বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস, রমজান মাস ও খাদ্যে ভেজাল

আমাদের দেশে ভেজালের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রমজান মাস শুরু হলে। এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে খাদ্যের দাম কমে এলেও আমাদের দেশে হয় উল্টো। প্রতিযোগিতা করে ব্যবসায়ী বাড়িয়ে দেন মূল্য।
সাহাদাৎ রানা
  ০৬ মে ২০২০, ০০:০০

এখন সারা বিশ্বে প্রধান আলোচনার বিষয় করোনাভাইরাস। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। বাংলাদেশেও প্রায় প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারাদেশে চলছে লগডাউন। এ কারণে দেশের হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো বেশ কয়েকদিন ধরেই বন্ধ ছিল। তবে সম্প্রতি ইফতারির জন্য কিছু প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁয় সীমিত আকারে চলছে বেচাকেনা। এখন করোনাভাইরাসের কারণ সবার কাছে প্রধান আলোচনার বিষয় করোনা। তবে এখন করোনাভাইরাস না থাকলে সবার কাছে অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয় হতো খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রসঙ্গটি। কারণ রমজানের সময় আমাদের দেশে খাদ্যে সবচেয়ে বেশি ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সীমিত আকারে ইফতারসামগ্রী বিক্রি করা শুরু করায় সেই শঙ্কা কিছুটা হলেও আবারও জেগেছে। পাশাপাশি লগডাউনের এই সময়ে নিত্যপণ্য বিক্রির ক্ষেত্রেও ভেজাল দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে মূল্য বেশি নেওয়ার। করোনার এমন কঠিন সময়ে তাই ভেজাল খাদ্যের বিষয়ে এবার একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক।

খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার বিষয়টি আমাদের দেশে সবসময় একটি আলোচিত বিষয়। আলোচিত হওয়ার কারণ বছরের নিদিষ্ট একটি সময়ে নয়, সারা বছরই খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার মতো অপকর্মে লিপ্ত থাকে একশ্রেণির লোক। আর এমন প্রবণতা দিন দিন শুধু বাড়ছেই। এটাই সবচেয়ে ভয়ের খবর। আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না, প্রতিদিন আমরা যা খাচ্ছি তা কতটা নিরাপদ। কারণ ভেজাল খাদ্যে বাজার সয়লাব। নিজের কষ্টের টাকায় আমরা মহানন্দে পরিবারের জন্য বিষ কিনে নিয়ে যাচ্ছি, প্রতিদিন। দুঃখের বিষয় আমরা আসলে নিশ্চিত নই ভালো কোনো খাবার কিনতে পারছি কিনা। কারণ কোনটা যে ভেজালমুক্ত খাদ্য তা নির্ণয় করাও কঠিন হয়ে পড়ছে সবার জন্য। ভেজাল খাদ্যের বিষয়টি সম্পর্কে সবাই অবগত; কিন্তু উদরপূর্তি তো করতে হবে। তাই জেনেও বিষ খেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। অথচ, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে আমাদের দেশে রয়েছে আইন। আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ)-এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে এবং ওষুধে ভেজাল মেশালে বা বিক্রি করলে অপরাধী ব্যক্তির মৃতু্যদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ১৪ বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। আইনের খাতায় এমন শাস্তির বিধান থাকলেও আমরা কখনো শুনিনি খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার অপরাধে কারও মৃতু্যদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। আমরা মাঝেমধ্যে যা দেখি তা হলো মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ভেজালকারীকে আর্থিক দন্ড দেওয়া হয়। জরিমানার অঙ্কটা এতটাই কম হয়, অপরাধী তাৎক্ষণিক সেই টাকা পরিশোধ করে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারও মহানন্দে বলা যায় প্রায় দ্বিগুণ উৎসাহে ভেজাল খাদ্য বিক্রির মহোৎসবে মেতে ওঠেন। ১৯৭৪ সালে সেই আইন হলেও বর্তমান সময়ে বিশেষ করে গত দুই যুগ ধরে এদেশে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মাত্রা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। দিন দিন তা হয়ে উঠছে সবার জন্য অসহনীয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেন ভেজাল খাদ্য প্রস্তুতকারকদের মধ্যে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা। আইন থাকলেও আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার কারণে নিরুপায় জনগণ, জিম্মি বিষপ্রয়োগকারীদের কাছে।

