মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
নিপাহ ভাইরাস

বিজ্ঞানের যত কথা

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ০৬ জুলাই ২০২০, ০০:০০

নিপাহ ভাইরাস একধরনের ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ। সুঙ্গাই নিপাহ নামক মালয়েশিয়ার একটি গ্রামের নামে এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয়। সেই সময় এই রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেই জন্য লাখ লাখ শূকরকে মেরে ফেলা হয়। এই সংক্রমণের কোনো লক্ষণ নাও দেখা দিতে পারে বা জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বিভ্রান্তি ইত্যাদি হতে পারে। এক বা দুদিনের মধ্যে রোগী অচেতন হয়ে পড়তে পারেন। রোগ সেরে যাওয়ার পর মস্তিষ্কে সংক্রমণ ও খিঁচুনি ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।

নিপাহ ভাইরাস হলো এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস যা প্যারামিক্সোভিরিডি পরিবারের হেনিপাহ ভাইরাসদের অংশ। সংক্রমিত পশু ও মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই রোগের কোনো টিকা বা বিশেষ চিকিৎসা নেই। বাদুড়, রুগ্ন শূকর থেকে দূরে থেকে এবং অপরিশুদ্ধ খেজুর রস না পান করে এই রোগের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণে ৫৮২ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে ৫৪% মৃতু্যবরণ করেছেন।

লক্ষণ ও উপসর্গ : রোগের উপসর্গ সংক্রমণের ৩-১৪ দিনের মধ্যে হয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে জ্বর, মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, বমি, গলাব্যথা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো উপসর্গ দেখা যায়। মাথা ঘোরা, তৃষ্ণা, বেহুঁশ হয়ে যাওয়া, অসংলগ্ন প্রলাপ এবং মস্তিষ্কের তীব্র সংক্রমণজনিত স্নায়বিক লক্ষণ লক্ষ্য করা যেতে পারে। কিছু লোক নিউমোনিয়া, তীব্র বুক যন্ত্রণাসহ তীব্র শ্বাসকষ্টের সম্মুখীন হতে পারেন। শ্বাসকষ্টবিহীন রোগী অপেক্ষা যে সব রোগীর শ্বাসকষ্ট উপস্থিত হয়, তাদের দ্বারা বেশিমাত্রায় এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগী অচেতনাবস্থায় চলে যেতে পারেন। অল্পসংখ্যক মানুষ যারা প্রাথমিকভাবে ভালো হয়ে উঠলেও পরে মস্তিষ্কের সংক্রমণে ভুগতে পারেন। মৃতু্যর হার ৪০% থেকে ৭৫% পর্যন্ত হতে পারে।

সংক্রমণের মাধ্যম : নিপাহ ভাইরাস একটি জুনোটিক ভাইরাস যা প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে। মালয়েশিয়ায় এবং সিঙ্গাপুরের প্রারম্ভিক প্রাদুর্ভাবের সময়, বেশির ভাগ মানুষের সংক্রমণের কারণ ছিল। এই ভাইরাস দ্বারা অসুস্থ শূকর বা তাদের দূষিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। সংক্রমণ শূকরের গলা বা নিশ্বাসের, বাদুড়ের প্রস্রাবের সঙ্গে নিঃসৃত দূষিত ভাইরাস কণার মাধ্যমে ঘটেছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব সংক্রমিত ফলভোজী বাদুড়ের প্রস্রাব অথবা লালা দ্বারা দূষিত ফল বা ফলের পণ্য (যেমন, কাঁচা খেজুর রস) খাওয়ার ফলে ঘটে। পরে প্রাদুর্ভাবের সময় নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে সরাসরি সুস্থ মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।

শনাক্তকরণ : নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোনো নির্দিষ্ট প্রাথমিক লক্ষণ এবং উপসর্গ নেই এবং উপস্থাপনার সময় নিপাহ ভাইরাস রোগ হিসেবে প্রায়ই সন্দেহ হয় না, যা সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে। ক্লিনিকাল নমুনার পরিমাণ, মান, টাইপ, সংগ্রহের সময় জ্ঞান এবং পরীক্ষাগারে রোগীদের থেকে নমুনার স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ার ত্রম্নটি রোগ নির্ণয়ের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।

প্রস্রাব, রক্ত, সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড ইত্যাদি শারীরিক তরল থেকে প্রকৃত সময় পলিমারেজ চেন প্রতিক্রিয়াসহ (আরটি-পিসিআর) প্রধান পরীক্ষার পাশাপাশি এলাইসা, কোষ কালচার দ্বারা ভাইরাসটিকে শনাক্ত করা যায়। রোগ থেকে মুক্তি ঘটার পর ইমিউনোগেস্নাবিউলিন জি ও ইমিউনোগেস্নাবিউলিন এম অ্যান্টিবডি শনাক্ত করে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়।

প্রতিরোধ : বাদুড় ও রুগ্ন শূকর থেকে দূরে থেকে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়। বাদুড়ের বর্জ্যমিশ্রিত খেজুরের রস পান ও বাদুড়ে পূর্ণ কুয়োর জল ব্যবহার না করাই শ্রেয়। বাদুড়রা সাধারণত খোলা পাত্রে সংগৃহীত খেজুর রস পান করে ও মাঝেমধ্যে প্রস্রাব করে, যার ফলে সেটি নিপাহ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। বাদুড়ের প্রজনেনর সঙ্গে এই রোগের সম্পর্ক এখনো পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্ণীত হয়নি। হেন্ড্রা জি প্রোটিন নির্মিত একটি টিকা বানরদের হেন্ড্রা ভাইরাসের সংক্রমণে ব্যবহার করা হয়েছে, যা হেনিপাহ ভাইরাস ও নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধেও অ্যান্টিবডি তৈরি করে, কিন্তু মানুষের ওপর এই টিকার প্রভাব এখনো নির্ণীত হয়নি।

চিকিৎসা : বর্তমানে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোনো কার্যকর চিকিৎসা নেই। নিপাহ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত এমন প্রত্যেক সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখা প্রয়োজন এবং প্রগাঢ় সহায়ক চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। পরীক্ষাগারে রিবাভিরিনের কার্যকারিতা লক্ষ্য করা গেলেও মানব শরীরে এর প্রভাব এখনো প্রমাণিত নয়। নিপাহ জি গস্নাইকোপ্রোটিনের বিরুদ্ধে উৎপাদিত একটি হিউম্যান মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে টিকাকরণের পরীক্ষা চলছে। নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ বাংলাদেশে সর্বাধিক মৃতু্য ঘটে। সাধারণত শীতকালে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের প্রকোপ ঘটে থাকে। ১৯৯৮ সালে প্রথম মালয়েশিয়ার শূকর ও তার চাষিদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। ২০০১ সালে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলায় এই ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলা, মানিকগঞ্জ জেলা, রাজবাড়ী জেলা, ফরিদপুর জেলা ও টাঙ্গাইল জেলায় এই রোগের প্রকোপ ঘটে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<104917 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1