শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্যোগে মানুষ মানুষের জন্য

আসুন আমরা মাস্ক কেলেঙ্কারি কিংবা ত্রাণ চুরি না করে, সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করি এবং যাদের সামর্থ্য আছে সাধ্যমতো গরিবদের আর্থিক সহায়তা করি।
মো. শফিকুল ইসলাম
  ০৫ মে ২০২০, ০০:০০

বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ করোনা দুর্যোগে উন্নত, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত সব দেশই হাবুডুবু এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে হিমশিম খাচ্ছে। করোনাভাইরাসে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিমান যোগাযোগ, শিক্ষা কার্যক্রম এবং স্বাভাবিক জীবন এক ধরনের থমকে আছে। করোনাসংক্রমণের ঝুঁকি থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা রাত-দিন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশে এক অসাধু ব্যবসায়ীরা ও কিছু রাজনৈতিক নেতারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। বিশ্ব নেতারা ভাবছে কীভাবে মৃতু্যর মিছিল থেকে লাশের সংখ্যা কমানো যায় এবং অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখা যায়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। আর এরা চিন্তা করে কীভাবে অসৎ উপায়ে অধিক মুনাফা করা যায়। এরা সমাজ বা দেশের জন্য ক্ষতিকর। এদের নিন্দা করার ভাষা নেই। চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আর মাস্ক ও ত্রাণ চোরের কার্যক্রম জাতিকে বিব্রত করছে। তাই এদের মানুষ নামে পরিচয় না দেওয়াই ভালো।

বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের ব্যবহারের জন্য নকল মাস্ক সরবরাহ করছে এক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। যেখানে দেওয়ার কথা ছিল এন-৯৫, দিয়েছে নিম্নমানের কাপড়ের মাস্ক। এটা কি ভাবা যায়? এই সময়ে মানুষ কি এটা করতে পারে? কতটুকু মনুষ্যত্বহীন হলে এ কাজ করতে পারে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারও কারও সঙ্গে যোগসাজশ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকসহ পুরোজাতি আজ বিব্রতকর পরিস্থিতি ও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এগুলো ব্যবহার করে রোগীদের সংস্পর্শে যাওয়া মানে শুধু বিপদ নয়; বরং করোনাসংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চিকিৎসকরাও মরবে, আমাদের মরতে হবে এসব নীতিহীন মানুষের কারণে।

এমন ঘটনা সম্পর্কে কেউ প্রতিবাদ করারও সাহস পাচ্ছে না। চিকিৎসকদের মতে, এমন ঘটনা আগেও একটি হাসপাতালে ঘটেছিল এবং হাসপাতালের প্রধান প্রতিবাদ করলে তাকে বদলি করে দেওয়া হয়। এ জন্য চিকিৎসকরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারছেন না। চিকিৎসক-নার্সদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য এটি অন্যতম কারণ বলে মনে করছি। নিম্নমানের মাস্ক ও পিপিই ব্যবহার করে করোনার রোগীর চিকিৎসায় আইসোলেশন ওয়ার্ড, আইসিইউ ও ল্যাবরেটরিতে যাওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তাদের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে।

গণমাধ্যম মারফত জানতে পারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তৃপক্ষ বলেন, ভুলবশত জেএমআই গ্রম্নপ নামের প্রতিষ্ঠানটি 'এন-৯৫'-এর প্যাকেটে নিম্নমানের মাস্ক দিয়েছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পক্ষ থেকে ওই প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এটা কোনো সমাধান নয়। দ্রম্নত আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল। আর মালামাল ডেলিভারি দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিদর্শন করা প্রয়োজন ছিল। তাই এসব অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর এধরনের অবহেলা কোনোভাবে কাম্য নয়।

জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ওই মাস্কের মান নিয়ে লিখিতভাবে সিএমএসডিকে (কেন্দ্রীয় ঔষধাগার) বিষয়টি জানিয়েছিল। কিন্তু তাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্ণপাত করেনি। অবশেষে গোয়েন্দা রিপোর্টে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রথম দিকে ২০০ থেকে ২৫০ পিস প্রকৃত 'এন-৯৫' মাস্ক সরবরাহ করেছিল ওই প্রতিষ্ঠানটি। পরে দেশে তৈরি নিম্নমানের মাস্ক 'এন-৯৫ প্যাকেটে সরবরাহ করে। এর মানে একটু ভালো দেখিয়ে পরে সর্বনাশ করছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য পরিকল্পিতভাবে এই প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের মাস্ক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের মধ্যে সরবরাহ করেছে কিনা। এটা খতিয়ে দেখা দরকার। তা এখন অনেকেরই মনে প্রশ্ন। এর মাধ্যমে দেশের চিকিৎসককে নিশ্চিত মৃতু্যর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ঝুঁকির মুখে আজ দেশের স্বাস্থ্যসেবা, বিপন্ন হয়ে পড়েছে সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক ও নার্সদের জীবন। অতিদ্রম্নত উলিস্নখিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সামনে আরও বড় ধরনের বিপদ হতে পারে, তাই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপস করার কোনো সুযোগ নেই; স্বাস্থ্য খাতকে বাঁচাতে হলে এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে। এসবের মূলে রয়েছে, যেখানে যে যোগ্যতার লোক বসার কথা ছিল, সেখানে দেখা গেছে এর চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নিয়োগ পেয়েছে। এসব লোক দিয়ে করোনার মতো মহামারি সামাল দেওয়া একটু কঠিন। এদের কারণে আজ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের এত সব অব্যবস্থাপনা সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়ছে।