আমরা প্রতিদিন যেসব ভেজাল খাদ্য খাচ্ছি তার তালিকা নেহাত ছোট নয়। সহজ কথায় প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কোনো না কোনো ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করছি। শাক-সবজি, মাছ-মাংস, দুধ, মসলা থেকে ফলমূল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যে যেন ভেজালই এখন অনিবার্য। কেউ যদি মনে করেন এসব ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হলে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হবেন, সেখানেও অপেক্ষা করছে ভয়ানক বিপদ। কারণ ভেজালের তালিকায় বাদ নেই জীবনদায়ী ওষুধও। যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য সত্যিই ভয়ঙ্কর খবর। দুঃখজনক হলেও সত্য- শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষজন না জেনে এসব মরণ জিনিস কিনে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিকারের আশায়। উল্টো প্রতিকার না হয়ে, ধাবিত হচ্ছে মৃতু্যর কোলে। এখন প্রশ্ন হলো- কেন এমন করছেন ভেজালকারীরা? বাস্তবতা হলো- তারা সচেতনভাবে মূলত ফলমূল, শাক-সবজি ও মাছে মেশাচ্ছেন জীবন ধ্বংসকারী বিষ ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোফেন, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার, ডিডিটিসহ নানা মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান। এছাড়া বিস্কুটসহ বেকারিদ্রব্যে রয়েছে বিষসমতুল্য রং আর মুড়িতে দিচ্ছেন কৃষিকাজে ব্যবহৃত ইউরিয়া সার; যা খেয়ে আমরা ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছি নিশ্চিত মৃতু্যর দিকে। বিশেষ করে শিশুরা এসব খাদ্য গ্রহণ করে প্রতিনিয়ত অসুস্থ হচ্ছে। সাদা চোখে সব দেখছি। কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় আজ বাস্তবিকই সোনার হরিণ। অসাধু ভেজালকারীরা মূলত একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখে এসব কাজ সবার চোখের সামনে প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন। তা হলো অধিক মুনাফা। এটাই তাদের প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু তাদের অধিক মুনাফার কারণে অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সব মানুষ। অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে বিচলিত হওয়ার সামান্যতম অবকাশ নেই তাদের। এই লোভে অসাধু এসব ব্যবসায়ী জনসাধারণের হাতে প্রকারান্তরে বিষ তুলে দিচ্ছে। যা আমরা বুঝেও বুঝি না। অথচ তারাও কি বোঝে এই ভেজালের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত নয় তাদের সন্তানরাও!

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ভেজাল খাদ্যে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি নানাভাবে। আর সে পরিসংখ্যান রীতিমতো পিলে চমকানো। গত দুই দশকে আমাদের চিকিৎসক ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বারবার ভেজাল খাদ্য বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে এলেও কর্ণপাত করছেটা কে? যদিও তথ্যটা ভয়ানক হলোও সত্য; বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজালপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে মানুষের মৃতু্যর হার দিনদিন বাড়ছে। বিশেষ করে খাদ্যে ভেজালজনিত বেশ কয়েকটি রোগ আমাশয়, অ্যাপেনডিক্স, রক্তচাপ, হৃদরোগ ও কিডনি রোগ আর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এসব রোগে মানুষের মৃতু্যহার বেড়ে যাওয়ার পরিসংখ্যান সত্যিই উদ্বেগজনক। সবার জন্যই ভয়ানক। কিন্তু এতসব তথ্যের মধ্যেও খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বল্গাহীনভাবে। আর তা দিনকে দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। আর এই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার মূলত একটাই কারণ। সহজ কথায় আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। আইন আছে কিন্তু নেই এর সঠিক প্রয়োগ।

আমাদের দেশে ভেজালের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রমজান মাস শুরু হলে। এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে খাদ্যের দাম কমে এলেও আমাদের দেশে হয় উল্টো। প্রতিযোগিতা করে ব্যবসায়ী বাড়িয়ে দেন মূল্য।

এসময় কিছু কিছু ব্যবসায়ী কেমিক্যাল ব্যবহার করে গোডাউনে অধিক খাদ্য মজুত করে বাজারে সৃষ্টি করে কৃত্রিম সংকটের। যার প্রভাব পড়ে সারাদেশে। মূলত সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। অবাক করা বিষয় হলো- ভেজাল খাদ্যের বিষয়ে সারা বছরই মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা-লেখালেখিও হয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতার জন্য সভা-সেমিনারও কম হয় না। সবাই দাবি জানান নিরাপদ খাদ্যের। কিন্তু সেভাবে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এর একমাত্র ও প্রধান কারণ ভেজালকারীদের যথাযথ শাস্তির আওতায় না আনা। আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা। সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্ধারিত আইনে মামলা না করা। এসব কারণে ভেজালকারীরা মূলত খাদ্যে ভেজাল মেশাতে সাহস পাচ্ছেন। লঘু শাস্তির কারণে ভেজালবিরোধী অভিযানের ভয়ের কোনো তোয়াক্কা না করে মহানন্দে চলছে খাদ্যে ভেজাল মেশানো। অথচ প্রশাসনের সঠিক আর কার্যকর উদ্যোগ এবং সবার একটু সচেতনতাই পারে আমাদের এসব বিষ থেকে মুক্ত রাখতে। আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে দ্রম্নত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই। কারণ এর সঙ্গে জড়িত মানুষের জীবন। জড়িত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের, ভবিষ্যৎও। তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তবেই হয়তো আমরা কিছুটা পরিত্রাণ পেতে পারি ভেজাল খাদ্য থেকে। বিশেষ করে, করোনাকালে এমন কঠিন সময়ে আর যাই হউক কাউকে যেন ভেজাল খাদ্য দিয়ে চিন্তা করতে না হয়। সবাই যেন নিরাপদ খাদ্য খেতে পারেন। তবেই সবার মধ্যে কাজ করবে স্বস্তি।

সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<98461 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1