দুর্নীতি নিপাত যাক শ্রমিক স্বার্থ ও শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠা পাক

এই করোনাকালেও একশ্রেণির মালিক তাদের নিয়ে বঞ্চনা ও শোষণের খেলা পেতেছেন। এমনকি তাদের মাসিক বেতন-ভাতাও যথারীতি প্রদান করছেন না এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাঁটাইয়ের কাজ চলমান আছে, যা শ্রমিক স্বার্থবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী। করোনার এই মহাদুর্যোগে অন্ততপক্ষে খেটে খাওয়া মেহনতি ও গরিব মানুষের অধিকারের প্রতি সচেতন হয়ে করোনাযুদ্ধে অবতীর্ণ হই, পাশাপাশি মানবতার পাশে দাঁড়াই।

প্রকাশ | ০৫ মে ২০২০, ০০:০০

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
করোনাকালে পালিত হলো অন্যরকম মে দিবস। মে দিবস আসলে শোষণমুক্তির অঙ্গীকার, ধনকুবেরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার শপথ নেওয়ার দিন। কীভাবে এই দিনটি পরিণত হলো এই মে দিবস হিসেবে সে ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা, ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেরালেই আমরা জানতে পারি শ্রমজীবী মানুষের সেই আন্দোলনের কথা। মেহনতি মানুষের এই আন্দোলনের পথ কখনো মসৃণ ছিল না। ছিল নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে মোড়া। জুলুম, অত্যাচার, প্রতিরোধ, ধর্মঘট, মিছিল, সংগ্রামের কাহিনি রয়েছে এই দিনটার পিছনে। ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরের শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের মূল দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা। সেদিন কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৩ লাখ শ্রমিক এক ঐতিহাসিক ধর্মঘটে শামিল হয়েছিল। ২ মে ছিল রোববার। ৩ মে ম্যাককর্মিক হার্ভাস্টার কারখানায় নির্মম পুলিশি আক্রমণ চলে, তাতে প্রাণ হারান ৬ জন নিরীহ শ্রমিক। সেই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর পরের দিন অর্থাৎ ৪ মে হে মার্কেট স্কোয়ারে আয়োজিত হয় এক বিশাল প্রতিবাদ সভা। পুলিশ এই সভায় গুলি চালালে শহিদের রক্তে রাঙা হয় হাতের পতাকা। গ্রেপ্তার করা হয় চারজন শ্রমিক নেতাকে। বিচারের নামে শুরু হয় প্রহসন, জারি করা হয় ফাঁসির আদেশ। দেশকালের গন্ডি পেরিয়ে এই নৃশংস বর্বরতার খবর ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়ার সব মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের কানে। আমেরিকার শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সমর্থনে দেশে দেশে শ্রমিকরা সংহতি আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে মালিকরা বাধ্য হয়ে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি মেনে নিতে শুরু করে। ১৮৮৯ সালে জুলাই মাসে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথমদিনের অধিবেশনেই সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয় যে ১৮৯০ সালে ১ মে থেকে প্রতি বছর শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি, ভ্রাতৃত্ব ও সংগ্রামের দিন হিসেবে এই দিনটি পালিত হবে। এভাবেই ১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক মে দিবস ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক মে দিবসে পরিণত হলো। অর্থাৎ মে দিবসের সামগ্রিক ইতিহাস শুরু থেকেই শ্রমিকশ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তি অর্জন ও আন্তর্জাতিক সংহতির লক্ষ্যে ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাস। এটি কখনোই নিছক কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। মে দিবসকে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দি করার অর্থই হলো শ্রমিকশ্রেণিকে তার মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রাম থেকে বিচু্যত করার প্রচেষ্টা। শ্রমিকশ্রেণির কাছে মে দিবস হলো নতুন সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার শপথের দিন। কারণ সংগ্রাম ছাড়া আর কোনো পথে শ্রমিকের পক্ষে তার ন্যায্য দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। মে দিবস একটি সংগ্রামের নাম। কারণ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এর উদ্ভব। আবার মে দিবস আয়োজনের ব্যাপারটাও আগাগোড়াই ছিল ও আজও হয়ে আছে একটি সংগ্রামের বিষয়। গত প্রায় সোয়াশ বছরের ইতিহাসে মে দিবস উদযাপনের জন্য দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণিকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। সইতে হয়েছে নানামাত্রার পুলিশি নির্যাতন, জেল-জুলুম-হুলিয়াসহ দমন-পীড়ন। এখনো বিশ্বব্যাপী কম-বেশি একই পরিস্থিতি বিদ্যমান। আমাদের দেশেও দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মে দিবস উদযাপনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে মে দিবস পালন করাকে কার্যত দেশদ্রোহী কাজ বলে ব্রিটিশ শাসকরা বিবেচনা করত। পাকিস্তান আমলেও মে দিবস পালন করতে হতো অনেক সতর্কভাবে ও লুকিয়ে ছাপিয়ে। ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। প্রকাশ্যে মে দিবসের অনুষ্ঠান হতে শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রণাঙ্গনেই আমরা মে দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। এই মহান মে দিবস হচ্ছে পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের বিজয় নিশান। এই কারণে মে দিবস বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রমের মর্যাদা রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে রক্ত দিয়েছে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ। তাই দিনটি শ্রমিকশ্রেণির মানুষের মহান দিন। নিজেদের জীবন দিয়ে তারা তাদের দাবি আদায় করেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্যও দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অর্থনীতির চাকাকে যে সব খাত সচল রেখেছে তার মধ্যে তৈরি পোশাক খাত অন্যতম। আন্তর্জাতিক বাজারে এই