পরামর্শ গ্রহণ করে বাংলাদেশর মানুষ রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়াতে কতটা সক্ষম হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। বাংলাদেশের বাজারে বেচাকেনা হওয়া বেশির ভাগ খাদ্যপণ্য এবং বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক না বলে বিনাশে সহায়ক বলা হলে ভুল হবে না। বাংলাদেশে খুব কম খাবারই আছে যা নির্ভেজাল এবং যথাযথ পুষ্টিমানসম্পন্ন। বাংলাদেশে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, শাক-সবজি, চাল, ডাল, তেল, পানীয় জলসহ বলা যায় সব ধরনের খাবারই দেহের জন্য ক্ষতিকর। এসব খাবারের কোনোটিতে ফরমালিন, কোনোটিতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক, কোনোটিতে কীটনাশকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বাজারে বেচাকেনা হওয়া বোতল বাজারজাত পানির (মিনারেল ওয়াটার) বেশির ভাগই নোংরা ও জীবাণুমিশ্রিত। সরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়াসার সরবরাহ করা পানিও নিরাপদ নয়। গবেষণাগারে পরীক্ষায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতেও জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত খাবার মানুষের কিডনি, ফুসফুস, পাকস্থলী, গলা, খাদ্যনালি, পায়ুপথসহ শরীরের নানা জায়গায় জটিল রোগ সৃষ্টি করে মানুষকে শারীরিকভাবে দুর্বল করছে; মানুষের দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতাও কমিয়ে দিচ্ছে। বাজারে কেনা-বেচা হওয়া মুরগির মাংস ও মুরগির ডিমে মানবদেহে সহনীয়মাত্রার চেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য পর্যন্ত খাওয়ানো হয় খামারের মুরগিকে। এসব বর্জ্য খাওয়া মুরগির মাংস ও ডিম খেয়ে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সার আক্রান্তের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা ক্রমহ্রাসমান। বাংলাদেশে একশ্রেণির চিকিৎসক প্রয়োজন না হলেও ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দেন। এ ছাড়া বিপুল মানুষ ওষুধের দোকানের সেলসম্যান বা এর-ওর পরামর্শে ওষুধ প্রয়োজন হয় না, হলেও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয় না এমন রোগেও অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে। অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা যেটুকু আছে তারও সর্বনাশ করেছে। ব্যক্তির অবস্থানের পরিবেশে-প্রতিবেশও রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। নির্মল বায়ুর মধ্যে বসবাসকারীদের দেহের অবস্থা দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাসকারীদের চেয়ে ভালো থাকে- এটা বলা প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশে প্রতি চারজনের একজন বায়ুদূষণের কারণে মারা যায়- এ তথ্য আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের। বাংলাদেশে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বিশুদ্ধ অক্সিজেনের অভাব তীব্র করছে। বিশুদ্ধ অক্সিজেনের অভাব-বাতাসে থাকা ধূলিকণা, সিসাসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস শুধু ফুসফুসেরই নয় দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করে দেহের প্রতিরক্ষা শক্তি নিঃশেষ করে দিচ্ছে। এক কথায় বলা যায়- পরিবেশ দূষণ বাংলাদেশের মানুষের দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা কমাচ্ছে। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে- দেশের শহরাঞ্চলে বসবাসকারী বেশির ভাগ মানুষের ফুসফুস দূষণজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। অপরিকল্পিত নগরায়ন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় নগরীগুলোকে দূষণের হটস্পটে পরিণত করেছে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা না রেখে গড়ে ওঠা ইমারত-ভবনগুলোকে গ্যাস চেম্বার বলা যায় নির্দ্বিধায়। অপরিকল্পিত নগরায়নের নগরী ও পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ঢোকে না এমন বাড়ি-ঘরে বসবাস করে দেহ সুস্থ রাখার চিন্তাই করা যায় না। দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা তথা দেহের প্রতিরক্ষা শক্তি নাশে সহায়ক খাদ্য গ্রহণ, দূষিত পরিবেশে বাস করে দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানো কতটা সম্ভব- এমন প্রশ্ন তোলা হলে অবান্তর প্রশ্ন বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। বলা প্রয়োজন পড়ে না, দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিমানসম্পন্ন-নির্ভেজাল খাবার, দূষণমুক্ত বায়ু-পরিবেশ অপরিহার্য। দেহ সুস্থ রাখার সহায়ক নয় এমন খাবার- পরিবেশ দেশের মানুষের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা কমাচ্ছে- এটা বাস্তবতা। এ অবস্থায় দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে দেশের মানুষের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানো যাবে না। দেশের মানুষের দেহের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়াতে হলে, পুষ্টিমানসম্পন্ন-নির্ভেজাল খাবার, সুস্বাস্থ্যের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। জহির চৌধুরী: কলাম লেখক