এ ছাড়া অন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা মানহীন মাস্কসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ফুটপাত, রাস্তা-ঘাট ও অনলাইনে বিক্রি করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পিপিই সংকটে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র দেশে নকল এন-৯৫ মাস্ক, টেস্ট কিট, গাউন, গস্নাভসসহ করোনার নানা সুরক্ষা সামগ্রী তৈরি করতে শুরু করছে। পুরান ঢাকার অলিগলিতে তৈরি হচ্ছে এসব নকল পণ্য। আবার কেউ কেউ বিদেশ থেকে মানহীন পণ্য এনে অভিজাত ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজারজাত করে বেশি দামে বিক্রি করছে এসব নকল পণ্য। তা আমরা সাধারণ নাগরিকরা টাকা দিয়ে ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য এসব পণ্য কিনে থাকি। এগুলো ঝুঁকি তো কমায় না বরং আরও আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। এমনকি এসব কোম্পানির পিপিই উৎপাদন করার অফিসিয়াল অনুমোদনও নেই। বিক্রি করার সময় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছে না তারা।

চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ব্যাংক কর্মকর্তা, পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করোনা প্রতিরোধে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তা খুবই প্রশংসনীয়। আর অন্যদিকে এই আসাধু ব্যবসায়ীরা দেশের সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে মজা করছে। তাই ত্রাণ চোরসহ সব অসাধু ব্যবসায়ীদের তদন্ত সাপেক্ষে দ্রম্নত আইনের আওতায় আনা উচিত। রাজনীতিবিদরা একে অন্যকে সমালোচনা করে যাচ্ছে। যা এ সময়ে কাম্য নয়। কীভাবে জাতি এই মহামারি থেকে রক্ষা পাবে তাই এখন মুখ্য বিষয়।

ইদানীং দেশে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে মানবিক ও সামাজিক সংকট প্রতীয়মান হয়েছে। আক্রান্তদের সুরক্ষা না দিতে পারলে সংক্রমণের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে এই দুর্যোগের সময়ে। তাই সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে, করোনাসংক্রমণের ঝুঁকি থেকে মুক্তির জন্য সচেতন হতে হবে এবং নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। একে অন্যের দোষ না খুঁজে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করোনা মোকাবিলা করতে হবে।

বর্তমানে পৃথিবী এক মহাযুদ্ধ অতিক্রম করছে। যার পরিণাম হবে ভয়াবহ। যেখানে মানুষ মানুষের জন্য কাজ করবে, মানবিক হবে একে অন্যের বিপদে। সেখানে এই ধান্দাবাজরা কি করে যাচ্ছে? কেউ ত্রাণ চুরি করছে, কেউ ভবিষ্যতে অধিক মুনাফার লোভে সরকারি তেল বা চাল মজুত করছে। তা খুবই দুঃখজনক। তাই এই যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের এসব কাজ কোনোভাবে কাম্য নয়, এদের চরম শাস্তি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এরকম সাহস না করতে পারে। করোনাভাইরাসের এই লকডাউনে যেখানে মানুষ খাবার পাচ্ছে না, দেশের মানুষ রয়েছে এক মহাসংকটে। এই সংকটে দিনমজুর ও গরিবদের খাবার সহায়তা দিচ্ছে সরকার, সেই ত্রাণ বণ্টনের দায়িত্ব পেয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা। যেখানে তারা সুষ্ঠ বণ্টন না করে বরং সেই সুযোগে কেউ কেউ এই চরম সংকটে গরিবের ত্রাণ চুরি করছে। অনেকেই যদিও চাল চুরি করার অপরাধে দল ও সংশ্লিষ্ট পদ থেকে আজীবন বহিষ্কারও হয়েছে। অন্যদিকে চাল চোরদের পক্ষ নিয়েছেন কেউ। এটা আরও লজ্জাকর বিষয়। যদিও দুর্নীতি দমন কমিশন এদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করছে, তা অবশ্যই ভালো খবর। ভবিষ্যতে মাস্ক এবং ত্রাণ চোররা এধরনের অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত থাকবে বলে মনে করি।

আসুন আমরা মাস্ক কেলেঙ্কারি কিংবা ত্রাণ চুরি না করে, সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করি এবং যাদের সামর্থ্য আছে সাধ্যমতো গরিবদের আর্থিক সহায়তা করি।

মো. শফিকুল ইসলাম: পিএইচডি ফেলো, জংনান ইউনির্ভাসিটি অব ইকোনমিকস অ্যান্ড ল, উহান, চীন এবং শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

ংযধভরয়@লশশহরঁ.বফঁ.নফ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<98348 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1