শিল্পের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। এক সময় যে সব রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছিল তা আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ রপ্তানি আদেশ ফিরিয়ে নিয়েছিল বিদেশি ক্রেতারা। দেশের তৈরি পোশাক খাতে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে। আমাদের মহলস্নায় চার বোন একসঙ্গে গার্মেন্টে কাজ করে। আগে তাদের সংসারের অবস্থা ভালো ছিল না। দিন এনে দিন খেত তারা। অনেক সময় উপোসও থাকত। গার্মেন্টে কাজ করার সুবাদে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। তারা এখন সচ্ছলতার মুখ দেখেছে। কেবল চার বোনই নয়- গার্মেন্টে কাজ করে অনেকেরই ভাগ্য বদল ঘটেছে। আমি সকালে যখন বাসা থেকে বের হই তখন দেখতে পাই লাইন ধরে মেয়েরা গার্মেন্টে যাচ্ছে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে এই নারীরা তথা তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা। এই শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। অনেক সময় তাদের জীবনও বিপন্ন হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে বাধাগুলো শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে মে দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে অনেকটাই মুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সুতরাং মে দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেকটা পরিমাণেই মুক্তির নব অধ্যায় রচনা করেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার পথে অগ্রসর হতে ১৯৭২-এর সংবিধানে 'সমাজতন্ত্র'কে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু হত্যা, ষড়যন্ত্র, অন্তর্ঘাত ইত্যাদি চালিয়ে দেশকে অল্প সময়ের মধ্যে সে ধারা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণি ও জনগণের অধিকার ও কর্তৃত্ব স্বীকার করা হলেও আজ পর্যন্ত তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং জনগণের সম্পদ ও উৎপাদন ব্যবস্থার কর্তৃত্ব চলে গেছে লুটেরা শ্রেণির হাতে। সব খাতের শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য নূ্যনতম মজুরি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিছু খাতে এই কাগুজে নিয়মের আংশিক বাস্তবায়ন হলেও বৃহত্তর শ্রমিক সমাজে থেকে এখনো বঞ্চিত। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রেও নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করা হয়। রানা পস্নাজাসহ বিভিন্ন পোশাক কারখানায় দুর্ঘটনায় প্রচুর শ্রমিকের প্রাণহানির বিচার করা ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়গুলো ঝুলে রয়েছে। সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালিগুলোর মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন দেশের জনগণ।' ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্ত করা।' ২০(১) অনুচ্ছেদে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, 'কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয় এবং প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতা অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী- এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।' শ্রমিকদের কিছু উন্নতি হয়েছে, শিশুশ্রম কমেছে। তবু শোষণ-বঞ্চনা-ৈ বৈষম্যের অবসানে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রবাসের শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। কৃষি খাতের মজুর, গৃহস্থালি সহকারীসহ অনেক খাতের শ্রমজীবীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি নেই। রিকশাচালকসহ স্বনিয়োজিত শ্রমিকদের জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। বিশেষভাবে বঞ্চিত নারী ও শিশুশ্রমিকরা। পৃথিবীকে শান্তিময় ও ন্যায়ভিত্তিক করতে হবে। সে জন্য শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে। মহান মে দিবস সেই প্রেরণার অফুরান উৎস। মে দিবস এখন শ্রমিকদের উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর এই দিনে বিভিন্ন সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন জাঁকজমকপূর্ণভাবে মে দিবসের কর্মসূচি পালন করে। শ্রমিকরা দলে দলে ঢাকঢোল বাজিয়ে, রং ছিটিয়ে এসব অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। পুরুষের পাশাপাশি এখন নারীশ্রমিকরাও মে দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সব মিলিয়ে মে দিবসে ঢাকা শহর শ্রমিকদের উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর শ্রমিক সংগঠনগুলোর মে দিবসের কর্মসূচি পালন করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি করোনার কারণে নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন শ্রমজীবী মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। প্রান্তিক কৃষক আর শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে আজ হাহাকার অবস্থা। আমাদের সমাজের একশ্রেণির শিল্পপতি অতি মুনাফার লোভে শ্রমিকদের ব্যবহার করছে। শ্রমিকরা তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শিল্প মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করছেন। কিন্তু তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই করোনাকালেও একশ্রেণির মালিক তাদের নিয়ে বঞ্চনা ও শোষণের খেলা পেতেছেন। এমনকি তাদের মাসিক বেতন-ভাতাও যথারীতি প্রদান করছেন না এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাঁটাইয়ের কাজ চলমান আছে, যা শ্রমিক স্বার্থবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী। করোনার এই মহাদুর্যোগে অন্ততপক্ষে খেটে খাওয়া মেহনতি ও গরিব মানুষের অধিকারের প্রতি সচেতন হয়ে করোনাযুদ্ধে অবতীর্ণ হই, পাশাপাশি মানবতার পাশে দাঁড়াই। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: সাবেক উপ-মহাপরিচালক বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক