বিজ্ঞানের যত কথা

থ্যালাসেমিয়া

প্রকাশ | ১৩ জুলাই ২০২০, ০০:০০

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
থ্যালাসেমিয়া (ঞযধষধংংবসরধ) একটি অটোজোমাল মিউট্যান্ট প্রচ্ছন্ন জিনঘটিত বংশগত রক্তের রোগ। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহণকারী হিমোগেস্নাবিন কণার উৎপাদনে ত্রম্নটি হয়। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা 'অ্যানিমিয়া'তে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে। থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া। সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া প্ত থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়া বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি। এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমতো চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃতু্যর কারণ হতে পারে। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১ লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনই থ্যালাসেমিয়া বাহক বা একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক এবং একজন হিমোগেস্নাবিন 'ই'-এর বাহক হয় তবে প্রতি গর্ভাবস্থায় এ রোগে আক্রান্ত শিশু জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ। বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৫০ ভাগ। আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ। স্বামী-স্ত্রী দুজনের যে কোনো একজন যদি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকেন, তাহলে নবজাতকের থ্যালাসেমিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। লক্ষণ: অতিরিক্ত আয়রন, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি, পস্নীহা বড় হয়ে যাওয়া, অবসাদ অনুভব, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া, মুখের হাড়ের বিকৃতি, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, হৃৎপিন্ডের সমস্যা। কারণ: ত্রম্নটিপূর্ণ হিমোগেস্নাবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জিন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া। আলফা থ্যালাসেমিয়া : এই রোগের জন্য ১৬নং ক্রোমোজোমে উপস্থিত আলফা-শৃঙ্খল উৎপাদনকারী জিনের দায়ী। চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া শিকল তৈরি হয়। বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রম্নটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। যত বেশি জিন ত্রম্নটিপূর্ণ হবে তত বেশি মারাত্মক সমস্যা দেখা দেবে। যেমন : ১. একটি জিন ত্রম্নটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোনো লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াবে। ২. দুইটি জিন ত্রম্নটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে। এই অবস্থাকে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর অথবা আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট। ৩. তিনটি জিন ত্রম্নটিপূর্ণ হলে এর উপসর্গগুলো মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থাকে বলে হিমোগেস্নাবিন এইচ ডিজিজ। ৪. চারটি জিন ত্রম্নটিপূর্ণ হলে একে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া, মেজর অথবা হাইড্রপস ফিটালিসের ফলে প্রসবের পূর্বে অথবা জিনের পরপর ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়। বিটা থ্যালাসেমিয়া: বিটা থ্যালাসেমিয়া শিকল গঠিত হয় দুইটি জিন দিয়ে। বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রম্নটিপূর্ণ হলে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয় এ ক্ষেত্রে : ১. একটি জিন ত্রম্নটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়। এই অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর অথবা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট। ২. দুটি জিন ত্রম্নটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর অথবা কুলিস অ্যানিমিয়া নবজাতক যেসব শিশুর এই সমস্যা থাকে তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। তবে জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা যায়। চিকিৎসা : মাইনর থ্যালাসেমিয়াতে সাধারণত চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না। থ্যালাসেমিয়া মেজরে নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন প্রধান চিকিৎসা। বারবার রক্ত নেওয়া একটি বিপজ্জনক, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া। এর ফলে যকৃত বিকল হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে। এ ধরনের জটিলতা প্রতিরোধে আয়রন চিলেশন থেরাপি দেয়া হয়, অতিরিক্ত লৌহ বের করে দেওয়ার জন্য। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী চিকিৎসা। প্রতিরোধ : থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা খুবই সম্ভব। এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তাই এ রোগের বাহকদের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত এবং প্রতিহত করার মাধ্যমে সমাজে নতুন থ্যালাসেমিক শিশুর জন্ম হ্রাস করা যায়। তাই থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় এর জন্য হিমোগেস্নাবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামক পরীক্ষাটি করানোর মাধ্যমে আপনার শিশুকে এর অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখুন। এছাড়া ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থাৎ যেসব পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী দুজনই এ রোগের বাহক অথবা যাদের এক বা একাধিক থ্যালাসেমিক শিশু আছে তারা গর্ভস্থ ভ্রূণ পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য থ্যালাসেমিক শিশু নির্ণয় এবং তা পরিহার (গর্ভপাত) করতে পারেন। গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করালে ভালো হয়। গর্ভস্থ সন্তানের থ্যালাসেমিয়া জানার জন্য যে পরীক্ষাগুলো করতে হবে তা হলো কোরিওনিক ভিলিয়াস স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটিসিস ও ফিটাল বস্নাড স্যাম্পলিং। থ্যালাসেমিয়া বংশগত রোগ। সংক্রামক বা ছোঁয়াচে নয়। এটি পিতামাতার কাছ থেকে সন্তানের মধ্যে আসে। বিশ্বের আনুমানিক ৬০-৮০ মিলিওন মানুষ বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে। থ্যালাসেমিয়া স্বল্প উন্নত দেশ যেমন নেপাল, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে বেশি দেখা যায়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী ৫০ বছরে থ্যালাসেমিয়া অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।